শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

মার্চের বিশ তারিখে ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ হ্যাপিনেস। বিশ্ব সুখ দিবস। মানুষ সেই সব দিনগুলিকে আলাদা করে দেখতে চায় সেগুলো দু’রকম হতে পারে। এক, দিনগুলো তার কাছে প্রীতিকর আর দুই, অপ্রীতিকর। দুটিই স্মরণীয়। ঈশ্বরের সকল দিন সমান হলেও অমৃতের পুত্র মানুষের কাছে তা অবশ্য নয়। বিশ্বজুড়ে যেসব মনুষ্যসৃষ্ট দিন উদযাপন করা হয়, বা করা উচিত, তাদের একটি হল ‘বিশ্ব সুখ দিবস’।

এমনিতেই সুখ আর অসুখের ব্যাপারটা আপেক্ষিক। স্থান-কাল ও পরিস্থিতির কারণে তা পরিবর্তনযোগ্য। তাই সোনার থালা থেকে কলাপাতা, প্রাসাদ থেকে পর্ণকুটীর… সুখ সর্বত্রগামী। কেন? ভিড় বাসে নটরাজের নৃত্যভঙ্গিমা অবলম্বন করে যাত্রা সুখকর নয়। যেদিন যেদিন যেতে হয়, সেদিনগুলো অসুখদিবস। আবার, যেদিন রাস্তায় কিছু একটা বিপদ, ট্রাম বাস বন্ধ, লক্ষণ ভালো নয়, সেদিন এমন একটি বাস পেলেই সুখ।
মানুষ খুব দুঃখে আছে। বহুদিন ধরেই কবিরা এটা লক্ষ্য করে যাচ্ছেন। দার্শনিকরা বলেন, জীবনমাত্রেই অসুখের আগার। শরীর থাকলে দুঃখ থাকবেই। তার থেকে উত্তরণের নানা পথ। কায়িক, বাচিক, মানসিক, আত্মিক, বৌদ্ধিক… নানা উপায়ে সেই তিমির রাত্রি পার হওয়া যাবে। কবি বলবেন, তবুও শান্তি, আনন্দ ও অনন্ত-ই চিরজাগ্রত থাকে। তাকে পেতে হয় বিশেষ আয়াসে বা অনায়াসেই। ঘরের পাশে আরশিনগরেই সুখপাখির বাস।

কিন্তু, সুখ তো আনন্দ নয়, সুখ বুঝি অনন্তেও নিয়ে যেতে পারে না। তাহলে মহাকাব্য থেকে যাত্রাপালা পর্যন্ত যে কারুণ্যের বহমান স্রোত, তা তো আপাতদৃষ্টিতে সুখ নয়। কিন্তু, সেখানেও এক সুখস্রোতের আস্বাদ অন্তর্লীন হয়ে আছে তো! তাই সুখ আপেক্ষিক।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৫: ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’

কারও স্বর্গের কামনাতেই সুখ। কারও চার দেওয়ালের কোণে সুখ। কেউ দুখের রাতে সুখের স্রোতে ভাসায়, কখনও বা “এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়”। প্রেম, ভালোবাসা, ভালো বাসাবাড়ি, দিবানিদ্রা, বিদ্রুপ, হম্বিতম্বি সকলই সুখ এনে দিতে পারে। আনন্দ নয়। জাগতিক চাওয়া-পাওয়া, নাচানো, পাওয়ানো, বাধা, বাঁধা সুখ দিতে পারে রুচিমতো। এইসব দেখে প্রাচীন মহাজ্ঞানীরা প্রেয় বা আপাত রমণীয় ও শ্রেয় বা শাশ্বতের তত্ত্ব ভেবেছিলেন।

সুখ চিরকাল একই গতিতে ধাবমান নয়, একথা সত্য। তাই আরণ্যক জীবনের সুখ আর নাগরিক জীবনের সুখ সমানুপাতিক নয়। সুখ কখনও ভোগের নামান্তর। কখনও সুখ অপরিহার্য। রাজাকে রাজসুখ ভোগ করতেই হয়, শাস্ত্রকাররা রাজার জন্য চতুর্থ বর্গ মোক্ষ বরাদ্দ করেননি। বৈরাগ্য রাজার জন্য নয়। তাতে সামূহিক ক্ষতিই। আরণ্যক তপস্বী রাজভোগের প্রাচুর্যে ভরা রাজপ্রাসাদকে অগ্নিতপ্ত অবাসযোগ্য মনে করছেন। আবার, প্রেমিক ভালোবাসার পর্ণকুটীর নয়, রাজপ্রাসাদ গড়ে তুলতে চাইছে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫: কৃষ্ণ মাণিক্য সিংহাসনে বসেই উদয়পুর থেকে রাজধানী সরিয়ে আনেন আগরতলায়

সুতরাং, কার কীসে সুখ বলা কঠিন। তা কী বা কেন বা কীভাবে এসব জানা শিবের অসাধ্য। সুখের সঙ্গে মন, বুদ্ধি, আত্মা, ধর্ম অর্থ, কাম, মোক্ষ, স্বর্গ, নরক, পাপ, পুণ্য, রূপ, জয়, যশ, দ্বেষ, আসক্তি, রাগ, অনুরাগ আকাঙ্ক্ষা… সকলেরই সম্পর্ক। ক্লাসের গোবেচারা ছেলেটাকে জ্বালিয়ে সুখ। নিরীহ ভালোমানুষ বটকেষ্ট কী হরিপদকে নাস্তানাবুদ করিয়ে সুখ। আরণ্যক নির্বাধ জীবনে সুখ, বন্ধনে সুখ, বিরিয়ানিতে সুখ, পান্তাভাতে সুখ। বিপ্লবে সুখ, শীতঘুমে সুখ। যুদ্ধে সুখ, শান্তিতে সুখ। প্রাচীন যুগের সুখ, মধ্য যুগের সুখ, আধুনিক যুগের সুখ, ঔপনিবেশিক সুখ, উত্তরাধুনিক উত্তর-ঔপনিবেশিক সুখ, আলট্রা মডার্ন প্রো সুখ সব কিছু পার হয়ে হয়তো পাউরুটি আর ঝোলাগুড়েই সুখ। এখন আসুন পরে দেখছিতে সুখ। জেগে ঘুমোতে দিব্যি সুখ। স্বপ্নে সুখ। অলীকে সুখ।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৮: মোহিতকুমারী এক মহিলা আত্মজীবনীকার

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৯: ইন্দুমতী ও সুরবালা

জলছবি, রংমশাল, হজমি, পায়রা, রামধনু, ঝালমুড়ি, আব্বুলিশ, বিটনুন, চুড়মুড়, ফুটকড়াই, অ্যাণ্টেনা, হাতচিঠি, হাফপ্যাডেল, আয়না, জলপরী, সাপলুডো, চিত্রহার, মহাভারত, লোডশেডিং, শুকতারা হাঁদাভোঁদা, বাঁটুল, গুলতি, লাল নীল সাদা কালো পাঁচসিকের দুঃখগুলিই সুখ। দুয়ে যেমন সুখ, দুশোতেও। ডানদিকে শূন্য যতটা বাড়তে থাকে সুখ আপাতভাবে বাড়ে বটে। জমতে থাকে ট্রাফিক লাইটের সবুজে, মাল্টিপ্লেক্সে, ব্যাঙ্কোয়েটে, এফবি, সিসিডি, আইপিএলের এ টু জেডে। পৃথিবী জুড়ে সুখের আয়োজন। সেই আপাত সুখ-ই নাকি প্রকৃত দুঃখ। তবুও, পৃথিবীকে মায়াবীর নদীর পারের দেশ মনে হয় তো?

মানুষ কখনও বিনিময়মূল্যে সুখ কিনতে যায়, কিন্তু তখনই অমূল্য কিছু তার পাশে জেগে থাকে নীরব নিশীথিনীর মতো। তার বাড়িয়ে দেওয়া হাত যখন ধরেছে পৃথিবী, সুখ নেমেছে নিভৃতে। নিজেকে ভুলে সামনের সেই অচিনপুরের দিকে তাকিয়ে দেখো হে মহাপৃথিবী, সুখের চাবিকাঠি সেখানে মণিমঞ্জুষায় রাখা আছে।
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content