রবিবার ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: প্রচেতা।

 

স্বজন

কীরা কাকিমা আর শ্যানন এতদিন হিন্দু মতে অশৌচ পালন করেছেন। সকলকে অবাক করে বয়স্ক নির্মল নাপিতের তত্ত্বাবধানে তাঁর ছেলের কাছে সকলে একসঙ্গে নখ কাটলেন। বাবা-কাকাদের মস্তক মুণ্ডনের সময় নির্মলদা হাতে খুর ধরে খালি মাথার চুলে ছুঁইয়ে দিচ্ছিলেন। এখন নির্মলদার হাত কাঁপে। আর হাতে খুর ধরতে পারেন না। অসুস্থ। আজকাল বাড়ি থেকে বের হন না। তবু আজ এসেছেন।

দূর্গামণ্ডপের চাতালে বসে কাঁদছিলেন। বলছিলেন, এত বড় প্রাসাদ, এত ঐশ্বর্যের রাজরাজেশ্বরী হয়েও ছোটমা মানে আমার ঠাকুমা স্বর্ণময়ী তাঁকে ‘নির্মলদা’ বলে সম্বোধন করতেন। আপনি বলতেন। আমার ঠাকুমা স্বর্ণময়ী অভিজাত পরিবারের মেয়ে, ওদের বাড়ির বহু দিনের ড্রাইভার রফিককে ঠাকুমা ‘রফিক চাচা’ বলতেন। কিন্তু অনেক কঠিন দারিদ্র টপকে পথ থেকে প্রাসাদে পৌঁছনো বিনয়কান্তি দত্তের শিক্ষাগুরু ছিলেন তাঁর মা বসুন্ধরা। তাই তিনি আজীবন মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতে শিখেছেন। স্বর্ণময়ী আভিজাত্য নিয়েই এই পরিবার এসেছিলেন বসুন্ধরা তাকে যেন ঐতিহ্যের পরিপূর্ণতা দিয়েছিলেন।

নির্মলদা বড় ঠাকুমা বসুন্ধরাকে ‘বড়মা’ বলেন। আমার ঠাকুমাকে বলেন, ‘ছোটমা’। আর কি আশ্চর্য্য আমার মা সুরঙ্গমাকে বলেন ‘সেজমা’ । তিন প্রজন্মের তিনজন নারীকে কোন হিসেবে যে তিনি এ ভাবে সম্বোধন করতেন সেটা জানা হয়নি। যেমন বসুন্ধরা আর বিনয়কান্তি নির্মলদাকে ‘নির্মল তুমি’ বলে কথা বলতেন। এরপরে বড় জ্যাঠামনি, মেজ্জ্যাঠামনি, বাবা বা কাকারা সকলের ‘নির্মলদা আপনি’, বলতেন। আমরা এবং আমাদের ছেলেপুলেরাও অনায়াসে তাঁকে ‘নির্মলদা আপনি’ বলেই এসেছি।

ঠাকুমা বসুন্ধরা মারা যাওয়ার পর, দাদু বিনয়কান্তি গঙ্গায় গিয়ে ঘাটকাজ করেছিলেন। তবে বাড়ির সকলের ঘাটকাজ বসুন্ধরা ভিলাতেই হয়েছিল ট্যাংকারে করে গঙ্গার জল এনে সেই জলের বৃষ্টিতে লনে সকলের গঙ্গাস্নান হয়েছিল। সিনেমার শুটিংয়ে যেভাবে পাম্প লাগিয়ে স্প্রিংক্লার দিয়ে নকল ফোয়ারা তৈরি করা হয় ঠিক সেই ভাবে। নিচের তলার সবকটা গেস্টরুম খুলে দেওয়া হয়েছিল, সেখানে বাথরুমে সবাই বাড়ির জলে স্নান সেরে নতুন পোশাক পরেছিলেন।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., পর্ব-২৫: তারক নিয়োগী হলেন ‘আটপৌরে জিনিয়াস’

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৪: লোকশিক্ষক মা সারদা

স্বর্ণময়ীর বেলায় সকলে একইভাবে বসুন্ধরা ভিলার লনে ঘাটকাজ সারলেন। কীরা কাকিমা এবং শ্যানন সকলের সঙ্গে সব নিয়ম পালন করলেন। খুব স্বাভাবিকভাবে এই সময় আমার ন’কাকিমা সুজাতা অকারণে বেশি কথা বলছিলেন। কয়েকবার আমার মাকে বললেন—
—ওদের এ সব করিয়ে কষ্ট দেবার কি দরকার সেজদি? ভুল ভ্রান্তি
হলে তো মায়ের আত্মা কষ্ট পাবে!
এই পরিবেশে আমার মা নিজেকে সংযত করে রেখে চুপ করে হয়তো ভাবছিলেন ঠিক কি এবং কতটা বলা উচিত! আমার মা-সহ আরও অনেককে সেই মুহূর্তে চমকে দিয়ে কীরা কাকিমা স্পষ্ট স্বরে কিন্তু ভাঙা বাংলায় বললেন—
—চিন্টা করিবেন না ন’দি! ভুল করিলে মা আমাদের স্খমা করছেন!
শব্দ ব্যবহারের ভুলটা টপকে গিয়ে কথাগুলো সঠিক মানুষের সঠিক জায়গায় আঘাত করল।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসাসা— নুনিয়া ও সিঙ্গরা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩০: নলিনী দাশ— গণ্ডালুর সৃজনশিল্পী

শ্রাদ্ধবাসরে ভোজ্য দেওয়ার সময় বিবাহিত পুরুষরা সস্ত্রীক বসেন, এটাও বসুন্ধরার মামার বাড়ি মানে ঢাকার নারায়ণগঞ্জের দাশগুপ্ত বাড়ির রীতির থেকে এসেছে। সকলে সস্ত্রীক বসে স্বর্ণময়ীকে শ্রাদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করলেন। ন’কাকা হুইলচেয়ারে বসলেন, ন’কাকিমা সুজাতা পাশে আসনে বসলেন। স্বর্ণময়ীর অশেষ ভাগ্য আজ বাবলির সঙ্গে সভ্য ভদ্রভাবে প্রণয়ও বসল কীরা কাকিমা ও ফুলকাকা বসলেন, ওদের মাঝে বসলো শ্যানন। আমরা সকলে বসলাম পরে আমাদের ছেলেমেয়েদের গ্রুপ মাঝে সানন্দা আর ঋতু বসেছিল। স্বর্ণময়ী যে পরিপূর্ণ পরিবারের স্বপ্ন দেখতেন সেই পরিবারের প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিলেন কিন্তু আত্মীয়দের মধ্যে সেই আত্মার বন্ধন আর আছে কি?
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৫: প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন পরীক্ষায় পাশই করবেন না

দাদুর ঘরে কথাবার্তা সেরে আসার পর তারকবাবু আগত বিশিষ্ট অতিথিদের খাবার ব্যবস্থায় ব্যস্ত ছিলেন। বাবা সেখানে গিয়ে বাবুর হাত ধরে তাকে প্রায় পাকড়াও করে নিয়ে এলেন শ্রাদ্ধবাসরে।
—বাবু এবার আপনি বসুন!
—আমি? কি মুশকিল! শ্রাদ্ধের ভোজ্যদান যে একেবারেই পারিবারিক
অনুষ্ঠান।
—ঠিক কথা, সেই কারণেই তো আপনাকে বসতে বলছি।
—কিন্তু অমলবাবু আমি কোন হিসেবে।
—মা আপনাকে ভাইফোঁটা দিতেন। সেই হিসেবে মতো আপনি মামা
হলেন। আপনি না বসলে মায়ের আত্মা যে শান্তি পাবেন না বাবু ঠাকুমার শ্রাদ্ধের দিনের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই, এ ভাবেই আপনি
ভোজ্যদানে বসতে চাননি। মা আপনাকে বসিয়ে ছিলেন। আজ মা নেই। আপনার কথাআমাকে সুরঙ্গমা মনে করিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১: ভাঙনের জয়গান গাও

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা

কৃতজ্ঞতায় আবেগে বোধহয় প্রৌঢ়ের মানুষটির মোটা চশমার কাচ বারবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। তাই তিনি বাবার কাছে একটু সময় চেয়ে নিয়ে নিজেকে ভিড়ের আড়ালে নিয়ে গেলেন।
শ্রাদ্ধাদি মিটল। এরপর নিয়মভঙ্গের ব্যবস্থাপনা গোটা কলকাতা শহরে অগণিত মানুষকে খাওয়ানোর অভূতপূর্ব প্রস্তুতি, ঠিক যেমনটা বিনয়কান্তি ভেবেছিলেন।—চলবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com।


Skip to content