অলঙ্করণ: প্রচেতা।
অনিরুদ্ধ
পরিস্থিতিটা পুরোপুরি জানার জন্য অনুচিত হলেও তনিমা-অনিরুদ্ধের বিবাহিত জীবনের মধ্যে আমাদের ঢুকতে হবে। ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল অষ্টমঙ্গলার দিন থেকেই। বাঙালি বিয়েতে এই অষ্টমঙ্গলা ব্যাপারটা বিয়ের পরের একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বসুন্ধরা ভিলা থেকে তনিমা-অনিরুদ্ধকে আনতে গিয়ে জানা গেল জরুরি কাজে অনিরুদ্ধ বাড়িতে নেই। সে সরাসরি বসুন্ধরা ভিলায় চলে আসবে। আমাদের বাড়ির নিয়মে বর ও কনেকে আলাদা আলাদা আনা হয়। অষ্টমঙ্গলা, সুবচনী, সত্য নারায়ণ পূজোর পর বরকনের বরের বাড়িতে একত্রে দ্বিরাগমন মানে পুনরাগমন হয়। নতুন জামাইকে তে-রাত্তির মানে ত্রিরাত্রি শ্বশুরবাড়িতে থাকতে হয়। এই সব কিছু বসুন্ধরার মামার বাড়ি, মানে ঢাকার নারায়ণগঞ্জের দাশগুপ্ত বাড়ির নিয়ম। কালক্রমে সেটাই বসুন্ধরা স্বর্ণময়ী মারফত বসুন্ধরা ভিলার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
অনিরুদ্ধকে তিন দিন বসুন্ধরা ভিলাতে দেখে আমার মনে হয়েছিল তাকে যেন জোর করে আটকে রাখা হয়েছে। আসলে এটা ঘটে। আমার পিসেমশাই প্রবোধ সেনগুপ্তের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। সানন্দার বর অর্কপ্রভ দাশগুপ্তের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত বা অর্ক প্রভ দাশগুপ্ত আমার পিসেমশাই চেতলার প্রবোধ সেনগুপ্তর থেকে যথেষ্ট সচ্ছল পরিবারের সন্তান। তবুও বসুন্ধরা ভিলায় রাত্রি বাস না করলে এর প্রাসাদোপম বৈভবের কোন আন্দাজ পাওয়া যায় না। আর সেই সাংঘাতিক বৈভব কারও কারও ভেতরে হয়তো হীনমন্যতা তৈরি করা। পুরো ব্যাপারটাকে সহজভাবে মেনে নিলে কোনও সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু অকারণ তুলনা টানতে গেলেই সমস্যা হয়।
আরও পড়ুন:
দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ৩য় খণ্ড, পর্ব-১৯: অনিরুদ্ধকে নয়, রঘুকেই বিয়ে করতে চায় তনিমা
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল
আমরা যারা বসুন্ধরা ভিলায় থাকি তাদের এই বৈভব সৃষ্টি করার কোনও যোগ্যতা নেই। কিন্তু এই বৈভব উপভোগ করার বিরল সৌভাগ্য দিয়েছেন ঈশ্বর। আমি ব্যক্তিগতভাবে বসুন্ধরা ভিলার জন্যই বিদেশে পড়তে যেতে পেরেছি চাকরি হয়তো বাইরেও পেতাম। কিন্তু সেই রোজগারে এই আয়েশ, এই ঐশ্বর্য অসম্ভব ছিল। আমার বাবা যিনি বসুন্ধরা ভিলার পরিচয়ে পরিচিত হননি রোজগার করেননি তিনিও সদর্পে ঘোষণা করতেন। একজন সাধারণ সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর বসুন্ধরা ভিলার জীবনযাপন নেহাতই সৌভাগ্য। আমার দাদু যিনি এই স্বপ্নের কারিগর, তিনি তো পথে শুয়ে প্রাসাদে পা রেখেছেন। সুতরাং বসুন্ধরা ভিলার আত্মীয়-স্বজনের ক্ষেত্রে এই হীনমন্যতা অকারণ। অপ্রয়োজনীয়।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে
কিন্তু সেদিন বুঝতে পারিনি যে অনিরুদ্ধ কোনও হীনমন্যতায় নয়, বসুন্ধরা ভিলায় মাত্র তিনদিনের জীবনযাপনে অস্থির হয়ে পড়েছিল অনিরুদ্ধ। আসলে অনিরুদ্ধের মতো লোকজন সুযোগসন্ধানী। চন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের মেসার্স সি সেনগুপ্ত অ্যাসোসিয়েটস বহুদিনের ফার্ম। প্রচুর বড় বড় কমার্শিয়াল সংস্থা তাদের ক্লায়েন্ট। বাবার ফার্ম থেকে আলাদা হয়ে অনিরুদ্ধের পক্ষে পেশাদারি হিসেবে নতুন করে জীবনসংগ্রাম সুরু করতে হবে। সেটা কঠিন লড়াই। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ল’ইয়ার সিএ অ্যাক্টর কম্পোজার রাইটার ফুটবলার ক্রিকেটার বা সিঙ্গার যেকোনও পেশাদারই হোন না কেন তাঁর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইটা একইরকম কঠিন।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৫: অরু দত্ত— এক অভিশপ্ত গান্ধর্বী
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?
সবাই লড়ায়ের শেষ পর্যন্ত ধৈর্য রাখতে পারেন না, বা লড়াই শেষ হবার মুখে পৌঁছেও প্রতিষ্ঠা লাভ করা হয় না। ঈশ্বরের আশীর্বাদ ভাগ্যের সহায়তা যোগাযোগ সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। এতো দশটা-পাঁচটার চাকরি নয়, মাস গেলে একটা নিশ্চিত রোজগার। এখানে সাফল্যের ধারাবাহিকাতাটা খুব জরুরি। কারও ক্ষেত্রে সাফল্য আসে কিন্তু স্থায়ী হয় না। কেউ তার পেশাকে বাজি ধরার সাহস দেখাতে পারে না, সাফল্য পেতে জীবনের সব সুখশান্তিকে বলি দেবার মতো মনের জোর সকলের থাকে না। তারা ভয় পায়। যেমন অনিরুদ্ধ। বাবার বিরুদ্ধাচারণ করার সাহস নেই, অথচ পরকীয়া সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৩: এখনও সারেঙ্গিটা বাজছে
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৫: রাজা যযাতির উপাখ্যান—পৌরবদের বর্ণ বিপর্যয় না উত্তরণের কাহিনি?
সুমনা ধর। বড়সড় কোম্পানির হর্তাকর্তা। বিবাহিতা। স্বামী বিদেশে থাকেন, কলকাতায় তাঁর অগাধ সম্পত্তি। কিন্তু নিঃসন্তান। সুমনা বছরে এক-দু’বার বিদেশে গিয়ে দাম্পত্য সেরে আসে। বাকি সময় কলকাতায় স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপন করে। ইচ্ছে করলেই অনিরুদ্ধ সুমনাকে ছেড়ে নতুন বৌ নিয়ে সংসার করতে পারবে না। মাকড়সা যেমন তার শিকারকে লালায় জড়িয়ে রাখে, শিকার যত জাল থেকে বের হতে চায় লালা হাওয়ায় শুকিয়ে আবার নতুন ভাবে জালে জড়ায়। —চলবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।