চিত্র সৌজন্য: প্রচেতা।
সম্পর্ক
নার্স ছুটে এসেছিলেন। রাতে যে ডাক্তার ডিউটিতে থাকেন তিনিও এসেছিলেন। তাঁর মায়ের ঘরে ছুটে গিয়েছিলেন ফুলকাকা। তখন এইডি বা অটোমেটেড এক্সটার্নাল ডিফাব্রিল্লেটার সবে এসেছে। আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। ফুলকাকা বিদেশ থেকে স্পেশাল পারমিশন করিয়ে একটা পোর্টেবল এইডি মেশিন নিয়ে এসেছিলেন। এইডি হল সেই মেশিন যেটা আমরা এখন প্রায়ই সিনেমায় দেখি। বুকে পরিমিত ইলেকট্রিক শক দেওয়ার একটা মেশিন যা দিয়ে আচমকা বন্ধ হয়ে যাওয়া হৃদপিণ্ডের ছন্দ ফিরিয়ে আনা যায়। বেলভিউ থেকে বড় ডাক্তার আসার আগে ফুলকাকা ডিউটিতে থাকা কমবয়সী ডাক্তারটিকে নিয়ে নিজেই চেষ্টা করে দেখলেন। কোনও লাভ হল না। স্বর্ণময়ীর ইহজীবনের ছন্দপতন ঘটে গিয়েছে। সব সম্পর্ক সুতো ছিঁড়ে চলে গিয়েছেন স্বর্ণময়ী।
স্বর্ণময়ীর প্রয়াণের খবর পেয়ে পড়ি কি মরি করে সানন্দা ছুটে এসেছিল। স্বর্ণময়ীর ঘরে ঢুকে খাটের উপর তাঁর নিথর শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল সানন্দা। তারপর স্বর্ণময়ীর কপালে একটা চুমু খেয়ে ডিউটিতে থাকা ডাক্তার ও নার্সকে ঘর থেকে সমস্ত মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ওষুধপত্র সরিয়ে নিতে বলে গেল। ঘরের এসি বাড়িয়ে দিয়ে সে ঘর ছেড়ে গেল সানন্দা। এতক্ষণ সে কিন্তু এতটুকু কাঁদেনি। কিন্তু দাদু বিনয়কান্তির ঘরে গিয়ে আর সে নিজেকে আর সামলাতে পারল না। দাদুকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে অশ্রুপাত করতে লাগল। বিনয়কান্তির চোখও ছলছল করছে, নাতনিকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বিনয় বললেন—
— মাকে বলো স্বর্ণকে লালশাড়িতে রানির মতো সাজিয়ে দিতে। আর বিমল তার মায়ের জন্য বিলেত থেকে যে পারফিউমটা নিয়ে এসেছে সেটা যেন পুরোটাই স্বর্ণর গায়ে ঢেলে দেয়। দামি দামি পারফিউমের খুব শখ ছিল স্বর্ণর।
— মাকে বলো স্বর্ণকে লালশাড়িতে রানির মতো সাজিয়ে দিতে। আর বিমল তার মায়ের জন্য বিলেত থেকে যে পারফিউমটা নিয়ে এসেছে সেটা যেন পুরোটাই স্বর্ণর গায়ে ঢেলে দেয়। দামি দামি পারফিউমের খুব শখ ছিল স্বর্ণর।
আরও পড়ুন:
দুই বাংলার উপন্যাস: ৩য় খণ্ড, পর্ব-১৫: আচমকা সিস্টার সিস্টার বলে চিৎকার শুরু করেন বিনয়কান্তি
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬৫: অরণ্য আদিম
দূরদূরান্তের আত্মীয়স্বজন আসার তেমন কেউ ছিলেন না। বিদেশের যাঁরা রয়েছে, তাদের জন্যে শ্মশানযাত্রা থমকে রাখার কারণ নেই। কীরা কাকিমাকে মা ফোন করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় বাবা কথা বললেন বুবু মানে গৌরবের সঙ্গে। ঠাকুরদালানের সামনে বরফ বোঝাই মেটালবেডে শোয়ানো হয়েছিল স্বর্ণময়ীকে। কাচে ঢাকা একটা বাক্সের ভিতর লালশাড়িতে রানির মতো শুয়েছিলেন স্বর্ণময়ী দত্ত। এয়ারকন্ডিশনড শববাহী গাড়িও তৈরি ছিল। শহরের বিশিষ্টদের জন্য ঘণ্টাখানেক ঠাকুরদালানের সামনে স্বর্ণময়ীকে রাখা হয়েছিল। ফুলমালায় ভরে গিয়েছিল দালানের গোটা চত্বর। সমাজের বিভিন্ন পেশায় যুক্ত শীর্ষস্থানীয় মানুষেরা সস্ত্রীক এসেছিলেন। সরকারি তরফে শিল্পমন্ত্রী নিজে এসেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবও উপস্থিত ছিলেন। এদিকে মিডিয়াকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করা হয়েছিল বাড়ির ভিতরের কোনওরকম কভারেজ না করার জন্য। তাঁরা গেটের বাইরে থেকে বিশিষ্ট মানুষজনের যাওয়া আসা বা তাঁদের শোকবার্তা রেকর্ড করছিল। বাবা নিজে ছোটবড় সমস্ত সংবাদপত্র বা সেই সময়ের গুটিকয়েক নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিক ক্যামেরাম্যানদের তদারকি করছিলেন। সুবিখ্যাত সাহিত্যিক অমলকান্তি দত্ত নিজে তাঁদের বসার ব্যবস্থা বা চা জলের বন্দোবস্ত নজর রাখছেন দেখে তাঁরা অভিভূত।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা: কাঁকড়া, গরান ও গেঁওয়া
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৫: কথার কথা মা নয়—সত্য জননী
একটা সময় বসুন্ধরা ভিলার ভিতরের পার্কিংলট ভর্তি হয়ে গেল। বালিগঞ্জ প্লেসের রাস্তার একদিকে সারি দিয়ে গাড়ি রাখতে হল। ছোটকার তত্ত্বাবধানে আমাদের বাড়ির ড্রাইভাররা সে সব গাড়ি রেখে আসা বা নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছিল। যাঁদের গাড়িতে ডাইভার ছিল তাঁদের গাড়ির যাওয়া আসার ব্যবস্থায় ছিল লোকাল থানা। পুলিশ কমিশনার নিজে সস্ত্রীক এসেছিলেন দাদুর সঙ্গে দেখা করতে ।
দাদুর শরীর নিয়ে আমার মা খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। বার বার খোঁজ নিচ্ছেন তাঁর রোজকার নিয়মের ওষুধপত্র ঠিকমতো পড়েছে কিনা। সানন্দার ফোন বাজছে ঘনঘন। তার সেদিন কোনও জরুরি অপারেশন ছিল না। তবে অনেক রোগীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। কলকাতা শহরের মধ্যে যাঁদের ফোনে যোগাযোগ করা গিয়েছে তাদের সকলকেই ভোরবেলায় সানন্দার ক্লিনিক থেকে এপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল বলে জানিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু দূরদূরান্ত থেকে অনেককেই সানন্দাকে দেখাতে আসেন তাদের কেউ কেউ একদিন আগে কোন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বা হোটেলে এসে থাকেন। সেই সমস্ত রোগীর পরের দিনেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেবার ব্যবস্থা করে এসেছে সানন্দা। শুধু তাই নয় তাঁদের এই হয়রানির জন্য তাঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে দুঃখপ্রকাশ করছে সে। এমনকি আর্থিকভাবে দুর্বল যাঁরা সেরকম কয়েকজনের ক্ষেত্রে এর পরের দিনের চিকিৎসার কোনও পারিশ্রমিক সে নেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
দাদুর শরীর নিয়ে আমার মা খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। বার বার খোঁজ নিচ্ছেন তাঁর রোজকার নিয়মের ওষুধপত্র ঠিকমতো পড়েছে কিনা। সানন্দার ফোন বাজছে ঘনঘন। তার সেদিন কোনও জরুরি অপারেশন ছিল না। তবে অনেক রোগীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। কলকাতা শহরের মধ্যে যাঁদের ফোনে যোগাযোগ করা গিয়েছে তাদের সকলকেই ভোরবেলায় সানন্দার ক্লিনিক থেকে এপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল বলে জানিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু দূরদূরান্ত থেকে অনেককেই সানন্দাকে দেখাতে আসেন তাদের কেউ কেউ একদিন আগে কোন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বা হোটেলে এসে থাকেন। সেই সমস্ত রোগীর পরের দিনেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেবার ব্যবস্থা করে এসেছে সানন্দা। শুধু তাই নয় তাঁদের এই হয়রানির জন্য তাঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে দুঃখপ্রকাশ করছে সে। এমনকি আর্থিকভাবে দুর্বল যাঁরা সেরকম কয়েকজনের ক্ষেত্রে এর পরের দিনের চিকিৎসার কোনও পারিশ্রমিক সে নেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৭: কবির জন্মদিনে প্রিয়জনের উপহার
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২২: সরলাদেবী, এক পণ্ডিত মানুষ
সাধারণ মানুষের প্রতি এই যে শ্রদ্ধা এবং সহানুভূতিবোধ এগুলো বসুন্ধরা ভিলার পারিবারিক শিক্ষা। দাদু, ঠাকুমা, মা-বাবা ফুলকাকা, বড় জ্যাঠামণি, মেজজ্যাঠামণি, পিসিমণি, ন’কাকা, ছোটকা সকলের থেকেই আমরা শিখেছি। আবার এরা সকলে থাকতেও প্রণয়কান্তি এসব কিছুই শেখেনি। এমন একটা পারিবারিক দুর্যোগের দিনে প্রণয়কান্তি ঘর ছেড়ে একবারও দালানে এসে দাঁড়ায়নি। ন’কাকিমা সুজাতাও আসেননি। তবে তিনি আদৌ বসুন্ধরা ভিলায় এখন আছেন কিনা স্পষ্টভাবে সেটাই কেউই জানে না। হুইলচেয়ারে বসে ন’কাকা তরুণকান্তি শিশুর মতো কাঁদছেন। স্বর্ণময়ী বহুদিন অসুস্থ ছিলেন। কোমাতে ছিলেন। এসব জেনেও এ সমাজের অত্যন্ত বিশিষ্ট চিত্রকর তরুণকান্তি দত্ত তাঁর মায়ের চিরকালের মতো চলে যাওয়াটা মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না। তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন তাঁর পুত্রবধূ বাবলি। আমার মায়ের শোকের সময় নেই। এ ভাবেই একটি ঘণ্টা মানুষজনের ভিড়ে কেটে গেল। বিনয়কান্তি তারকবাবুকে কাছে ডাকলেন—
—চলো তারক! তোমার দিদিকে পরপারে পৌঁছে দিয়ে আসি!
এতক্ষণ ধরে সমস্ত কর্মকাণ্ড নিখুঁতভাবে সামলাতে থাকা তারক নিয়োগী বিনয়কান্তির কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়লেন।—চলবে।
—চলো তারক! তোমার দিদিকে পরপারে পৌঁছে দিয়ে আসি!
এতক্ষণ ধরে সমস্ত কর্মকাণ্ড নিখুঁতভাবে সামলাতে থাকা তারক নিয়োগী বিনয়কান্তির কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়লেন।—চলবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।