রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


কোমা। চিত্র সৌজন্য: প্রচেতা।

 

চেতনাশূন্য

মা ফিরে আসার ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যে আমার ঠাকুমা স্বর্ণময়ী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অসুস্থ তিনি ছিলেনই। শয্যাশায়ী ছিলেন বহুদিন। কিন্তু এ বার একটা একটা করে নতুন শারীরিক সমস্যা ধরা পড়তে লাগলো। বিদেশ থেকে রোসিনের বিয়ে এবং শ্যাননের আংটি বদলের মোটাসোটা অ্যালবাম নিয়ে ফিরেছিলেন মা। বাড়ির সকলে উৎসাহ নিয়ে দেখলেন যাকে দেখানোর জন্য মায়ের এত উৎসাহ ছিল তিনি চোখ মেলে দেখলেন বটে কিন্তু তাঁর কোনও প্রতিক্রিয়াই পাওয়া গেল না। তখন থেকেই স্বর্ণময়ীর শরীর আর দিচ্ছে না। মাথা আর নিতে পারছে না।

আমাদেরই সামান্য জ্বরজ্বালি ইনফ্লুয়েঞ্জায় শরীরে মাথায় সারা গায়ে যন্ত্রণা হলে কোনও কিছুই ভালো লাগে না। মনে হয় কবে এই যন্ত্রণা থেকে একটু মুক্তি পাব, একটু ভালো করে খেয়ে দেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোবো। আর যিনি মাসের পর মাস অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন তার মনটা তো আর মন নেই। পাথর হয়ে গিয়েছে। আমাদের দাঁতে ব্যথা চোখে ব্যথা পেটের যন্ত্রণা বা জ্বর হলে সুস্থ হবোই এটা তো নিশ্চিত। তাই আমার মন জানে যে এই অসুস্থতা এই কষ্ট, এ সবই সাময়িক কদিন বাদেই কেটে যাবে আবার আমি সুস্থ হয়ে ছোটাছুটি করবো খাওয়া-দাওয়া করবো সিনেমা দেখব গল্পের বই পড়বো। আড্ডা দেবো তর্ক করব।
কিন্তু যিনি জানেন তাঁর সময় কমে আসছে তাঁর কেমন লাগে! রাত গভীর হলে দূরে দেখা মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিংয়ের নানান ফ্লোরের অসংখ্য কাচের জানলার যেমন একটা একটা করে আলো নেভে তাঁর নিশ্চিতভাবে তেমনি মনের মধ্যে আশার বাতি নিভতে থাকে। অনেকে বলেন চলে যাবার আগে প্রবলভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছে হয়। কারও হয়ত হয়! কারও কারও মনে আবার শারীরিক নিষ্ক্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত একটা মানসিক বৈরাগ্য একটা নিস্পৃহতা জন্ম নেয়।মনে হয় এসবের মধ্যে আমি আর কেন? কী লাভ? স্বর্ণময়ীর হয়তো ঠিক তেমনি হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: ৩য় খণ্ড, পর্ব-১৩: ঝড় সামলে খ্রিস্টান ও বাঙালি হিন্দু মতে বিয়েতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিল ঋতু

চলো যাই ঘুরে আসি: চলো যাই ঘুরে আসি: সুইৎজারল্যান্ডে পাহাড়-ঘেরা বাতিজ্বলা সেই স্টেশনের নামটি ছিল সোল্লেরমিউলি

একসপ্তাহের মধ্যে স্বর্ণময়ী কোমায় চলে গেলেন প্রথমে দিন কয়েক বেলভিউতে নিয়ে গিয়ে রাখা হল কিন্তু কোনও উন্নতির আশা না দেখে বিনয়কান্তি বললেন—
—স্বর্ণকে তোমরা ফিরিয়ে আনো। স্বর্ণ চিরটাকাল একা থাকতে ভয় পায়। ডাক্তারেরা বলছেন কোমা। নিশ্চয়ই ঠিকই বলছেন, কিন্তু এমন তো হতে পারে যে ভিতরে ভিতরে উপলব্ধি করছে কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশ নেই। বুঝতে পারছে যে আমি বাড়িতে নেই বাড়ির লোকেরা আমাকে হাসপাতালে রেখে গিয়েছে। এভাবে স্বর্ণ সারবে না। ওকে ফিরিয়ে আনো। বাড়িতে আরও যন্ত্রপাতি লাগাও। বাড়িটাকে পুরোদস্তুর হাসপাতাল কর। কিন্তু বাড়িতে ওর নিজের ঘরেই থাক। ওর অনুভূতিতে যেন এটা পৌঁছয় যে ও বাড়িতে আছে। আমাদের সকলের সঙ্গে আছে। আর আমারও হাসপাতালের ভিজিটিং আওয়ার্সে এ গিয়ে হাজারো নিয়ম মেনে ওকে দেখতে ভালো লাগে না। আগে যেমন ইচ্ছে হলেই ঘরে গিয়ে ওর পাশে বসে থাকতাম আমি ওকে তেমন দেখতে চাই।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের প্রকৃত ম্যানগ্রোভ ও ম্যানগ্রোভ-সহযোগীরা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪২: শ্রীমার ভাইপো খুদি

দাদু বলার পরে আর কারও কিছু বলার থাকত না, কিন্তু বসুন্ধরা ভিলার একজন ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি আমার মা সুরঙ্গমা।

দাদুর ঘরে দাদুকে একা মা বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন—
—বাবা আপনি বলেছেন আমরা শুনেছি। কিন্তু একটা কথা হঠাৎ শরীর খারাপ হলে বাড়িতে তো আধুনিক হাসপাতালের সব সুযোগ সুবিধা রাখা সম্ভব নয়, তখন অসুস্থ রোগীকে হুটোপাটি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াটা কি—
—সেজবৌমা এতগুলো বছর একসঙ্গে কাটিয়েছি তো চুপ করে শুয়ে থাকলেও আমি মুখটা দেখে বুঝতে পারি ও কি বলতে চাইছে। হাসপাতালে সেদিন ঘুমের মধ্যেই যেন আমায় বলল যে আমায় বাড়ি নিয়ে চলো। এত বছর পাশাপাশি কাছাকাছি আছি তো। তাই হয়তো বুঝতে পারি। আর বড্ড কঠিন হলেও তোমার কাছে সেটা স্বীকার করতে বাধা নেই, স্বর্ণ যদি ঠিক করে সে আমায় ছেড়ে যাবে, তাহলে একেবারে এই বাড়ির থেকেই যাক ছাড়তে হলে তখন তার দেহটাকে ছেড়ে দেবো। হাসপাতাল থেকে কখন চলে যাবে দেখাই হবে না! নিষ্প্রাণ দেহটাকে আবার বসুন্ধরা ভিলায় ফিরিয়ে আনবো কি করে বৌমা!
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!

সেদিন রাতে আমার মা সুরঙ্গমা কিছু খাননি। সারারাত জানলার ধারে চেয়ারে বসে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন। ঘুমোননি। সারারাত ধরে কেঁদেছিলেন। বাবাও সে রাতে নিঃশব্দে রাত জেগেছিলেন।

ঠাকুমা স্বর্ণময়ীকে আবার বসুন্ধরা ভিলায় ফেরত নিয়ে আসা হল। ব্রিস্টল থেকে উড়ে এলেন ফুলকাকা। বহু বহুবছর পর। কীরা কাকিমা আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি রিচমন্ড সার্জিক্যাল হসপিটালে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। ১৯০১ এ নতুন করে শুরু হওয়া এই হাসপাতালের তৈরি হওয়াটা আরো আগে ১৮১০। কিন্তু চিকিৎসার আধুনিকীকরণের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নতি করা হলেও রিচমন্ড সার্জিক্যাল হসপিটালের কাজকর্ম ডাবলিনের সুবিশাল বিখ্যাত বিউমন্ট হসপিটালে চলে যাবার একটা প্রাথমিক কথাবার্তা চলছে। সুতরাং কীরা কাকিমার এই সময়টা আয়ারল্যান্ড ছেড়ে আসা খুব মুশকিল। কলকাতার কাছে সবটা শুনে বাবা কি রাখা তোমাকে বুঝিয়ে বললেন যদি সেরকম প্রয়োজন হয় তোমাকে খবর দেবো।

অবশ্য সরকারিভাবে এই পুরো ব্যাপারটা হতে পাঁচ বছর সময় নিয়েছিল। আর কীরা কাকীমাকেও ছুটে আসতে হয়েছিল বসুন্ধরা ভিলায়। রোসিন আসতে পারেনি ছুটি পায়নি সে। শ্যানন এসেছিল মায়ের সঙ্গে। —চলবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

Skip to content