তমসো মা জ্যোতির্গময়। ছবি: সত্রাগ্নি।
আকাশ আলোয় ভরা
বাঙালি মতে বিয়ের জন্যে কলকাতা থেকে বরের জোড়, বিশেষত প্যাকিং করা বরের সোলার টোপর ও কনের মুকুট, বেনারসি শাড়ি মাথার ভেল বিয়েতে প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি যা সম্ভব প্রায় সব কিছুই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। রোসিনের বেনারসি কীরা কাকিমার জন্য গাদোয়াল সিল্কের শাড়ি, অ্যাডমের ধুতি-পাঞ্জাবি নেওয়া হয়েছিল। এ সব দাদু কিনতে বলেছিলেন মাকে। মা আলাদা করে বর-কনের উপহার ছাড়াও শ্যানন আর অ্যান্ডির জন্যে কাঁথা স্টিচের শাড়ি আর পাঞ্জাবি নিয়েছিলেন। কণের বাবা ফুলকাকার জন্য ধাক্কাপাড় ধুতি নিয়ে গিয়েছিলেন। কলকাতার নামকরা গয়নার দোকান থেকে চিরকাল বসুন্ধরা ভিলার গয়নাগাটি কেনা হয়। সেখান থেকেই অ্যাডম-রোসিনের জন্যে আলাদা করে উপহার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এই বরকণের মতোই আগামী বরকণে শ্যানন আর অ্যান্ডির উপহারও গিয়েছিল। এমনকি কণের জন্যে কাঠের গাছকৌটো সিঁদূরদানী বর অ্যাডমের জন্য কাঁসার দর্পণ। পূর্ববঙ্গের পরিবারে দর্পণ ব্যবহার হয়। এপার বাংলার পরিবারের নিয়মে বরের সর্বক্ষণ জাঁতি রাখার নিয়ম। যেমন পশ্চিমবঙ্গীয় কণেদের ক্ষেত্রে গাছকৌটোর বদলে কাজললতা রাখা হয়।
কাজললতা রমণীর রূপচর্চার অন্যতম অনুষঙ্গ। আবার জাঁতি বা কাজললতা দুটিই সৌভাগ্যের প্রতীক। তেমনি গাছকৌটো আসলে বিবাহিতার সৌভাগ্যচিহ্ন সিঁদুরের আধার। আর দর্পণ বা আয়না। স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি তার অঙ্গীকারের প্রতীক হিসাবে বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় তার হাতে আয়না ধরে রাখে। আয়না স্বামীর প্রতিফলন করে, তার আত্মার প্রতিনিধিত্ব করে। আয়না ভবিষ্যতেরও প্রতিফলন এবং স্বামী আয়না ধারণ করে প্রতীকীভাবে তার স্ত্রীর প্রতি সর্বদা সৎ থাকার এবং নিজের হৃদয়ে একমাত্র স্ত্রীর চিত্র প্রতিফলনের প্রতিশ্রুতি দেয়। তাদের ভবিষ্যৎ সন্তানদের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করে।
রেজিস্টার্ড ব্যাগেজের নির্দিষ্ট ওজন টপকে মোটা টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছিল। কলকাতা থেকে বম্বে হয়ে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্ট ছুঁয়ে সরাসরি আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে। একটা লম্বা সফর। দিল্লি হয়েও যাওয়া যেত। কিন্তু কীরা বম্বে হয়ে টিকিট করেছেন। আর কিছুদিন আগেই সান্তাক্রুজ থেকে আলাদা সাহার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট হয়েছে সেটাও দেখা হবে। তবে যাবার সময়ে যে অবস্থায় ওরা গিয়েছিল তাতে এ সবের কথা ভাবার অবকাশ ছিল না।
রেজিস্টার্ড ব্যাগেজের নির্দিষ্ট ওজন টপকে মোটা টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছিল। কলকাতা থেকে বম্বে হয়ে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্ট ছুঁয়ে সরাসরি আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে। একটা লম্বা সফর। দিল্লি হয়েও যাওয়া যেত। কিন্তু কীরা বম্বে হয়ে টিকিট করেছেন। আর কিছুদিন আগেই সান্তাক্রুজ থেকে আলাদা সাহার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট হয়েছে সেটাও দেখা হবে। তবে যাবার সময়ে যে অবস্থায় ওরা গিয়েছিল তাতে এ সবের কথা ভাবার অবকাশ ছিল না।
আরও পড়ুন:
দুই বাংলার উপন্যাস: ৩য় খণ্ড, ৩য় খণ্ড, পর্ব-১২: কীরা কাকিমার কথা ঋতুর মনে খুব প্রভাব ফেলেছিল
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ
কীরা কাকিমার ভোকাল টনিকে কাজ হয়েছিল। শারীরিক মানসিক ঝড় সামলে ঋতু খ্রিস্টান ও বাঙালি হিন্দু মতে বিয়ের আচার অনুষ্ঠানে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিল। মায়ের কাছে শুনেছি ফুলকাকা এখন দাড়ি রেখেছেন। সাদা ধবধবে পেঁজাতুলোর মতো কোঁচকানো দাড়ি। লম্বা রূপোলি চুল। ধুতি-পাঞ্জাবিতে এক অপূর্ব শান্ত-সৌম্য দেখতে লাগছিল ফুলকাকাকে। দুই মেয়ে দুই জামাই নিয়ে একদিকে শাড়ি-পরা কীরা কাকিমা আর একেবারে অন্যদিকে ফুলকাকা। অনেক বলে দু’ জনকে একসঙ্গে দাঁড় করাতে পারেনি মুমুদাদা-মৃন্ময়কান্তি। ছবিটা ভীষণ অর্থবহ। দু’ জনের সম্পর্ক বা যোগাযোগ বহুদিন বিচ্ছিন্ন। কিন্তু সেতু হল দুই মেয়ে। আর উপলক্ষে তাদের বিয়ে।
কর্মব্যস্ততা মানুষকে বহুদূরে পৌঁছে দেয়। তখন ছবিই একমাত্র আশ্রয়। আজ নয় নানা মাধ্যমে সশরীরে যোগাযোগ করা যায়। কিন্তু অতীতে তেমন ছিল না। ফুলকাকা কীরা কাকীমাকে দূরে সরিয়ে রাখলেও অনেক সময় দেখেছি আমার ঠাকুমা স্বর্ণময়ী ফুলকাকা-কাকীমা রোসিন শ্যাননের ছবি নিয়ে বসে আছেন একদৃষ্টে দেখছেন। কখনও মাকে হয়ত বলেছেন সেজ বউমা! তোমার ফুলঠাকুরপোর কি খবর? আর তোমার ডাক্তার জা কি বলে?
কর্মব্যস্ততা মানুষকে বহুদূরে পৌঁছে দেয়। তখন ছবিই একমাত্র আশ্রয়। আজ নয় নানা মাধ্যমে সশরীরে যোগাযোগ করা যায়। কিন্তু অতীতে তেমন ছিল না। ফুলকাকা কীরা কাকীমাকে দূরে সরিয়ে রাখলেও অনেক সময় দেখেছি আমার ঠাকুমা স্বর্ণময়ী ফুলকাকা-কাকীমা রোসিন শ্যাননের ছবি নিয়ে বসে আছেন একদৃষ্টে দেখছেন। কখনও মাকে হয়ত বলেছেন সেজ বউমা! তোমার ফুলঠাকুরপোর কি খবর? আর তোমার ডাক্তার জা কি বলে?
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪১: মা সারদার অন্তরঙ্গ সেবক শরৎ মহারাজ
চার্চের মতো চেহারার রিচমন্ড সার্জিকাল হসপিটালে ঋতুর সমস্যার সমাধান হল। পাদ্রি এবং এক দক্ষিণ ভারতীয় এক ব্রাহ্মণের তত্ত্বাবধানে রোসিনের বিয়ে হল মালাবদল সিঁদূরদান সমেত। ভাগ্যক্রমে এই দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ শ্রীনিবাসণ কলকাতায় থাকতেন। লেক রোডে। স্টেট ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। অনেক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। নিয়মিত পুজোপাঠ করতেন। বাঙালি বিয়ের প্রায় মোটামুটি সব নিয়মকানুন জানেন। ছেলে বহুবছর লন্ডনে। এয়ারবাস সংস্থার আইটি একজিকিউটিভ। শ্রীনিবাসণ রিটায়ারমেন্টের পর চেন্নাইয়ে অ্যাডেয়ারের পদ্মনাভনগরে বাড়ি করে স্ত্রীকে থাকেন। মেয়ে-জামাই ক্যালিফোর্নিয়ায় কর্মরত। বছরে ছ’মাস লন্ডনে ছেলের কাছে, পরের ছ’ মাস ক্যালিফোর্নিয়ায় মেয়ের কাছে কাটান। তিনি লন্ডনে ছিলেন। কীরা কাকীমার এক পেশেন্টের সূত্রে যোগাযোগ। অগ্নিসাক্ষী রেখে সংস্কৃতে মন্ত্রোচ্চারণ করে তিনি সুষ্ঠুভাবে বিয়ে দিলেন। দাম্পত্য জীবনের সাহচর্য ও বিশ্বস্ততার আলোয় উদ্ভাসিত করলেন এক পুরুষ ও নারীকে।
আরও পড়ুন:
ইতিহাস কথা কও: পূর্বোত্তরে ইতিহাস ঐতিহ্যে হাতি
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা
ফুলকাকা আবার ব্রিস্টলে ফিরে গেলেন মাকে একবার ব্রিস্টল দেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ বারে সেটা আর হল না। মা কথা দিলেন যে, সেজদাকে নিয়ে শ্যাননের বিয়েতে এসে অবশ্যই ব্রিস্টল বেড়িয়ে তবে ফিরবেন।
অ্যান্ডি ভীষণ ব্যস্ত থাকে। তাকেও লন্ডন ফিরতে হল। শ্যানন আরও কয়েকটা দিন একসঙ্গে কাটাল। অ্যাডম আর রোসিনের ছুটি কম তাই প্যারিসে গেলো মধুচন্দ্রিমা করতে।
ফিরে আসার আগের রাতে কীরাকে মা বললেন—
—তুমি না হলে এই বিপদ থেকে কিছুতেই মুক্তি পেতাম না।
কীরা কাকীমা মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন—
—এতো কিছুই না, তোমার জন্যে আমি যেকোনও সিচুয়েশন ফেস করতে পারি। মায়ের জন্য একটা খুব দামি গাউন উপহার দিয়েছিলেন কীরা কাকিমা।
—এটা আমি কলকাতায় কোথায় পরবো কীরা?
—এটা তুমি শ্যাননের বিয়ের রিশেপশনে পরবে। ইয়ু উইল লুক গর্জাস! দাদার জন্যে আমি একটা থ্রি পিস স্যুট করিয়ে দেবো। একটু হাতে সময় নিয়ে এসো।
—বেশ। আসবো।
মা দলবল নিয়ে ঠিকঠাক বসুন্ধরা ভিলা ফিরে এলেন। কিন্তু এতসব ভালো ঘটার পরেও শেষ ভালো হল না।—চলবে।
অ্যান্ডি ভীষণ ব্যস্ত থাকে। তাকেও লন্ডন ফিরতে হল। শ্যানন আরও কয়েকটা দিন একসঙ্গে কাটাল। অ্যাডম আর রোসিনের ছুটি কম তাই প্যারিসে গেলো মধুচন্দ্রিমা করতে।
ফিরে আসার আগের রাতে কীরাকে মা বললেন—
—তুমি না হলে এই বিপদ থেকে কিছুতেই মুক্তি পেতাম না।
কীরা কাকীমা মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন—
—এতো কিছুই না, তোমার জন্যে আমি যেকোনও সিচুয়েশন ফেস করতে পারি। মায়ের জন্য একটা খুব দামি গাউন উপহার দিয়েছিলেন কীরা কাকিমা।
—এটা আমি কলকাতায় কোথায় পরবো কীরা?
—এটা তুমি শ্যাননের বিয়ের রিশেপশনে পরবে। ইয়ু উইল লুক গর্জাস! দাদার জন্যে আমি একটা থ্রি পিস স্যুট করিয়ে দেবো। একটু হাতে সময় নিয়ে এসো।
—বেশ। আসবো।
মা দলবল নিয়ে ঠিকঠাক বসুন্ধরা ভিলা ফিরে এলেন। কিন্তু এতসব ভালো ঘটার পরেও শেষ ভালো হল না।—চলবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।