মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


গতি। ছবি: সত্রাগ্নি।

 

সময়

স্বর্ণময়ী যে এতটা অসুস্থ হয়ে পড়বেন সেটা বিনয়কান্তি আন্দাজ করতে পারেননি। মা বসুন্ধরা চলে যাওয়ার আগে স্বর্ণের শরীর একরকম ছিল। যে কোনও সমস্যা মার সঙ্গে আলোচনা করে সেই সময়ের স্বর্ণময়ী একটা সমাধান বের করে নিতেন, তারপর সেটা বিনয়কান্তিকে ছুঁইয়ে নেওয়া। প্যাশন বা গভীরতর অনুরাগ দিয়ে কোনও কাজ করতে গেলে সেই কর্মস্রোতে ভেসে যেতে হয়। সাগরের তলিয়ে যাবার মতো লীন হয়ে যেতে হয়। বিনয়কান্তির ক্রমশ সেই অবস্থাই হয়েছিল।

বসুন্ধরা গ্রুপ অফ কোম্পানিজ তৈরি হয়ে যাওয়ার পর রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কিছু ক্ষেত্রে গোটা দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের মধ্যে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। দেশের নানান অংশে ছুটে বেড়াতে হতো বিনয়কান্তিকে। বছরে অন্তত একবার দু’বার দেশের বাইরেও যেতে হতো। তাই বসুন্ধরা ভিলা পরিবার এই সব কিছুর দায় ন্যস্ত হয়েছিল স্বর্ণময়ী এবং স্বর্ণময়ী মারফত মা বসুন্ধরার ওপর।

শাশুড়িমা বসুন্ধরার চলে যাওয়াটা স্বর্ণময়ী মানতে পারেননি। মায়ের বয়স হয়েছিল কিন্তু বসুন্ধরা সে ভাবে অসুস্থ ছিলেন না। সন্ধ্যারতির সময় ঠাকুরঘরে স্বর্ণর পিছনে বসে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে আরতি দেখছিলেন। ভয়ংকর বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। খুব বাজ পড়ছিল। বসুন্ধরা ভিলার ওপরেই যেন একটা বাজ পড়ল। প্রচণ্ড শব্দ-আলোর ঝলকানি। আর তারপর স্বর্ণময়ী দেখল বসুন্ধরা মেঝেতেই ঢলে পড়েছেন। সব চিকিৎসাকে ব্যর্থ করে তাদের চিরকালের মতো ছেড়ে চলে গেলেন বসুন্ধরা ভিলার এই পরিবারের প্রাণপ্রতিমা।
মায়ের এই মৃত্যুর পর থেকেই সংসারের সবাইকে নিয়ে স্বর্ণময়ীর আতঙ্ক শুরু হল। তার কিছুদিন পরেই ঘটে গেল পরপর দু’খানা মানসিক আঘাত। বরানগরের বাড়ি থেকে বিনয়কান্তিকে নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে আসার পর সে বাড়ি থেকে টেলিফোনে বিনয়কান্তির শ্বশুরমশাই ব্যারিস্টার আনন্দমোহন বসু’র মৃত্যুসংবাদ এসেছিল। আর তারপর সেই সাংঘাতিক ঘটনা। বিমানদুর্ঘটনায় বিদেশে তনুদাদার আচমকা মৃত্যু। পুরোদস্তুর ব্লাড সুগারের রোগী হয়ে গেলেন স্বর্ণময়ী। এর আগেও নানা সাংসারিক ঘটনায় স্বর্ণময়ীর মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই শান্তিলতার স্বামী প্রবোধকুমার সেনগুপ্তের আত্মহত্যা। শেয়ার মার্কেটে সব হারানোর পর দেনার ভয়ে সৌরভ-গৌরবের বাবা অফিস ছুটির সময় ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি বিল্ডিংয়ের চারতলার খোলা জানলা দিয়ে রাস্তায় লাফ দিয়ে পড়ে মারা যান।

চেতলার মধ্যবিত্ত পরিবারের বেসরকারি অফিসের কর্মী প্রবোধ সেনগুপ্তর সঙ্গে একমাত্র মেয়ে শান্তিলতার বিয়ে দিতে চাননি স্বর্ণময়ী। কিন্তু বিনয়কান্তি চেয়েছিলেন তাঁর জন্যই এই বিয়েটা হয়েছিল। মধ্যবিত্ত চাকুরে প্রবোধ সেনগুপ্তের মধ্যে কি নিজের ছায়া দেখেছিলেন বিনয়কান্তি? ওপার বাংলা থেকে গিরিজাশংকর গুহর পরিবারের আশ্রিত হয়ে মা বসুন্ধরাকে নিয়ে ফড়িয়াপুকুরের গুহবাড়িতে উঠেছিলেন কিশোর বিনয়কান্তি। সেই সবহারা উদ্বাস্তু তাঁর মায়ের নামে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন বসুন্ধরা গ্রুপ অফ কোম্পানিজ। মূলধন ছিল অদম্য জেদ, সততা আর অসীম আত্মবিশ্বাস। সকলকে নিয়ে পরিশ্রমের আগুনে খাদ থেকে সোনা আহরণ করেছেন প্রাসাদ গড়েছেন এই কলকাতা শহরের অধুনা আকর্ষণীয় দক্ষিণ কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে।

কিন্তু একমাত্র মেয়ে শান্তিলতার বিয়ের কিছুদিন পরেই বিনয়কান্তি বুঝেছিলেন সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল না। প্রবোধের মধ্যে ধৈর্য সাহস আত্মবিশ্বাস বা পরিশ্রমের সততা কোনওটাই নেই। আছে চটজলদি বড়লোক হওয়ার আগ্রাসী লোভ আর ফিকির। তাই লোভে পাপ পাপে মৃত্যু ঘটে গেল শেষমেশ। কেউই মুখের ওপর বলে না কিন্তু বিনয়কান্তি জানেন, উপলব্ধি করেন। তিনি যেমন শান্তিলতার দূর্ভাগ্যের জন্যে মনে মনে নিজেকে দায়ী করেন, স্বর্ণময়ী ঠিক তেমনই তরুণকান্তির বৈবাহিক দূর্বিপাকের জন্য নিজে কষ্ট পান। নিয়তির ঘাড়ে দোষ ঠেলে দু’ জনের কেউই নিশ্চিন্ত হতে পারেননি।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: ৩য় খণ্ড, পর্ব-১০: বসুন্ধরার আশীর্বাদ ও স্বর্ণময়ীর উৎসাহে গড়ে উঠেছিল বসুন্ধরা ভিলা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের বাঘের ভবিতব্য

ফুলকাকা ডাঃ বিমলকান্তি দত্ত দিল্লির প্রবাসী বাঙালি কর্নেল সুকদেব বসু রায়ের আধুনিকা মেয়ে সুজাতাকে বিয়ে করতে রাজি হলেন না। এদিকে স্বর্ণময়ী কথা দিয়ে ফেলেছিলেন। বিয়ে থেকে বাঁচতে ফুলকাকা তড়িঘড়ি বিদেশ চলে গেলেন। ন’ভাই চিত্রকর তরুণকান্তির সঙ্গে সুজাতার বিয়ে দেওয়া হল। সম্ভবত মায়ের বিড়ম্বনা বাঁচাতেই নির্বিরোধী তরুণকান্তি এ বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু সে বিয়ে সুখের হয়নি।

পরে আইরিশ ডাক্তার কীরা রায়ানের সঙ্গে ফুলকাকার সম্পর্ক ও পরিণয় কোনওভাবেই মেনে নিতে পারেননি। না মেনে নিতে পারার অনেকগুলো কারণও ছিল। প্রথমত পারিবারিক সংস্কার তো ছিলই, গুরুজনেরা দেখে কথা বলে স্বজাতিতে বিয়ে দেওয়ার একটা অধিকারবোধে ধাক্কা লেগেছিল। দ্বিতীয়ত, কাকা বিয়ে করেছিলেন চার্চে। বসুন্ধরা ভিলা থেকে আত্মীয় বলতে উপস্থিত ছিলেন আমার মা-বাবা। সুরঙ্গমা ও অমলকান্তি। একেবারে একই রকম না হলেও কাছাকাছি ধরনের বিয়ে হয়েছিল গৌরবের। আভেরি গুজরাতি মেয়ে থাকতো বম্বেতে। বিয়ের সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন আমার মা আর বাবা আর তার সঙ্গে গৌরবের মা আমার পিসিমণি শান্তিলতা।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৬: যিনি নিরূপমা তিনিই ‘অনুপমা’

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৭: তিনটি মেয়ের তিনটি কলম!

আশ্চর্যের কথা সেই বিয়েটা কিন্তু আমার ঠাকুমা স্বর্ণময়ী মেনে নিয়েছিলেন। হয়তো অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে সমাজ আধুনিক হয়েছে তাই। আর আরও একটা কারণ হল পাত্রের মা। মামা-মামি বিয়ে হওয়ার আগে কনেকে দেখেছে। আশীর্বাদ করেছে। বিয়ের পর কলকাতায় ফিরে বসুন্ধরা ভিলায় সাড়ম্বরে বৌভাত পালন করা হয়েছে। গৌরব যথেষ্ট আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু তার দাদুভাই আর দিম্মাকে না বলার ক্ষমতা বা শিক্ষা গৌরব পায়নি। বৌভাত বসুন্ধরা ভিলাতে হলেও গৌরবের ফুলশয্যা হয়েছিল নিউ আলিপুরে তার ভাড়া করা বাসাবাড়িতে।
বাবা প্রবোধ সেনগুপ্তের হঠকারিতা বা দাদা সৌরভের পরনির্ভতার কারণে গৌরব নিজে ভীষণ স্পর্শকাতর হয়ে থাকত।

ছোটবেলা কালিম্পঙ-এর স্কুলে হোস্টেলেই কাটিয়েছে। স্কুলজীবন থেকে কখনও একটানা সাতদিন কাটায়নি বসুন্ধরাভিলায়। দুর্গাপুজোর সময়ে কলেজে গিয়ে সেটা আরও কমল। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়ও মেসে থাকত। বলতো পড়াশোনার সুবিধে হয়। তারপর দিল্লি হয়ে লন্ডন।

আসলে তার কোথায় যেন আত্মসম্মানে বাধতো। বহুবার ব্যক্তিগতভাবে কথা প্রসঙ্গে আমার বাবা-মায়ের কাছে বলেছে—
—ঠিক আছে দাদার যদি মনে হয় তার বিপ্লবীজীবনকে ঘরমুখী করে দেওয়ার সব দায় দাদুভাই আর বসুন্ধরা ভিলার তাহলে সে আছে কেন এখানে? ঈশ্বর দুটো করে হাত-পা দিয়েছেন। গ্রামে গিয়ে চাষিদের সঙ্গে কাজ কর ফসল ফলা। মজদুরদের সঙ্গে রাস্তা বানা। বিদ্যে আছে বুদ্ধি আছে। গ্রামের স্কুল-কলেজে গিয়ে ছাত্র পড়া। একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের থাকা খাওয়ার সুবিধে নেবো আর সেই আশ্রয়দাতাকেই গালিগালাজ করবো, এটা তো সুবিধেবাদী দ্বিচারিতা।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৯: ইন্দুমতী ও সুরবালা

ডায়াবিটিস প্রতিরোধের কোনও সহজ উপায় আছে কি? চিন্তা নেই, সমাধান রয়েছে আয়ুর্বেদে

বাবা হয়ত তাকে শান্ত করতে বলতেন—
—সকলে কি তোর মতো বুবু! তোর এবিলিটি তোর কোয়ালিটি কি সকলের মধ্যে থাকবে? হোক না সে আপন ভাই!
—এবিলিটি কোয়ালিটি যাই থাক সেটা তো দাদুভায়ের মতো নয়, আমাকে তো রাতে থাকা আর দু’বেলা খাবার জোগাড় করার জন্য কচিকাঁচাদের টিউশন সেরে দাদুভায়ের মতো তার বাবা কাকাদের ইংরিজি কাগজ পড়ে তর্জমা শোনাতে হতো না। রোদে জলে জাহাজঘাটায় পাট ওজন করাতে হত না। রাতে ফিরে সারাদিনের জমা-খরচের হিসেব লিখে বাড়ির কত্তাকে রামকৃষ্ণ কথামৃত শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে বাড়ির ভাঁড়ার ঘরে ঠান্ডাখাবার মায়ের সঙ্গে ভাগ করে খেতে হত না সেজমামা। আমিও নিশ্চিন্ত হস্টেল জীবন পেয়েছি। ফিজ নিয়ে ভাবতে হয়নি। বইপত্র নিয়ে ভাবতে হয়নি। তাই পুরো সময়টা আমি লেখাপড়ায় কাজে লাগিয়েছি। ভালো রেজাল্ট করাটা পরে জেদ নয়, আমার কম্পালশন ছিল সেজমামা। যাতে স্কলারশিপের টাকায় পড়তে পারি কোনও সাহায্য ছাড়া। এটাই আমার টার্গেট।
যে কোনও গুরুগম্ভীর বিষয়কে এক নিমেষে লঘু করে দেওয়ার ব্যাপারে আমার বাবা সাহিত্যিক অমলকান্তির কোনও জুড়ি ছিল না। বাবা সৌরভকে বলেছিলেন—
—দেখ বুবু তোর মতো একটা ডায়নামিক চরিত্র নিয়ে যদি একটা বায়োস্কোপের গপ্পো লিখি তাহলে তার নায়ক চরিত্রে তোর কাকে পছন্দ? অনেকটা আগে হলে উত্তম বা সৌমিত্র ভাবা যেত, এখন ভিক্টর ব্যানার্জি কেমন হয়! —চলবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

Skip to content