ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
মহাসংকট
ঘরের মধ্যে আচমকা একটা বোমা ফাটলেও সুরঙ্গমা এতখানি আশ্চর্য হতেন না। বসুন্ধরা ভিলা কেন গরিব বড়লোক উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণ সমস্ত পরিবারের মানুষই এরকম একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে বাকরুদ্ধ হয়ে যেতেন। সুরঙ্গমা কয়েক মুহূর্ত কোনও কথা বলতে পারলেন না। প্রাথমিক ধাক্কাটা কোনওক্রমে কাটিয়ে বসে থাকা সানন্দার কাঁধটা খামচে ধরে বললেন—
—তুই কি বলছিস নন্দা। তোর কোথাও ভুল হচ্ছে না তো। প্রথম ডেলিভারির পর মেয়েরা এত সব জানে না। এই সময় পিরিয়ডের গন্ডগোল হওয়া খুব স্বাভাবিক।
—জানি মা। কথাটা শুনে তোমার মাথা কাজ করছে না তাই তুমি ভুলে গিয়েছে যে তোমার মেয়ে একজন গাইনোকোলজিস্ট!
—আরে বাবা ব্রেস্ট ফিড করে। এইতো সবে আট মাস বয়েস বাচ্চার। এখন এসব কি করে হবে?
—মা ব্রেস্ট ফিড করালে কনসিভ করা যায় না এটা একটা মিথ। রেফারেন্স আছে তিন মাসের পরেও বেবি এসে গিয়েছে। আট মাস তো অনেকটা সময়। সাধারণত হসপিটাল থেকেই মাকে এ ব্যাপারে সাবধান করে দেওয়া হয়। সাবধানতা নিতে বলা হয়। কিন্তু যেহেতু বাচ্চার বাবা জন্মের আগেই মারা গিয়েছে তাই আর…
—এর মাঝে প্রায় একটা মাস ঋতু ওর মা-বাবার কাছে ছিল! কি হবে নন্দা? আমি সব সামলাবো কি করে? বাড়িতে এত লোকজন। সারা শহরের বহু মানুষ বসুন্ধরা ভিলর মানুষজনকে চেনেন… তোমার বাবা দাদু ঠাম্মি…বড় ঠাম্মির সম্মান। বাড়ির এত আত্মীয়-কুটুম্ব। তারপর প্রণয় সুজাতা … আমি যে কিছু ভাবতে পারছি না নন্দা ।
—এখন একসঙ্গে এত কিছু ভেবো না মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আমাকে উঠতে হবে মা হসপিটালে ক্রুশিয়াল পেশেন্ট আছে। আমি রাতে ফোনে কথা বলি?
—ফোনে এসব কথা বলো না।
—বেশ আমি কাল আবার আসবো। সকালটা পারবো না। অপারেশন আছে। দুপুরের দিকে। তুমি ঋতুর সঙ্গে কথা বলো।
—আমি?
—হ্যাঁ তুমি! তুমি ছাড়া আর কে মা?
—বেশ। কিন্তু ঋতু তো বাচ্চা নিয়ে বেরিয়েছে তার আজ চেকআপের দিন।
—কার সঙ্গে গিয়েছে?
—কেন মুমু!! মুমুই তো ওকে নিয়ে-টিয়ে যায়।
সানন্দা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মেঝের দিকে তাকিয়ে কি ভাবলো। তারপর মার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল
—আই সি! আসলাম মা।
দরজার দিকে টার্ন করেও একবার ফিরে বলে উঠলো।
—হ্যাঁ, একটা কথা। এসব নিয়ে কারও সঙ্গে কোন কথা বলবে না। নট ইভেন বাবা।
—বাবাকে জানাতেই হবে নন্দা। তুমি ভেবোনা। তোমার বাবার সঙ্গে কথা না বললে আমি কনফিডেন্স পাবো না।
—ওকে। চিন্তা করো না মা। উই উইল ডু সামথিং।
—এখন কি গাড়ি চালিয়ে ফিরবে?
—কি আশ্চর্য! গাড়িটা চালিয়েই তো এলাম। তোমাকে কথাটা জানানোর পর একটু হালকা লাগছে। আসার সময় তো আরও বেশি অস্থির লাগছিল।
—ঠিক আছে সাবধানে যেও।
দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-৫০: কথাটা বলেই সানন্দা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩০: সুন্দরবনে লৌকিক দেবতা ছাওয়াল পীর ও রাখাল ঠাকুর
কফি নিয়ে লাইব্রেরি ঘরে ঢুকে অমলকান্তির সামনের টেবিলে কফি কাপ রেখে সুরঙ্গমা দরজাটা বন্ধ করে দিল।
—যা আন্দাজ করেছিলাম ঠিক তাই!
—কী?
—ওই যে! অসময়ে সক্কালবেলায় সা এসেছিল। সেই সমস্যাটা নিয়েই তো তুমি আমার কাছে এলে। আর সমস্যাটা গোপন রাখতে দরজা বন্ধ করলে।
—বেশ এতই যখন জানো- তখন সাহিত্যিক অমলকান্তি সমস্যাটা কী একটু বলোতো
—বুঝলাম।
—কী বুঝলে।
—সমস্যাটা তোমার মেয়ের নয়। কেন সেটাও বলে দিই? এটা তার হলে তুমি সরাসরি সমস্যায় চলে যেতে। সমস্যাটা কী সেটা জানতে চাইতে না। সেটা খুঁজে বার করতে গেলে সমস্যাটা কার সেটা আগে আমায় জানতে হবে।
—ঋতুর। নন্দা সন্দেহ করছে, ঋতু আবার
—থাক! এ তো গভীর সমস্যা।
—হ্যাঁ, কঠিনও বটে।
—সমাধান খুঁজতে গেলে তোমার ঋতুর সঙ্গে কথা বলা দরকার।
—নন্দাও সে কথা বলছে।
—আমারই তোমেয়ে। ঠিকই বলছে। তবে তুমি একা কথা বলো না।
—না না, তুমি এসবের মধ্যে এক্ষুনি মাঝে তো একটা মাস ঋতু ওর মা-বাবার কাছে ছিল। মুমু মাঝেমধ্যে যেত। বাচ্চাটাকে দেখে আসতো। কি যে করে বসল…
—আমি কি বলেছি যে আমি কথা বলব? কথা তুমিই বলো। কিন্তু একা বোলো না সঙ্গে মুমুকেও ডেকে নিও।
—মুমুকে আবার কেন।
—আরে বাবা এসব ডেলিকেট ব্যাপার। ফট করে আপসেট হয়ে গেলে মুমু সামলাতে পারবে।
সুরঙ্গমা জীবনে কখনও এত ঘাবড়ে যাননি। ডাক্তারখানা থেকে ঋতুরা দুপুরবেলায় ফিরলো, খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু বিকেল করে এলো সুরঙ্গমার ঘরে। মুমু ঋতু দুজনেই খুব চুপচাপ। পরিস্থিতি হালকা করার জন্য সুরঙ্গমা অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে এল।
—ডাক্তারবাবু কি বললেন রে। এত পেট ব্যথায় ছেলে কাঁদে কেন?
ঋতু একবার মুমুকে দেখে নিয়ে বলল—
—খাওয়ানোর মাঝে মাঝে পিঠে ফেলে ঢেকুরটা তুলিয়ে দিতে হবে। আর পেটে ব্যথা হলে অন্য একটা ওষুধ দিয়েছেন।
—ও!
সুরঙ্গমা ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিচ্ছেন দেখে ঋতু এবং মুমু দুজনেই খুব অস্বস্তিতে। এবার যেন সুরঙ্গমার কাছে বিষয়ের কুয়াশা কাটছে।
—ঋতু তোর কোন অসুবিধের জন্য তুই বোধহয় নন্দার ক্লিনিকে গিয়েছিলি।
মুমুর প্রশ্ন।
—নন্দা এসেছিল?
—হ্যাঁ!
এ বার আর নিজেকে সামলাতে পারে না ঋতু। প্রায় কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসে সুরঙ্গমার হাত দুটো ধরে জিজ্ঞেস করে।
—নন্দা কি বলেছে?
সুরঙ্গমা ঋতুকে দুহাতে নিজের বুকে টেনে নিয়ে তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলেন—
—পজিটিভ। ভয় পাসনি। আমি আছি সব ঠিক হয়ে যাবে।
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৬: রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন—মেয়েদের আলোর দিশারী
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৯: খাবারে একদম মশলা নয়?
—আমি ব্লান্ডারটা করেছি সেজোমা, অনেক আগেই আমার ঋতুর ব্যাপারে সবকিছু খুলে বলা উচিত ছিল। কিন্তু তনুর সঙ্গে যে ঋতুর বিয়েটা পনের দিনের মধ্যে ফিক্স হয়ে যাবে আমি ভাবতে পারিনি। আমি তখন নর্থবেঙ্গলে একটা ডকুমেন্টারি করছি। কাজ ফেলে আসতে পারছি না। ঋতু আমাকে বারবার বলেছিল – আমি বলেছিলাম ‘নিয়তি কেন বাধ্যতে’, হয়ত ঈশ্বরের এটাই ইচ্ছে। আমরা দুজনেই আমাদের সামলে নিয়েছিলাম। মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর তনুর চলে যাওয়া ঋতুর একলা হয়ে পড়া। আমার ওপর ওর ডিপেন্ডেসি। চ্যাম্পের আমাকে আঁকড়ে ধরা- আবার সব গোলমাল করে দিল। কিন্তু এমন হবার কথা নয় তবু যা শাস্তি দেবার আমায় দাও। ঋতুর কোন দোষ নেই।
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৭: তীর্থদর্শন
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৪: রামচন্দ্রকে ঘিরে যুগান্তরেও কেন উন্মাদনা? একজন কথকঠাকুরানির সাধারণ সমীক্ষা
এরপরে আর কোন কথা হয়নি। আর কোন কথা হবার ছিলও না। মাথায় একরাশ চিন্তা নিয়ে সুরঙ্গমা ভাবছিল এখন কি করা যায়। হঠাৎ মনে হল তাঁর স্বামী অমলকান্তির কথা। মানুষের মনের কথা লেখেন, বলে কি তিনি মানুষের মনও পড়তে পারেন? অমলকান্তি কেন বললেন মুমুকে সঙ্গে নিয়ে কথা বলতে। এটা কি নিছক কাকতালীয় মিল?
পরদিন যখন সানন্দা এসেছিল, তখন ঋতুকেও ডেকেছিল সুরঙ্গমা। সানন্দা ঋতুকে ভালো করে পরীক্ষা করে জানালো।
—রিপোর্ট দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল এখন কনফার্ম করছি, তোর সেকেন্ড ট্রাই-সেমিস্টার চলছে। মানে চার মাস। মেডিসিনে রিস্ক হয়ে যাবে। নট অ্যাডভাইসেবল।
সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে সুরঙ্গমা বলে ওঠেন—
—চার মাস হলে তো ওর সিমটম্প থেকেই বোঝা উচিত ছিল।
—সবাইয়ের সিমটম্প এক রকম হয় না মা। হয়তো টায়ার্ডনেস গা বমি বমি ভাব নসিয়া কিছু ছিল। সেটা ও ইগনোর করেছে। বুঝতে পারেনি। ওই যে ভুলভাল মিথ- ব্রেস্ট ফিড করালে প্রেগ্ন্যান্সি প্রোটেক্টেড হয়। প্লাস প্রথম দু মাসে কোন ইউজুয়াল সিমটম্প ছিল না। জাস্ট লাস্ট দু’ মাস পিরিয়ড প্রবলেম হতে আমার কাছে গিয়েছিল। আমি রুটিন ব্লাড ইউরিন করতে দিয়েছিলাম। গ্রাভিন্ডেক্স করতেও বলেছিলাম। পজিটিভ হল। ব্লাডেও এইচসিজি পজিটিভ। এগুলো কনফার্মেটরি টেস্ট। ভুল হবার উপায় নেই। ইউকে-আমেরিকায় প্রেগটেস্ট হোমকিট পাওয়া যায়। আমাদের দেশে এখনও অ্যাপ্রুভ্যাল হয়নি। যা করার খুব দ্রুত করতে হবে বেশি সময় নেওয়া যাবে না।
—কিন্তু এখানে এসব কি করে হবে নন্দা?
—আরে কি মুশকিল? আমি জানি সমস্যা আছে, এখানে কনভেনশনালি একটা কনসেন্টের ব্যাপার থাকবে। সেটা কে দেবে? সেটা রেকর্ড হয়ে যাবে। কিন্তু এছাড়া কোন উপায় কি আছে? এখানে করবে নাতো কি বিলেতে গিয়ে করাবে?
সুরঙ্গমার মাথায় বিদ্যুতের মত কথাটা আঘাত করে। তাড়াহুড়ো করে সানন্দাকে জানায় একটু ভেবেচিন্তে তারপরে জানাচ্ছি।
সেদিন রাতেই ট্রাঙ্কল বুক করলো কীরার কাছে। নিজের সব উৎকণ্ঠা উজাড় করে দিল সুরঙ্গমা। তারপরে কাতর গলায় জানালো—
—তুই আমায় বাঁচা কীরা। প্লিজ সেভ আস সেভ আওয়ার ফ্যামিলি। ডু সামথিং।
—ওকে। দিদি আই উইল কল ইউ ব্যাক। তুমি ভীষণ চিন্তা করো না, কীরা ইজ হিয়ার টু হেল্প ইউ। ডোন্ট ওরি দিদি আই উইল কল ইউ টুমোরো বাই দিস টাইম উইথ সাম সলিউশন।
কীরার সঙ্গে কথা বলার পর সুরঙ্গমার অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগছে। কেন জানি না মনে হচ্ছে কীরা সবদিক ভেবেই একটা সমাধান সূত্র বার করবে।—চলবে।