শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


বাবার মতো সেদিন সুবর্ণকান্তি মানুষ দেখতে বেরিয়েছিল। বাঘ সিংহ ধনেশ পাখি জেব্রা বা জিরাফ দেখতে চিড়িয়াখানায় যেতে হয়। মানুষ দেখতে দূরে যাওয়ার দরকার নেই। একটু সময় নিয়ে রাস্তাঘাটে চলে বেড়ালে চায়ের দোকানে বসলে বাসে মিনিবাসে ট্রামে চেপে লম্বা সফর করলে বা কাছে দূরের আত্মীয়-স্বজনের পরিমণ্ডলে বিয়ে, অন্নপ্রাশন জন্মদিন বা শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে একা একা সময় কাটাতে পারলে বহু ধরনের এবং বহু মননের মানুষ দেখাশোনা জানা যায়, তবে কতটুকু চেনা যায় সেটা বলা শক্ত।

কারও বাড়িতে বেড়াতে গেলে কিন্তু চোখ-মুখ পোশাক-আশাক ঘরের সাজসজ্জা আচার-আচরণ সবকিছুর ওপরেই একটা সূক্ষ্ম ফিল্টার চাপানো থাকে। ভালো’র ফিল্টার। সাজসজ্জা কথাবার্তা পরিচ্ছদে ভব্যতা সবকিছু অতিভদ্র সুন্দর করে সাজানো। আলো কম থাকলে যেমন ছবি ভালো স্পষ্ট বোঝা যায় না, এও যেন ঠিক সেই রবি ঠাকুরের কল্পনার রূপসাগরের কথা—
তারে ধরি ধরি মনে করি
ধরতে গেলেম আর পেলাম না,
ধরি ধরি মনে করি,
ধরতে গেলেম আর পেলাম না,
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।
রূপসাগর একটা অলীক আবেগে-ঢাকা জায়গা সেখানে দেখামনের মানুষ কাঁচা সোনার মতোই নিখাদ বা সম্পূর্ণ খাঁটি। সেই সোনা তখনও অলংকার হয়ে ওঠেনি, তাই তাতে খাদ মেশানো হয়নি। কাঁচা টলটলে সেই সোনার শরীরে শুধুই ভালোলাগার ভালোবাসার সুখ মেশানো। যে মূহুর্তে সে সোনা ব্যবহার্য হয়ে অলংকারের চেহারা নিয়ে বাহুল্য হল সাংসারিকতায় ঢুকে পড়ল, তখন আর তা খাদহীন রইল না।

সংসারের কেজো মানুষ হতে গেলে অল্পবিস্তর খাদ যুক্ত হয়ে যায় সন্ন্যাস নিলেও কি খাদহীন হওয়া যায়? কি জানি! চামড়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মাংস শিরা-উপশিরা হাড়ের কঙ্কাল টপকে মানুষের মন দেখতে পাওয়া বড় কঠিন কাজ! সে তিনি জীবনচক্রে চতুরাশ্রমের ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য বানপ্রস্থ বা সন্ন্যাস যে পর্যায়েই থাকুন না কেন। শুধু প্রাক শৈশবের জ্ঞানহীন অবোধ আত্মভোলা জীবনযাপনই বোধহয় প্রকৃতপক্ষে খাদহীন নির্ভেজাল হয়।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., পর্ব-৩০: তরুণকান্তি বসুন্ধরা ভিলা ও মায়ের কথা ভেবে সুজাতাকে বিয়ে করতে রাজি হন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬২: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— সুখদর্শন ও হুড়ো

রাস্তাঘাটে কাজের ব্যস্ততায় চেনা পরিচিত অপরিচিত মানুষের ভিড়ে সামাজিক অনুষ্ঠানে লোকজন নিজেদের সামলাতে পারে না। মানে ওই সময় অসময়ে ভালো’র ফিল্টারটা অজান্তে খুলে যায়, তখন কথায়বার্তায় হাবে-ভাবে ভিতরের প্রকৃত মানুষ বেরিয়ে আসে। যিনি দেখতে জানেন তিনি স্পষ্ট দেখতে পান আড়াল-আবডালহীন সাংসারিক খাদযুক্ত নানান মানুষকে।

তাই সুবর্ণ হাঁটছে বালিগঞ্জ প্লেস থেকে আমির আলি অ্যাভিনিউ দিয়ে একডালিয়া পৌঁছে ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। গন্তব্য গড়িয়াহাট বাজার। বাবা যেতেন। কখনও কখনও গড়িয়াহাট টপকে গোলপার্ক যাদবপুর পর্যন্ত হেঁটে চলে যেতেন, ৮বি বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে চা খেতে খেতে গল্প করতেন। তখন মিডিয়ার প্রথম যুগ । লেখক সাহিত্যিকদের কচিৎ-কদাচিৎ কলকাতা দুরদর্শন ছাড়া এত টিভি চ্যানেলে সোশ্যাল মিডিয়ায়এত বেশি মুখ দেখা যেত না। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবে বাবাকে কেউ খুব একটা চেহারায় চিনতেন না কিন্তু নামে চিনতেন বাংলা ছাড়িয়ে গোটা দেশ। যারা চিনতেন না তাঁরা ভাবতেন রিটায়ার করা আড্ডাবাজ লোক, তাই মানুষজন তাঁর কাছে মন খুলে কথা বলতেন আর বাবা তার লেখার রসদ জোগাড় করতেন তাদের থেকে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: সরলাদেবী—নির্ভীক এক সরস্বতী

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৪: স্বার্থান্বেষীকেও চিনতে শেখায় এই গ্রন্থ

সুবর্ণকান্তি চেষ্টাচরিত্র করে লিখছে বটে কিন্তু তার বাবার মতো অতটা আলাপী নয়, অক্লেশে সাহিত্যিক অমলকান্তির মতো অনর্গল অমন মজার মজার কথা বলতে পারে না সুবর্ণ। কিন্তু ডিএনএতে মানুষের মন পড়তে পারার ক্ষমতাটা পেয়েছে।

সানন্দার বিয়ের পরপরই তার ভাবীবর চিকিৎসা বিজ্ঞানের কৃতীছাত্র অর্কপ্রভকে অন্যরকম মনে হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু বোন নিজে ভালোবেসে তার বিয়ে ঠিক করেছে তাই সুবর্ণ সে নিয়ে মা-বাবাকে কিছুই বলেনি। অথচ সানন্দার ছোটবেলার বন্ধু দিগন্তকে বেশ ভালো লাগতো সুবর্ণর। অর্কর সঙ্গে সানন্দার সমস্যা হবার পর শ্রীতমাকে বলেছিল সুবর্ণ।

—সেদিন চুপ করে না থেকে সানন্দাকে না হলেও মাকে অন্তত বলতে পারতাম। অর্ক ছেলেটাকে আমার সুবিধের মনে হচ্ছে না। বরং দিগন্তকে বেশ ভালো মানায় সা-য়ের সঙ্গে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৭০: জন্মান্তরের সুরসাধক আরডি বর্মন

আসলে সানন্দা এত গুণী মেয়ে অথচ তার সংসারটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল দাদা হিসেবে এটা সুবর্ণ যেন কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না।

একই রকম মনে হয় প্রণয়কান্তিকে দেখে গোটা বসুন্ধরা ভিলার কারও সঙ্গে কোনো মিল নেই তার এরকম বদমেজাজি রুক্ষ। সারাক্ষণ অপমান বোধে জর্জরিত হতে থাকা দুর্বল চরিত্রের কেউ নেই এই বাড়িতে। তবে ঈর্ষাটা হয়তো পেয়েছে তার মা, ন’ কাকিমা সুজাতার কাছ থেকে। তার প্রাকশৈশবের জ্ঞানহীন অবোধ টলটলে কাঁচাসোনার মতো নিখাদ মনের মধ্যে প্রাথমিক ছাপ বা শিক্ষাটা সবচেয়ে কাছের মানুষ তার মায়ের থেকে পেয়েছে প্রণয়।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

অর্ক নিশ্চয়ই এমনভাবেই নীতিহীন স্বেচ্ছাচারী অহংকারী হওয়ার শিক্ষা পেয়েছে। প্রণয়ের জন্ম হয়েছে দিল্লিতে অর্কর কলকাতায়। জন্মের সময় দু’জনে দেশের প্রায় সাড়ে ১৫০০ কিলোমিটার দূরত্বে থাকা দুটি ভিন্ন শহরে থাকা সত্ত্বেও আচারে ব্যবহারে প্রকৃতিতে একই রকম তৈরি হয়েছে। সাহেবরা বলেন বার্ডস অফ আ ফেদার ফ্লক টুগেদার। আমরা ভাতে মাছে বাঙালি। তাই মাছের তুলনা টেনে বলি ঝাঁকের কৈ ঝাঁকে মেশে…।—চলবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়মসা

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content