শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী।

।। বসুন্ধরা ফ্যাশন ।।

শান্তিলতার পরিশ্রম ও উদ্যমে বসুন্ধরা ফ্যাশন উচ্চবিত্ত মহলে পরিচিত হয়ে উঠল। পারিবারিক পরিচিতির সূত্র ধরে শহরের অনেক নামিদামি মানুষ বসুন্ধরা ফ্যাশনে যাতায়াত শুরু করলেন। বিনয়কান্তি এতটা ভাবেনি। সে চেয়েছিল শান্তি স্বাবলম্বী হোক। ও যে বসুন্ধরা ভিলার আশ্রয়ে আছে, এটা ওর মনের ভেতর থেকে যেন মুছে ফেলতে পারে। মানুষ হিসেবে যেন নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়।

সেদিনটা রোববার। মা বসুন্ধরা চলে যাবার পর কাজের চাপ অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে বিনয়কান্তি। এখন ছেলেরাই দায়-দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছে। একবার বিনয়ের হার্টের গোলমাল ধরা পড়ার পর স্বর্ণও আজকাল একটানা বেশিক্ষণ কাজ করতে দেয় না। তার উপর যোগ দিয়েছে পুত্রবধূ সুরঙ্গমা। স্ত্রীর শাসন না মানলেও চলে কিন্তু পুত্রবধূর বারণ অস্বীকার করার উপায় নেই। স্নেহের এই বিনি সুতোর টান অস্বীকার করা শক্ত।

বিনয়ের মাঝে মাঝে মনে হয় বাবার অনুপস্থিতিতে সে বা বসুন্ধরা জীবনযুদ্ধের নানান ঝড়-ঝাপটা সহ্য করেছে। কিন্তু ঝড় এখন শান্ত হয়েছে। উথালপাথাল সাগর পেরিয়ে তারা বসুন্ধরা ভিলার নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে এসে উঠেছে। তারপর থেকে মা চলে যাওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টাই তারা উপভোগ করেছে। ব্যবসায় সাফল্য এসেছে। ছেলেরা দায়িত্ব নিয়েছে। নাতি-নাতনিরা বড় হয়েছে পড়াশোনা করছে। কারও বিয়ে হয়েছে। পুত্রবধূরা এসেছে। তাদের সূত্রে বড় হয়েছে আত্মীয়কুটুম্বের ডালপালা। চিন্ময়কান্তির বিয়ের পর তো বড় নাতি গগনকান্তির পুত্রবধূ মানে বড়পুতির বউ সুপ্রিয়াকে নিয়ে বসুন্ধরার খুশি দেখে বিনয়ের মনে হচ্ছিল, তার বাবা শ্যামসুন্দর হয়তো স্বর্গের কোনও অভিশপ্ত পুরুষ। যাঁর সব কিছু ভোগ করার ছিল কিন্তু তিনি তার স্বাদ পেলেন না। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু স্ত্রী-সন্তানকে ছেড়ে পাহাড়ে জঙ্গলে মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে অসুস্থ হয়ে তারপর মানুষটা চিরকালের মতো চলে গেলেন। সংসার সুখ অপত্যস্নেহ আত্মীয়-স্বজনের বন্ধন থেকে বঞ্চিত হওয়া তো দুর্ভাগ্য বটেই।

শ্যামসুন্দর-এর কোনও বড় ছবি ছিল না। গ্রে স্ট্রিটের বাড়ির ছোট সেই ছবিটাই ছিল, তার নেগেটিভ ছিল না। বসুন্ধরা ভিলায় আসার পর স্বর্ণ’র উদ্যোগে অমুর কোনও এক নামী চিত্রকর বন্ধু সেই ছোট্ট সাদাকালো ছবি থেকে বাবার একটা প্রমাণ সাইজের রঙিন ছবি এঁকেছিল। সেটা এখন নিচের হলঘরে রাখা আছে। মায়ের অনেক ছবি ছিল। তার থেকে বড় ছবি তৈরি করাই যেত। কিন্তু তা না করে বাবার ছবির সঙ্গে মিলিয়ে অমুর সেই চিত্রকর বন্ধুই একই মাপের রঙিন ছবি এঁকে দিয়েছে। বাবার ছবির পাশে নীচের হলঘরে এখন সেই ছবি রাখা আছে। তবে বিনয়কান্তির ঘরে বাবার একটা মাঝারিমাপের আঁকা ছবি আছে। পাশে আছে বসুন্ধরার নানা সময়ের ছবির নানা মুখ। স্বর্ণর কাছে শুনেছে একে নাকি কোলাজ বলে। রবিবার সকালে বিনয়কান্তি মা-বাবার ছবির সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিল।

হঠাৎ ঘরে এসে ঢুকলো তিনজন। শান্তি, বিকাশ আর স্বর্ণময়ী নিজে। বিনয় ভেবেছিল ব্যবসার কোনও সমস্যা। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাই বাড়িতেই আলোচনা করে নিতে চায় এরা। পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বিনয় আয়েশ করে বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল—

‘কী ব্যাপার রোববার সক্কালবেলা তিন তিনজন ডিরেক্টর আমার ঘরে?’
স্বর্ণময়ী আর বিকাশ পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকালো। বিছানার কাছে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো শান্তিলতা। বিনয় দেখলেন শান্তিলতার চোখ ছল ছল করছে।

‘কী হয়েছে মা? কী সমস্যা আমাকে খুলে বল!’
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-৬: ফুলঠাকুরপো-কীরা দুজনেই ভালো মানুষ, কিন্তু একে অপরের পরিপূরক নন

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৪: শিকারীর গোপন চোখ

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের মাছ বৈচিত্র্যের ক্ষতিকারক প্রজাতি হল ক্রোকোডাইল ফিশ

শান্তি’র গলা কাঁপছে। দু’চোখ ছাপিয়ে আসে বাধা না-মানা কান্না। হাতের মধ্যে এতক্ষণ ধরে রাখা একটা বাদামি ছোট্ট খাম সে বিনয়ের সামনে বিছানার উপর রাখে। বিনয় অবাক। দাদাদের মতো কখনও-সখনও বিনয়কান্তিও শান্তিকে ‘বুড়ি’ বলে ডাকত।

‘এটা কী? আর তুই কাঁদছিস কেন বুড়ি? উত্তর আসে বিকাশকান্তির কাছ থেকে।

‘লোন রি-পেমেন্ট চেক বাবা। বসুন্ধরা ফ্যাশনের ফার্স্ট ইনস্টলমেন্ট।

‘মানে? কী বলছিস রে!’

অবাক বিনয়কান্তি বিছানা ছেড়ে নেমে এসে শান্তিকে ধরে।

বুড়ি মেজদাদা এসব কী বলছে?

হ্যাঁ বাবা। আমি পেরেছি। আমরা পেরেছি।

শান্তির বাকি কথা ভেতরের আবেগে কান্নায় মিলেমিশে যায়। স্বর্ণ এসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিতে থাকেন। কষ্টে নয়, আনন্দে মেয়েকে এ ভাবে ভেঙে পড়তে দেখে প্রৌঢ় বিনয়কান্তিও নিজের সামলাতে পারে না।

সব দেখে বিকাশকান্তি বলে ওঠে—
দেখলে তো মা এই জন্যে আমি বুড়িকে বলেছিলাম রি-পেমেন্টের ফার্স্ট ইনস্টলমেন্টটা সোমবার অফিসে নয়, তুই বরং রোববার বাড়িতে দে। আমি জানতাম বুড়ি বাবা দু’জনেই ইমোশনাল হয়ে কান্নাকাটি করবে। নিজেকে সামলা বুড়ি! এতো ইমোশন ভালো নয়।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৯: অষ্টবক্র শরীর— পুরুষের সমাজে পুরুষ শরীর

স্বাদে-আহ্লাদে: ম্যাগি ভালোবাসেন? এই রেসিপি ট্রাই করে দেখেছেন?

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৭: উত্তমের প্রশ্নে মজাদার জবাব ভানুর, হাসির বন্যা বয়ে গেল নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়ো ফ্লোরে

না, বিকাশ! ইমোশনই অসাধ্যসাধন করে। যেকোনও কাজে নিজের সবটুকু দিয়ে নিজের ক্ষমতাকে ছাপিয়ে যেতে এই আবেগটুকু লাগে। ওই যে দেওয়ালে ছবি হয়ে তোমার ঠাম্মি হাসছেন, উনি জানেন। তোমার মা জানেন। আজ বুড়ির এই সাকসেস, এতে মা সবচেয়ে খুশি হতো।

‘ওপর থেকে দেখছো তো মা! তোমার নাতনির কাণ্ডটা দেখছো? তুমি এমনটা সেদিন ভাবতে পেরেছিলে? আমি তো পারিনি।’

সত্যিই বিনয়কান্তি এতটা ভাবেনি। সে স্বপ্নেও ভাবেনি চুক্তিমতো শান্তিলতা বসুন্ধরা গ্রুপকে ঠিক এক বছর সাত মাসের মাথায় তাদের ঋণের প্রথম কিস্তিতে একটা মোটা টাকা শোধ করে দেবে। এমনকি, স্বর্ণ বা বিকাশকান্তিও বিনয়কে ঘুণাক্ষরে কিছু জানতে দেয়নি। বিনয়কান্তি গ্রুপের নানা প্রজেক্ট সরকারি দপ্তরে লাল ফিতের ফাঁস এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকত। ‘বসুন্ধরা ফ্যাশন’ মায়ের কথা রাখতে বানিয়ে দিয়েছিল, সে নিয়ে বিনয়ের বিশেষ কোনও আশা-ভরসা ছিল না। লোনের ব্যাপারে তো কিছু ভাবেইনি। নিজের সন্তানের ক্ষমতাকে গুরুত্ব না দেওয়ার জন্যে নিজেরই খারাপ লাগে বিনয়কান্তির।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৯: মন্দির হয়ে বৌদ্ধবিহার

ত্বকের পরিচর্যায়: দাদের সমস্যায় জেরবার? এই সব মানলে সারবে অসুখ

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৯: জলে হরি, স্থলে হরি, হরিময় এ জগৎ

লেখাটায় এই যে নিজের জবানিতে, খানিকটা বিনয়কান্তির জবানিতে কাহিনির শাখা-প্রশাখা পাতায় পাতায় অনায়াস যাতায়াত সেটা আদৌ গ্রহণযোগ্য হবে কিনা, তা নিয়ে নিজেই ধন্দে ছিল সুবর্ণ। শ্রীতমা বলেছিল ভালো, কিন্তু যতই হোক নিজের বউ। স্বামী যাতে কষ্ট না পায় তাই হয়তো একটু টেনেই বলেছে। তাই একদিন মায়ের ঘরে গিয়ে বেশ খানিকটা পড়ে শোনাল সুবর্ণ। নিজে ফিল্মের নামী অভিনেত্রী। ভালো ভালো পরিচালক-চিত্রনাট্যকারদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আবার কেকের ওপর চেরি টপিংয়ের মতো ডাকসাইটে সাহিত্যিক অমলকান্তি দত্তের ঘরণী। তার মানে অমলকান্তির কলমের রান্নাবাড়ির তেল ঝাল নুন মশলা হিসেবের সবটুকু খবর তার কাছে।

একটানা শোনার পরে মা বলল—
একটা খুব ভয় পাচ্ছিলাম। তুমি তো আগে কখনো লেখোনি সু! লিখতে বসে বাবার লেখার প্রভাব না পড়ে যায়।

কী বুঝলে?
ঝকঝকে তরতরে কিন্তু প্রভাবমুক্ত।

পিসিমণি শান্তিলতা’র এই যে ব্যবসায়িক সাফল্য এতে বাড়ির সকলেই খুশি হলেও আমার ন’কাকিমা সুজাতা যে খুশি হয়নি সে কথা বোধহয় পাঠককে আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। বসুন্ধরা ভিলার সকলের প্রতিই তার রাগ কমেনি, বরং দিনে দিনে তা বেড়েছে। আর অদ্ভূত একটা হীনমন্যতায় ভুগত সুজাতা। —চলবে

ছবি প্রতীকী।

ছবি সৌজন্যে: সত্রাগ্নি
 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৭

“ঈশ্বর অদ্ভুত ম্যাজিক করেন। যার চাহিদা যত বেশি তিনি তার সঙ্গে তত কৃপণতা করেন। ছোটবেলার বিস্কুট বা জিলিপি রেসের মতো সুতোয় বাঁধা প্রাপ্তিটা সামনে ঝুলতে থাকে। নাকের পাশ দিয়ে মুখের পাশ দিয়ে সরে যেতে থাকে।”

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content