শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


নাটকে জীবনযুদ্ধ। জীবনযুদ্ধেনাটক। ছবি: সত্রাগ্নি।

কেকে পুরো নাটক কোনওদিনই দেখে না। খানিক পরে সেও গাড়ি নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল। ক্যানাল ওয়েস্ট রোডের ওপরে কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ। ব্রিজের ওপরে উঠে এসে বিবেকানন্দ রোডে ডানহাত নিয়ে এগিয়ে গেলে সার্কুলার রোড। ডানহাতে মানিকতলা পোস্ট অফিস ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলেই মানিকতলা মোড়। বাঁদিকে সার্কুলার রোড হয়ে সোজা বালিগঞ্জ প্লেসে বসুন্ধরা ভিলার রাস্তা। ক্যানাল ওয়েস্ট রোড থেকে যখন বিবেকানন্দ রোডের দিকে বাঁক নিচ্ছে গাড়ি থেকে দেখল একটি মেয়ে এ ট্যাক্সি-ও-ট্যাক্সিতে ছোটাছুটি করছে। গাড়ির আলোয় মেয়েটির মুখ দেখেই চমকে উঠল।‘আরে এতো শিবানী। কাশী বিশ্বনাথের অভিনয় করে।’ সেদিন শিবানী যখন তড়িঘড়ি হল থেকে বেরিয়ে যায় ঘটনাটা কেকের সামনে ঘটেছিল। কেকে জানত যে ওর মেয়ে অসুস্থ। নিশ্চয়ই ট্যাক্সি পাচ্ছে না। আজকাল রাত্রিবেলা ট্যাক্সি রিফিউজালটা খুব বেড়ে গিয়েছে। শিবানীর সঙ্গে কখনো কথা হয়নি কমলকান্তির। তবুও পরিচিত তো। রাত্রিবেলা। মহিলা। বিপদে পড়েছে। ড্রাইভারকে বলল মেয়েটিকে তুলে নিতে।

প্রাথমিকভাবে একটু না না বললেও শিবানী গাড়িতে উঠে এল। তবে সামনে বসলো। কেকে জানতে চাইল শিবানী কোথায় থাকে? শিবানী জানালো হরিদেবপুরে নস্কর পাড়া রোড। কিন্তু অতদূর যেতে হবে না। ট্রাম ডিপো পর্যন্ত পৌঁছে দিলেই হবে। কেকে জানালো সে বালিগঞ্জের নেমে যাবে তারপর ড্রাইভার তাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। রাস্তায় টুকরো কথাবার্তায় কেকে জানতে পারলো। মেয়ের বয়স ছয়। ক্লাস ওয়ানে পড়ে। নাম ঈশানী। বাড়িতে দিদা মানে শিবানীর মায়ের কাছে থাকে।

—আপনার স্বামীরও বুঝি ফিরতে দেরি হয়? না চাকরিসূত্রে বাইরে।

শিবানী একটু কুন্ঠিত হয়ে বলে—

—না, মানে ওর বাবা।

—ও বুঝেছি। কিছু মনে করবেন না এসব ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার জন্য আমি দুঃখিত।

—আপনি বোধহয় ভুল বুঝেছেন। ঈশানীর বাবা নেই। চার বছর আগে মারা গিয়েছেন। ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট।
এই একটা কথাই সেদিন থেকে ঘটনার অভিমুখ বদলে দিল। কেকে ড্রাইভারকে বালিগঞ্জ প্রেস এ গাড়ি না ঘুরিয়ে সোজা গড়িয়াহাট যাদবপুর হয়ে শিবানীকে নিয়ে তার বাড়ি পৌঁছল। শিবানীর মা এবং মেয়েকে সেই গাড়িতে তুলে শিবানীকে সঙ্গে নিয়ে তার মেয়েকে বাঙ্গুর হাসপাতালে ভরতি করিয়ে দিল। হাসপাতাল থেকেই তারকবাবুকে ফোন করে সরকারি তৎপরতায় শিবানীর মেয়ের চিকিৎসা শুরু হয়ে গেল। দিন দু’য়েক হাসপাতালে কাটিয়ে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরল শিবানী। ডিসচার্জ-এর আগে জানতে পারলো যে তাকে টাকা পয়সা কিছুই দিতে হবে না। সব পেমেন্ট হয়ে গিয়েছে। তারপর থেকে প্রায় সপ্তাহ দু’য়েক কমলকান্তির সঙ্গে কোন দেখা নেই। থিয়েটারের প্রডিউসার বা স্টেজ ম্যানেজারের থেকে কমলকান্তির ফোন নাম্বারও চাইতে পারছে না। বিনোদন জগতের সকলেই সকলের নড়াচড়া নিঃশব্দে লক্ষ্য করে।

এরপর বহুদিন কমলকান্তি থিয়েটারে আসেনি। শিবানী মাঝে মাঝে ভাবতে বসে আশ্চর্য লোক যা হোক। হঠাৎ করে একদিন এল সেদিনই শিবানী বিপদে পড়েছিল। জগদীশ্বরের মতো পাশে দাঁড়িয়ে সমস্ত বিপদ কাটিয়ে ঈশানীকে সুস্থ করিয়ে আবার উধাও। তার মানে শিবানী বিপদে পড়লে আবার তাঁর দেখা মিলবে। বিপদ একটা হল।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৩৫: আজ সারাটা দিন শিবানীর খুবই অস্বস্তিতে কেটেছে

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৫: সুন্দরবনের বিসূচিকা রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ওলাবিবি

বাংলা ছবির একজন ছাপমারা ভিলেন নাটক দেখতে এলেন। নাটকের শেষে গ্রিন রুমে এলেন। নাটকের নায়কনায়িকাকে অভিনন্দন জানানোর সঙ্গে সঙ্গে আলাদা করে শিবানী অভিনয় প্রশংসা করলেন। এই সমস্ত অভিনেতাদের সঙ্গে একচাক মোসায়েব-কাম-বন্ধু থাকে। তাদেরই একজনকে বললেন শিবানীর ফোন নম্বর নিয়ে নিতে। সেই খলনায়ক ছবির কথা ভাবছেন সেই ছবিতে শিবানীকে অভিনয়ের সুযোগ দিতে চান। এখন শিবানী আর পড়াশোনা ছেড়ে সিনেমার নায়িকা হবার স্বপ্ন দেখা চুঁচুড়ার সেই মেয়েটি নয়। তাই সেই খলনায়কের সামনেই বলে দিল।

—আমার বাড়িতে ল্যান্ডফোন নেই। আর কিছু মনে করবেন না শুরুতে সিনেমাতে অভিনয় করার খুব শখ ছিল। তখন বয়স অল্প ছিল। এখন আর নতুন করে কোন ইচ্ছে নেই। আমি আমার নাটক নিয়ে বেশ আছি। সিনেমায় কাজ করবো না।

কোন অভিনেত্রী যে সিনেমার কাজের অফার এভাবে দূরে ঠেলে দিতে পারে এটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না এই খলনায়ক।

—কী বলছেন কথাটার মানে জানেন? ছবিতে এক চিলতে মুখ দেখানোর সুযোগের জন্য রোজ টালিগঞ্জের স্টুডিয়োতে স্টুডিয়োতে কত মেয়ে মাথা খুঁড়ে মরছে আপনি জানেন? আর আমি আপনাকে নিজের অফার করছি আপনি না বলছেন? আমাকে?

—আমি আপনার সম্মানহানি করতে চাইনি। আমার মতামত জানিয়েছি। এতে আপনি দুঃখ পেলে আমায় ক্ষমা করবেন। আমায় ফিরতে হবে রাত হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা দূরে যেতে হবে। আমার ছোট মেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।

—আমাদের সঙ্গে একটা গাড়ি আছে, আমি বলে দিচ্ছি আপনাকে বাড়িতে ছেড়ে দেবে।

—অনেক ধন্যবাদ। তবে সপ্তাহে ৩-৪ দিন তো এই সময়ই হল থেকে
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৮: চল্লিশ পার হলেই নিরামিষ?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা

শিবানী আর দাঁড়ায়নি। কিন্তু সেই খলনায়কের অসভ্যতা বাড়ছিল। সপ্তাহে একবার দু’বার তিনি থিয়েটারে এসে সরাসরি গ্রিন রুমে ঢুকে যেতেন। অন্যদের মধ্যে একটা চাপা ফিসফাস শিবানী লক্ষ্য করছে। সেদিন গোটা রাত ভাবলো শিবানী। সামনে শনিবারে ডাবল শো। একটু আগে আগে থিয়েটারে পৌঁছল। তখনও কেউ আসেনি। স্টেজ ম্যানেজারকে একা পেয়ে গেল।

—বরুণদা একটা উপকার করবেন?

—পাশ চাই? ক’টা?

—না, না, পাশ নয়। একটা ফোন নম্বর চাই?

—কার ফোন নম্বর বলো তো?

—আমাদের প্রডিউসারের বন্ধু কেকে নাকি নাম?

—কেকের সঙ্গে তোমার আলাপ আছে।

—না ঠিক আলাপ নেই। তবে ওই আমার মেয়ে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল না? কিছুদিন আগে? হলে ফোন এসেছিল আপনার কাছে।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি সিন শেষ হতেই চলে গেলে।

—হ্যাঁ, মানে রাস্তায় ট্যাক্সি পাচ্ছিলাম না। অনেক ট্যাক্সি ছিল, যা হয় যেতে চাইছিল না। উনি দেখে গাড়ি থেকে নেমে এসেছিলেন। একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারকে একটু ধমক ধমক দিতে সে নিয়ে যেতে রাজি হল। আমার মেয়ে অসুস্থ শুনে বললেন অসুবিধা হলে বাঙুর হাসপাতালে ওনার পরিচিত এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে উনি ফোনে বলে দেবেন। সেদিন ওনার জন্যই মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে পেরেছিলাম। এখন আমার মায়ের শরীরটা খুব খারাপ। হাসপাতালে বেড পাওয়া তো একটু মুশকিল। একটু চেনা পরিচিত থাকলে সুবিধা হয়। তাই ওনাকে একবার ফোন করে বলে দিতে বলব।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৭: ভিস্তা ডোমে তিস্তার দেশে

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৭: আমি শুধুই উদাস, জলজ্যান্ত লাশ

অনেকগুলো মিথ্যে কথা বলতে হল। উপায় ছিল না। নতুন করে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর শুরু করার সুযোগ দিতে চায় না শিবানী।

দুপুরে শো শেষ হবার পর গ্রিন রুম থেকে স্টেজ এর পেছনের দরজা দিয়ে খোলা জায়গাটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে হঠাৎ দেখল সেই দরজা দিয়েই স্বয়ং কমলকান্তি এগিয়ে আসছেন।

—আপনার মেয়ে কেমন আছে?

—ভালো। আসলে আমি।

—আমার ফোন নম্বর চেয়েছিলেন। আসলে বরুণ আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করছিল যে আমি আপনাকে ফোন নাম্বারটা দেবো কিনা।

—ও!

—না, না, এতে বরুণের কোনও দোষ নেই। নানা ধরনের লোকজন। আছেন সকলকে ফোন নম্বর দেওয়ার মানা আছে। তাই ও আমায় ফোন করে জানতে চেয়েছিল। বলুন কি সমস্যা।

—এখন তো শো শুরু হয়ে যাবে।

—কিন্তু আজ সন্ধ্যেবেল আছে একটা পার্টি আছে। মানে আমার সেখানে নেমন্তন্ন নয় দায়িত্ব। পারিবারিক অনুষ্ঠান। এক কাজ করুন। এই আমার কার্ড। এটা আমাদের অফিসের ঠিকানা আর ফোন নম্বর। আর পাশে রেসিডেন্স লেখা। এই দুটো নম্বরের যেকোনও একটায় ফোন করলে যিনি ফোনটা রিসিভ করবেন তাকে আমার নাম বলবেন।

—এটা তো বাড়ির নম্বর?

—হ্যাঁ, আমাদের বাড়িটায় লোকজন একটু বেশি তো তাই ফোনের এই ব্যবস্থা। একটু রাতের দিকে করবেন। অবশ্য যদি ঘুমিয়ে না পড়েন। আমি অনেকক্ষণ জেগে থাকি।—চলবে।

ছবি: সংগৃহীত।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৩৭

গাড়িটি কমলকান্তিকে নামিয়ে চলে গেল। শিবানীদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা সরু। একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলে অন্য গাড়িটা পাস কাটিয়ে যেতে অসুবিধা হবে। তাই হয়তো গাড়িটা এগিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় রাখতে বললেন ড্রাইভারকে।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content