শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

।।ইন্দ্রজাল।।

খুব কষ্ট করে বম্বেতে দিন কাটিয়েছে শিবানী, কিন্তু সেখানে এই সুযোগ ভাগ করে নিয়ে সকলে মিলে ভালো থাকবার একটা শিক্ষা সে পেয়েছে। বয়স্ক পরিচালক পরিমল নাগ চোখ থেকে চশমাটা খুলে ফেলে ছানি পড়া ঘোলাটে চোখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে শিবানীকে দেখলেন। শিবানীর মাথার পেছনে দেওয়ালে লাগানো শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের ছবির দিকে তাকালেন। তারপর চোখ নামিয়ে নিজের চশমার মোটা ঘনকাচ পাঞ্জাবির খুঁট দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন—

—বাহ! কোথায় শিখলি রে এমন। এতদিন পাবলিক বোর্ড করছি এখানে তো একে অপরকে ল্যাং মারতেই দেখি। হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া মানুষের হাত ধরে ফেলে তাকে টেনে তুলতে তো আগে দেখেছি বলে মনে হয় না।

নাচটা নাট্যগুণের জন্য নয়, বিজ্ঞাপন আর টিকিট বিক্রির স্বার্থে রাখা হয়েছিল। তাই প্রযোজক নাচ বাদ দিতে রাজি হল না। পরিমল নাগ তখন নাট্যকার সন্তু চৌধুরীকে দিয়ে শিবানির জন্যে একটা সুন্দর চরিত্র নাটকের বিরতির পর জুড়ে দিলেন। সুস্থ হয়ে মিত্রা দাস ফিরে এসে নিজের চরিত্রে কাজ শুরু করল। শিবানি বিরতির আগে উত্তেজক নাচের পর তার নতুন চরিত্রে মন মাতানো অভিনয় করতে শুরু করল। শিবানীর মাইনে অনেকটা বেড়ে গেল। সিংহানিয়ার বাড়িতে থাকতে পারার বিনিময়ে এই নাটকে নাচের কাজটা করছিল যৎসামান্য মাইনেতে। একটু একটু করে নাম হতে লাগলো শিবানীর। এক নাটক শেষ হবার পর নতুন নাটক শুরু হয়। নাট্যকার পরিচালক মুখ্য অভিনেতা অভিনেত্রী বদলে যায়। নতুন নাটকে সিংহানিয়া আর পয়সা ঢালেনি। শিবানী সারকারিনা ছেড়ে কাশী বিশ্বনাথে চলে গেল। সিংহানিয়া তখন ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যাপারে আবার বম্বে গেছে। এক রোববার ডাবল শো। রিজেন্ট পার্কের বাড়িতে সিংহানিয়ার বউ আর তার ভাই আচমকা এসে হাজির। বহু বছর আগে চুঁচুড়ার বাড়িতে বুল্টিদার বউ কেয়াবৌদির আচমকা এসে হুজ্জুতি করার কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু সেদিন পিছন থেকে কলকাঠি তো শিবানী নিজেই নেড়েছিল। আজ এই ঘটনার পিছনে কে? এতদিন বাদে হঠাৎ বুল্টিদার কথা মনে পড়ায় খারাপ লাগল। বছর দুয়েক আগে না কি বুল্টিদা মারা গিয়েছে। কেয়া বৌদির একটা টেলারিং শপ আছে । মায়ের কাছে শুনেছে।

কিন্তু এরা দুজন হঠাৎ করে এ বাড়িতে কেন? ইদানিং সিংহানিয়া খুব একটা আসতো না। শনি-রবি ডাবল শো থাকে তাই নাটকে জয়েন করার উইকেন্ডে বেরোবার কোনও সুযোগ নেই। যদিও সিংহানিয়া তাকে বাঁচিয়েছে। বম্বে থেকে নিয়ে এসেছে। কলকাতায় আশ্রয় দিয়েছে। যথেষ্ট উপকার করেছে। স্বার্থ একটা ছিল। নিজের ফাইন্যান্স করা নাটকে যৎসামান্য মূল্যে একজন ডান্সার পাওয়া আর বিনামূল্যে নিজের লালসা চরিতার্থ করা। কিন্তু ইদানীং সিংহানিয়া আসা কমিয়ে দিয়েছিল।

সেই একেবারে শুরুর সময়ে শিবানী জানত তাকে নিয়ে সব বয়েসের হ্যাংলা পুরুষ মানুষের একটা আকর্ষণ আছে। তাদের আদেখলাপনা ছটফটানি সে তারিয়েতারিয়ে উপভোগ করত। অবশ্য সব ছেলেরা নিশ্চয়ই একরকম নয়। যেমন সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ডান্স ডিরেক্টর ইন্দ্র। সে শিবানী কেন কোনও মেয়েকেই বাড়তি উৎসাহ দেখাতো না। তেমন মেয়েদেরও শিবানী দেখেছে। যারা নিজেদের রূপ যৌবন বা আকর্ষণ নিয়ে শিবানীদের মতো এ ভাবে ভাবেই না। তাদের কাছে জীবনের মানেটাই অন্য। যেমন বনু, শিবানীর নিজের বোন বনানী। মায়ের পেটের বোন অথচ একদমই আলাদা। নিজের রূপ, যৌবনের আকর্ষণ চাহিদা এসব ব্যাপারে মাথাই ঘামাতো না। বরঞ্চ এসব আলোচনা অপছন্দ করতো। ক্ষেপে যেত।

তখন শিবানী যেমন নিজের চাহিদা বুঝতো, তেমনই মানুষের চাহিদা উৎসাহ হারিয়ে ফেলাটাও বুঝতে পারতো। বম্বেতে গিয়ে সেটা আরও ভালো করে বুঝতে পেরেছে। কলকাতায় মোটামুটি দেখতে ভালো হিসেবে শিবানী যতটা গুরুত্ব পেত বম্বেতে গিয়ে তার ছিটেফোঁটাও পায়নি। আসলে সারা দেশের সুন্দরীরা বম্বেতে জায়গা পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ক’জনের কপালেই বা সেই সৌভাগ্য জোটে।

সিনেমা-থিয়েটারে দর্শক যেমন অনবরত বৈচিত্র খোঁজে একই অভিনেতা-অভিনেত্রীতে মন ভরে না। সিংহানিয়ার মতো পুরুষমানুষেরও তেমন। শিবানীতে এখন সিংহানিয়ার নেশা কেটে গিয়েছে।

সিংহানিয়ার বউ আর শালা শিবানীকে ২৪ ঘণ্টা সময় দিল, তাও সেটা রবিবার। ডাবল শো তাই । সোমবার দুপুরের মধ্যে ফ্ল্যাটটা খালি করে দিতে হবে। বিকেলে এসে সিংহানিয়ার শালা চাবিটা নিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-৩১: নাম দেখে শিবানী চমকে উঠল!

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১১: সুন্দরবনের ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়

এতদিনের অভ্যেসে শিবানী শিখে গিয়েছে ব্যক্তিগত সুখদুঃখ সংশয় দোটানা উৎকণ্ঠা এসব উড়িয়ে দিয়ে কী করে উইংসের ভেতরে গিয়ে শয়ে শয়ে উদগ্রীব দর্শকের সামনে পাদপ্রদীপের আলোর তলায় গিয়ে দাঁড়াতে হয়। শিবানী অবাক হয়ে দেখেছে জীবন যতবার এরকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ফেলে দেয় ততবার সে আরও ভালো নাচে আরও ভালো অভিনয় করে। সেদিনও করল। মানুষের প্রশংসা হাততালিতে ভরে উঠল প্রেক্ষাগৃহ।

দুপুরের শোয়ের শেষে ব্যাকস্টেজের পিছনের দরজাটা খুলে দেওয়া হতো। তখন আর হলে এসি কোথায়। একটা শোয়ের পর সব দরজা খুলে ফ্যান চালিয়ে দেওয়া হতো। দুপুরের শোয়ের শেষে মেকআপ রুম থেকে হেঁটে বাইরেটা যাবার সময় স্টেজ ম্যানেজার একজনকে শিবানীর সামনে এসে দাঁড় করিয়ে দিল। চমকে উঠলো শিবানী। এক ধাক্কায় বেশ অনেকগুলো বছর পেছনে চলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে ইন্দ্র। টালিগঞ্জের প্রথম ছবির সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ডান্স ডিরেক্টর ইন্দ্র রায়।

—খুব দরকার তোমায়। চলে যেও না। সেকেন্ড শো’টা বসে দেখো।

ম্যাটিনির মতো ইভিনিং শো হাউসফুল ছিল। স্টেজ ম্যানেজারকে বলেকয়ে এক্সট্রা লোহার ফোল্ডিং চেয়ারে ব্যবস্থা হল।

নাটকের শেষে কোনওক্রমে মেকআপ তুলে ইন্দ্রকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বসল শিবানী। ট্যাক্সিভাড়া পেত। আর কলকাতায় নাটক দেখতে আসা দর্শকের কথা ভেবেই ট্যাক্সি নিতে হতো। তবে অন্যদিনে কখনও-সখনও একদিকের দু-তিনজন ভাগাভাগি করে ট্যাক্সি নিত। তিনজনে মিলেমিশে খরচা বাঁচত। আজ শিবানীর সে উপায় নেই।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮: নহবতে সহধর্মিণী সারদা

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৫: পঞ্চম মনস্থির করেন, যাই হয়ে যাক না কেন—এ বার তিনি আশাকে প্রেম নিবেদন করবেনই

ট্যাক্সি ড্রাইভার-এর উৎসুক কান বাঁচিয়ে শিবানী আজ বলে গেল তার কথা। মানিকতলার কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ থেকে দক্ষিণের রিজেন্ট পার্ক পর্যন্ত যতটা বলা যায়। ইন্দ্র থাকত বাবুরাম ঘোষ রোডে। অশোকনগর বাজারের কাছে নামলে ভেতর দিয়ে যাওয়া যায়। আবার সেই রাস্তা ধরেই এগিয়ে গেলে টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োর উল্টোদিক আসা যায়।

এদিন ইন্দ্র একটাও কথা বলেনি। জানলা দিয়ে হাওয়া আসছিল। ইন্দ্রর চুল উড়ছিল। দাড়ি উড়ছিল। রাতের কলকাতার দোকানের নিয়ম আলো বিজ্ঞাপনের লাল সবুজ আলোয় বদলে বদলে যাচ্ছিল ইন্দ্র’র চেহারা। বাইরের অন্ধকার দেখতে দেখতে সে শুনছিল। বহু বহু বছর আগে যেমন স্টুডিয়ো থেকে ট্যাক্সিতে সদসৃটের হোটেলে যাবার সময় শুধু ইন্দ্র বলছিল জানলার দিকে তাকিয়ে একটানা তার কথা শুনছিল শিবানী। ঠিক তেমন।

শিবানী বলেছিল কাল দুপুর বারোটা পর্যন্ত সময় আছে যে করে হোক একটা মাথা গোঁজার আশ্রয় তাকে জোগাড় করে দিতে হবে।ইন্দ্র হ্যাঁ না কিছু বলেনি। চুপ করেছিল। অশোকনগর বাজারের কাজ কাছাকাছি পৌঁছে বলেছিল সামনে নামবো ঠিকানাটা লিখে দাও।

পরদিন ঘড়ি ধরে সকাল ন’টায় ইন্দ্র এসেছিল। কাঁধে একটা ছোট কিট ব্যাগ। বলল—

—ব্যাগ সুটকেস মিলিয়ে ক’টা? বাসনপত্রের জন্য আমি কতগুলো পিচবোর্ডের বাক্স এনেছি।

—বাড়ি ঠিক করে ফেললে? এত তাড়াতাড়ি?

—হুঁ।
আরও পড়ুন:

ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে: বাচ্চা খেতে খেতে টিভি দেখে কিংবা ফোন ঘাঁটে?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৪: গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে ওষুধ খেলে গলে যায়?

ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ব্যাক সুটকেস বাক্স বিছানা গোছানো হল। বারোটার একটু আগেই ট্যাক্সি দেখে এনে তাতে জিনিসপত্র ভরে দিল। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলল কিছু এক্সট্রা দিয়ে দেবে। ট্যাক্সি তুলনায় একটু হয়তো বেশি টেম্পোর তুলনায় মালপত্র একেবারেই কম। ইন্দ্রর ভাবনা সঠিক ছিল কাজ করবার সুবাদে সে সিংহানিয়ার শালাকে চিনত। লোকটা পৌনে বারোটাতেই এসে গেল।

শিবানী বাড়ির ভেতরে ছিল ইন্দ্র ছিল রাস্তায় রিক্সা স্ট্যান্ডের পেছনে একটা চায়ের দোকানে বসে লক্ষ্য করছিল। সিংহানিয়ার শালা বাড়িতে ঢোকার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে শিবানী তার বড় ভ্যানিটি ব্যাগটা নিয়ে নেমে এলো। ততক্ষণে ইন্দ্র ট্যাক্সিতে উঠে পড়েছে। শিবানীকে ইশারা করে তাড়াতাড়ি ট্যাক্সিতে উঠতে বলল। এবারও ইন্দ্রর আন্দাজ সঠিক। শিবানী কোথায় যাচ্ছে সেটা জানবার প্রবল আগ্রহ নিয়ে প্রায় তার পেছনে পেছনেই রাস্তায় নেমে এসেছিল সিংহানিয়ার শালা। ততক্ষণে ওদের ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়েছে। ট্যাক্সির পিছনের কাচ দিয়ে ইন্দ্র দেখতে পেল সিংহানিয়ার শালক এদিক-ওদিক শিবানীকে খুঁজছে।

শিবানী ভাবছে তারা যাচ্ছে কোথায়? ট্যাক্সি সোজা ইন্দ্রপুরী টপকে করুণাময়ী কালী বাড়ির সামনে গিয়ে থামল।—চলবে।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৩৩

জানলার দিকে দেয়াল ঘেঁষে ঘরে ঘুমোচ্ছে ইন্দ্র। মুখ চোখ ঘামে ভেজা। মিয়োনো আলোয় চকচক করছে ইন্দ্র’র ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীর। তবু সে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। মানুষটার লোভ নেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই দাবি নেই সন্দেহ নেই অবিশ্বাস নেই। জীবনের প্রতিটি দিনকে সঙ্গে নিয়ে চলা একজন সাধারন মানুষ।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content