বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি প্রতীকী।

আর কয়েকটা দিন ব্যস — তারপরই শুরু বোর্ডের পরীক্ষা। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা। শুধু কি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট মাসে এই পরীক্ষা আমাদের জীবনে আসে? আমার তো মনে হয় একদমই না। তোমরা যারা এ বছর পরীক্ষায় বসবে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই এক-দেড় বছর আগে থেকেই এই পরীক্ষা যে এক ‘বিশেষ পরীক্ষা’ তার আভাস পেয়েছে। সেই সঙ্গে পরীক্ষা সংক্রান্ত নানাবিধ সতর্কতামূলক উপদেশও পেয়ে গিয়েছ তোমরা। ‘এই সামনের বছর কিন্তু বোর্ডের পরীক্ষা” থেকে “এ বছর তোর বোর্ড”! বড়দের থেকে এমন সাবধান বার্তা নিশ্চয় শুনেছ। আর সেই বোর্ডের পরীক্ষা আজ থেকে মাত্র ন’দিন বাদে।

এই প্রতিবেদনে তোমাদের এই শেষ মুহূর্তের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে কিছু জরুরি বিষয় আলোচনা করলাম। বিষয়গুলি মাথায় রাখলে পরীক্ষার প্রস্তুতিতে খুব কাজে আসবে।
 

সঠিক প্রস্তুতির জন্য চাই রুটিন

আগামীকাল কী পড়াশোনা করবে তার একটা পরিকল্পনা আগের দিন রাতে করে তবেই ঘুমোতে যাও। পরিকল্পনা ছাড়া পড়ার টেবিলে বসলে কিন্তু প্রায় প্রত্যেকটা বিষয়ই দাবি করবে তোমার মনোযোগের। এতে প্রথম ১৫-২০ মিনিট এমনিই নষ্ট হয়ে যায়। সেই সঙ্গে তোমরা বিভ্রান্তও হও। এতে সার্বিকভাবে মনঃসংযোগ এবং প্রেরণা দুটিরই সমস্যা হতে পারে। তাই প্রতিদিনের প্রস্তুতির জন্য একটি রুটিন তৈরি করে পড়াশুনা করো। পড়ার টেবিলে বসে যেন ভাবতে না হয় আমি কী পড়বো। আগে থেকেই মানসিকভাবে যেন তুমি প্রস্তুত থাকো তোমার আজকের রুটিন সম্বন্ধে।

 

পড়ার মধ্যে বৈচিত্র থাকুক

আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু পছন্দের বিষয় থাকে। আর কিছু বিষয় থাকে যেগুলোকে আমরা একটু ভয় পাই। কিন্তু প্রস্তুতির ক্ষেত্রে তো আর বিভেদ করা যাবে না। অনেক সময় দেখা যায় প্রিয় বিষয়গুলোই হয়তো আমরা পড়ছি, আর অপছন্দের বিষয় পড়তে ভালোই লাগে না। অথবা অপছন্দ বা ভয়ের বিষয়গুলোতেই বেশি জোর দিচ্ছি। এতে সমস্যা হল, যে বিষয়গুলো ভালোভাবে পড়া ছিল তার আর রিভিশন হয় না। এমনটা করো না।

পড়ার মধ্যে একটু বৈচিত্র আনতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যেমন ধরো রুটিনের শুরু এবং শেষে প্রিয় বিষয় রাখতে পারো। মাঝের সময়টা যে অধ্যায়গুলো একটু অপছন্দ বা একটু ভয় লাগে, সেগুলোকে রাখতে পারো। এ ভাবে পরিকল্পনা করে পড়লে সার্বিকভাবে প্রস্তুত হতে তোমাকে সাহায্য করবে।
 

প্রস্তুতি পর্বে বিশ্রাম গুরুত্বপূর্ণ

আমরা অনেক সময় মনে করি, পরীক্ষার চূড়ান্ত প্রস্তুতি বা পড়াশোনা একটানা অনেকক্ষণ ধরে করতে হয়। আসলে তা কিন্তু নয়। একটানা অনেকক্ষণ ধরে পড়লে বরং মনসংযোগের ব্যাঘাত ঘটে। সব থেকে ভালো ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার একটা স্লটে পড়াশোনা করে নাও। তাপর পাঁচ মিনিটের জন্য বিশ্রাম নাও। কারণ, বিশ্রামও প্রয়োজন। বিশ্রাম পর্ব মিটলে আবার ফিরে এস তোমার পড়ার টেবিলে।

 

কোন বিষয়ে এগিয়ে, কোনটায় পিছিয়ে তালিকা বানাও

যে বিষয়টি নিয়ে ভয় হচ্ছে অথবা নিজেকে দুর্বল মনে করছো সেই বিষয়টির সিলেবাসের কোন কোন অধ্যায় তুমি খুব ভালো করে তৈরি করেছ আর কোনগুলো নিয়ে তোমার ভয় বা সংশয় আছে—তার একটি তালিকা করে দেখতে পারো। অনেক ক্ষেত্রেই কিছু বিশেষ অধ্যায় সংক্রান্ত দুর্বলতাকে, মন অনেক বড়ো করে আমাদের সামনে রাখে। আর আমরাও ভাবতে শুরু করি, আমরা অপ্রস্তুত।
 

‘কি পয়েন্ট’ লিখে রাখো

শেষ মুহূর্তের চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে রিভিশন নিশ্চয়ই দিচ্ছ। রিভাইস করতে করতে ‘কি পয়েন্ট’গুলো (বিশেষ পয়েন্ট যা মনে থাকলে বাকি অংশটা তুমি লিখে আসতে পারবে) একটা খাতায় লিখে রাখো। হাইলাইট করে রাখতে পারো অথবা ফ্লো চার্ট আকারে লিখে রাখতে পারো। অনেক সময় রিভিশন দিতে দিতেও আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমি যেটা বলছি, সেটা করে দেখ তো কাজ হয় কি না। কোনও প্রশ্ন যখন তুমি রিভিশন দিচ্ছো চোখটা বন্ধ করে দেখো তো ওই প্রশ্নের প্রত্যেকটা অনুচ্ছেদের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো তোমার মনে আছে কিনা। চোখ বন্ধ করে যখন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোকে দেখতে পাচ্ছ তোমার রিভিশন কিন্তু হয়ে গিয়েছে। যদি আটকায় ঠিক সেই জায়গাটা একবার দেখে নাও। এতে কিছুটা একঘেয়েমি কাটতে পারে। সব কোয়েশ্চেন বা সব বিষয়ে এটি হয়তো কার্যকরী নয়, তবে অনেক ক্ষেত্রেই কিন্তু এটা করা যায়।

আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫১: বিয়েশাদির ঠাকুরবাড়ি

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫: মেরুর দিকে পৃথিবী কিছুটা চাপা, তাই এখানে দুটি কাছাকাছি অঞ্চলের মধ্যেও সূর্যালোকের পার্থক্য অনেকটা

হেলদি ডায়েট: কোলেস্টেরলের সমস্যায় ভুগছেন? সুস্থ থাকতে কোন ১০টি ফল খাবেন?

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৬: প্রকৃতি নিয়ে পর্যটন

 

ঘুম প্রস্তুতির অন্যতম সঙ্গী

ঘুম কিন্তু খুব জরুরি। কখনও এটা ভেবো না ঘুমকে বাদ দিয়ে সারাদিন এবং সারারাত পড়লেই পরের দিন পরীক্ষার হলে গিয়ে ঠিকঠাক লিখে আসা যায়। কখনও দুশ্চিন্তাতে বা অতিরিক্ত চিন্তাতেও ঘুম না আসতে পারে। তার মানে ঘুম থেকে উঠে গিয়ে পড়তে বসা নয়। বিশ্রাম নাও কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে। তাই শেষ মুহূর্তের চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে ঘুমও তোমার অন্যতম সহযোগী।
 

এ সময় সমাজ মাধ্যম, টিভি ও অন্যান্য স্ক্রিন টাইম

তৃতীয় পয়েন্টে আলোচনা করেছিলাম ৪৫ থেকে ১ ঘণ্টা টানা পড়ার পর একটা ছোট পাঁচ মিনিটের বিশ্রাম নাও। এই বিরতিতে কী করবে সেটাও একটু ভেবে নিও। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে পারো। পড়ার টেবিলটা ছেড়ে অন্য কোথাও বসতে পারো। কিছু খেয়ে নিতে পারো। আসলে যেটা বলতে চাইছি—সমাজ মাধ্যম, টিভি-সহ সব ধরনের ‘স্ক্রিন টাইম’ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। প্রতিদিনের প্রস্তুতির পড়াশোনা শেষ করে পূর্বনির্ধারিত টাইমে নিশ্চয়ই কিছুক্ষণ রাখতে পারো। এছাড়া যদি কোন পড়াশোনা সংক্রান্ত বিষয় স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে পড়তে হয়, চেষ্টা করো প্রিন্ট বের করে পড়বার। যদি তা সম্ভব না হয়, একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে পড়াশোনার কারণে স্মার্ট ফোন ব্যবহার কর। তবে এই বিষয়ে নিজেকেও দায়িত্ববান হতে হবে। না হলে অযথা তোমার সময় নষ্ট হবে।

আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৬: নাগদেবী কাহন ও দ্বিমুখী লড়াই

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৭: ঈশ্বরের ভালোবাসার সমুদ্রে ডুব দিলে তবেই ভক্তিরূপ মুক্তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের কিছু মূল্যবান মাছ যেগুলো আজ লুপ্তপ্রায়

ষাট পেরিয়ে: বয়সেও আসুক বসন্ত

 

নিজের উপর ভরসা থাকুক

সর্বোপরি নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। বারংবার প্রয়োজনে নিজেকে বলতে হবে, ‘আমি পারব’। তুমি এতদিন অনেক পরীক্ষা দিয়ে এসেছো। নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা থেকে বিরত থেকো। এই শেষ মুহূর্তের চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে প্রি-টেস্টের নম্বর নিয়ে বারবার ভাবনা-চিন্তা না করে বরং কীভাবে তুমি পুরো বিষয়টা ভালোভাবে রিভাইস দিয়ে শেষ করবে, সেই দিকে তোমার মানসিক শক্তি ব্যয় কর।
 

পড়ায় যাতে একঘেয়েমি না আসে খেয়াল রেখো

চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে আমরা অনেক সময় ম্যাপ পয়েন্টিং বা বিজ্ঞানের ডায়াগ্রাম প্রভৃতি চর্চা করি না। তবে আমি বলব, একটানা পড়াশোনায় একঘেয়েমি এলে মাঝে মাঝে এগুলোকে একটু গুরুত্ব দাও। এতে যেমন চর্চা থাকবে, তেমনই একটানা পড়ার একঘেয়েমিও কাটবে।

আরও পড়ুন:

পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১: একটি ক্লান্তিকর বাসযাত্রা এবং…

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৩: মোর সাধের বাসরে ঘটল ‘গৃহ প্রবেশ’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৬: কানে খোল, তেল দেন?

স্বাদে-আহ্লাদে: খুদের টিফিনে কী দেবেন ভেবেই মাথায় হাত? ঝটপট বানিয়ে ফেলুন মুগ ডালের চিল্লা!

 

ভয়-আশঙ্কা দূর করতেই হবে

দেখো, তোমরা নিশ্চয়ই ভিতর ভিতর একটা মানসিক চাপ অনুভব করছ। একটু খেয়াল করে দেখো, কখনও কখনও এই কারণেও হয়তো প্রস্তুতিতে খামতি থেকে যাচ্ছে। এতে আবার সেই দুশ্চিন্তাই বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে দেখতে পাচ্ছ ,এটা একটা দুষ্টচক্রের মতো চলতেই থাকছে।

এসো একবার একটু দেখি তো, এই দুশ্চিন্তা নিয়ে তোমাদের মনোভাব বদলানো যায় কি না। ধরো, সাত দিন বাদে তোমার একটি বিশেষ পরীক্ষা বা কোনও প্রেজেন্টেশন আছে। কিন্তু তুমি কোনও চিন্তাই অনুভব করছ না। এমত অবস্থায় তুমি কি চূড়ান্ত প্রস্তুতির জন্য বা আরও ভালোভাবে ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় করবে? ঠিক কোন কোন জায়গায় ঘাটতি আছে সে বিষয়ে সজাগ হবে? ঠিক কোন কোন অংশ তুমি খুব ভালো করে পারো এমন অনুভব করে আত্মবিশ্বাসী হবে? না, এই মনোভাব কিন্তু তোমার ক্ষমতার সর্বোত্তম সম্ভাবনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আবার এতো চিন্তা হচ্ছে যে, কোনওভাবেই ঘুমের সময় ঘুমোতে পারছো না। আবার প্রস্তুতির সময়ে মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারছ না। এই চিন্তার হাত ধরে প্রচণ্ড ভয়ও করছে আসন্ন পরীক্ষা নিয়েও। এই দুইটি আসলে চূড়ান্ত অবস্থান। যার একপিঠে অতিরিক্ত চিন্তা থেকে পড়তে না পারা, আর অন্য পিঠে একদম চিন্তা নেই। তাই পড়াশোনা প্রস্তুতিতে জাগে উদাসীনতা।

যে অনুভূতি মনের মধ্যে অনর্গল চলছে, তার নাম চিন্তা। তাই চিন্তাবিহীন পরীক্ষা কিন্তু সাংঘাতিক ব্যাপার। এখনই দুশ্চিন্তা নাম দিও না। আসলে এই চিন্তা কিন্তু তোমায় কিছু বলতে চায়। ওকে প্রশ্ন করো। প্রয়োজনে তাকে বারংবার প্রশ্নের উত্তর দাও। ওকে পাল্টা জানান দাও যে, তুমি কীভাবে প্রস্তুত। এ ভাবে তোমার দুশ্চিন্তার জোরালো স্বর কিছুটা প্রশমিত হবে। আর একটুখানি চিন্তা থাকলে তাতে সমস্যার কিছু নেই। বরং অল্প-বিস্তর চিন্তা তোমাকে রোজ নিয়মিত পড়তে সাহায্য করবে। প্রস্তুতির ইচ্ছা বজায় রাখবে।

তোমারা যারা এ বার বোর্ডের পরীক্ষায় বসছ তোমাদের সকলকে আমার আগাম শুভেচ্ছা। পরীক্ষা নির্বিঘ্নে কাটুক। ও হ্যাঁ, তোমাদের যদি পরীক্ষা বা মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে কোনও প্রশ্ন থাকে তাহলে তা লিখে আমাদের ইমেইল করতে পারো। তবে শুধু ছাত্রছাত্রীরা নন, যে কেউই এই বিভাগে মানসিক স্বাস্থ্য এর প্রশ্ন লিখে পাঠাতে পারেন নিঃসঙ্কোচে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সামাধানের পথ আলোচনা করতে।

প্রশ্ন পাঠাবার জন্য ইমেইল: samayupdates.mentalhealth@gmail.com

* ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে (Mental health and awareness) : লেখিকা সাহেলী গঙ্গোপাধ্যায় কনসালট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, আমরি হাসপাতাল, কলকাতা।

Skip to content