সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

বিভিন্ন মনস্তত্ত্বগত সমস্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনযাপন? বুঝে উঠতে পারছেন না কীভাবে বেরিয়ে আসবেন এর থেকে? আপনার যাবতীয় মনস্তত্ত্বগত সমস্যার সমাধান নিয়ে মনের আয়না বিভাগে ধারাবাহিক কলম লিখছেন ক্যালকাটা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ-এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ শর্মিলা সরকার

আপনি কি দীর্ঘদিন ধরে মানসিক অবসাদের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন? নিজের অত্যন্ত পছন্দের কাজেও মনঃসংযোগ করতে পারছেন না? পাশাপাশি রয়েছে শারীরিক ক্লান্তি, ঘুম কমে যাওয়া, খিদে কমে যাওয়ার প্রবণতাও? জানেন কি আপনি ক্লিনিক্যালি সিভিয়ার ডিপ্রেশন বা মানসিক অবসাদের শিকার, যা অবশ্যই চিকিৎসাযোগ্য একটি অসুখ। কিন্তু মনের সমস্যা নিজেই ঠিক করা সম্ভব- আশপাশের মানুষজন বা বাড়ির লোকেদের এই চিরাচরিত ভ্রান্ত ধারণার কারণে তাঁরা নিজদের সমস্যাকে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলা করে থাকেন যার ফল কিন্তু হতে পারে মারাত্মক। এই আলোচনার সূত্রে আপনাদের প্রথমেই আমার তরফ থেকে যে বিষয়টি সম্পর্কে জানানো অবশ্য কর্তব্য সেটি হল—

প্রাথমিকভাবে মানসিক অবসাদের লক্ষণগুলো কী কী?
প্রাথমিকভাবে কোন কোন লক্ষণ থেকে বুঝবেন যে আপনি মানসিক অবসাদের শিকার? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখতে পাই যে মানুষ সাধারণত মন খারাপ এবং ডিপ্রেশন এই দুটো বিষয়কে বদ অভ্যাসবশত এবং ডিপ্রেশন সম্পর্কে যথাযথ ধারণা না থাকার কারণে এক করে ফেলেন। মন খারাপ কিন্তু একেবারেই ডিপ্রেশন নয়। মনখারাপ অত্যন্ত তাৎক্ষণিক একটি ব্যাপার যা আপনার যেকোনও খারাপ অভিজ্ঞতা বা প্রিয়জনের সঙ্গে বিবাদবশত কারণে হয়ে থাকতে পারে আবার কিছুক্ষণ পরে সেই সমস্যা মিটে গিলে কিন্তু আবার মন ভালোও হয়ে যায়। কিন্তু মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশন একটি দীর্ঘকালীন মানসিক অবস্থা যা মানসিক অবসাদের পাশাপাশি আপনার শারীরিক সংগঠনেও প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

ডিপ্রেশনের প্রাথমিক লক্ষণগুলির মধ্যে প্রথমেই যেটি উঠে আসে সেটি হল একটানা চলতে থাকা মানসিক বিষণ্ণতা, আশাহীনতা এবং কাজে অনাগ্রহী হয়ে পড়া। বিশেষ করে যদি দেখেন আপনার খুব পছন্দের কাজ করতেও আর কোনও উৎসাহ খুঁজে পাচ্ছেন না, কোনও কাজই ঠিকমতো গুছিয়ে করে উঠতে পারছেন না তাহলে বুঝবেন আপনি প্রাথমিকভাবে মানসিক অবসাদের শিকার। এই যে জীবনে পছন্দের কাজগুলোতেও আর কোনও আনন্দ খুঁজে না পাওয়া আমাদের ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলা হয় ‘অ্যানহেডোনিয়া’।

এর পাশাপাশি যেকোনও কাজ করতে গিয়েই শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়াও মানসিক অবসাদের আরেকটি লক্ষণ। আমাদের কাছে যাঁরা মানসিক অবসাদের সমস্যা নিয়ে আসেন তাঁদের প্রায় সকলেই বিষণ্ণতা, মানসিক উদ্দামহীনতা এবং অ্যানহেডোনিয়ার পাশাপাশি শারীরিক ক্লান্তির কথাও সমস্যা হিসাবে জানান।

মানসিক অবসাদের কারণে শারীরিক যে প্রতিক্রিয়াগুলি লক্ষণ হিসাবে দেখা যায় সেগুলি হল ঘুম কমে যাওয়া বা সারারাত ধরে বারবার বিক্ষিপ্তভাবে ঘুম ভেঙে যাওয়া এবং খিদে কমে যাওয়া, যার ফলে ওজন হ্রাসের সম্ভাবনা থেকে যায়। পাশাপাশি কোনও কোনও ক্ষেত্রে খিদে এবং ঘুম বেড়ে যেতেও পারে যার ফলে ওজন বাড়ার নিদর্শনও দেখা যায়। এছাড়া যে মানুষটি আগে হয়তো সকাল আটটার সময় ঘুম থেকে উঠতেন তার হয়তো ঘুম ভেঙে যাচ্ছে ভোর পাঁচটায় এবং ঘুম ভাঙার পরই ভীষণরকম বিষণ্ণ লাগছে, দিনের ওই সময়টিতেই হয়তো সবথেকে বেশি বিষণ্ণ লাগছে, এমনটাও কিন্তু মানসিক অবসাদের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষণ। এই লক্ষণটি ভয়ানক। আশাহীনতা এবং কিছু ভালো না লাগা থেকে মৃত্যুর ইচ্ছা এবং ভীষণ সচেতনভাবে আত্মহত্যার আয়োজন করার প্রবণতা দেখা যায় রোগীর মধ্যে যখন মানসিক অবসাদ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। অনেক মানুষই বয়সকালে পৌঁছে একাকিত্বের কারণে, সন্তানদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার ফলে বা যখন একটা বয়সের পর তাঁরা অনুভব করেন যে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যৌবনের উদ্দাম, চঞ্চল দিনগুলি ইচ্ছা থাকলেও আর ফিরে পাবেন না তখন অনেক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে মানসিক অবসাদ দেখা দেয় এবং তার থেকেই আত্মহত্যা প্রবণতা তৈরি হয়, যে প্রবণতা ও প্রচেষ্টা অনেক সময় হয়তো ফলপ্রসূও হয়।

মানসিক অবসাদের সম্ভাব্য কারণগুলি কী কী হতে পারে?
মানসিক অবসাদের কারণ সেইভাবে বিশ্লষণ করলে প্রভূত বিষয় উঠে আসতে পারে। কারণ হিসাবে কিন্তু প্রাথমিকভাবে দেখা যায় যে আমাদের দেশে পুরুষের তুলনায় মহিলাদের ডিপ্রেশনের হার অন্ততপক্ষে দুগুণ। এর অবশ্যই কিছু নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। মহিলাদের মেনোপজের সময় এবং হরমোনাল চেঞ্জেস-এর সময় অনেকেই ডিপ্রেশনের শিকার হন। আমাদের কাছে এমন অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারের গৃহবধূরা আসেন যাঁরা আসেন মূলত গ্যাস, মাথাব্যথা বা গায়ে হাত পায়ে ব্যথার সমস্যা নিয়ে। তাদের ক্ষেত্রে তারা যদি বাড়িতে বলেন যে মানসিক অবসাদের কারণে তাদের কোনও কাজ করতে ইচ্ছা করছে না সেক্ষেত্রে তাদের কথা কেউই গুরুত্বসহকারে শুনবেন না, তারা শারীরিক সমস্যার নিয়েই চিকিৎসা করাতে আসেন এবং বলাই বাহুল্য যে শারীরিক সমস্যাগুলি নিয়ে তারা আসেন তারা সেই সমস্যাগুলি মানসিক অবসাদ থেকেই তৈরি হয় এবং এন্টিডিপ্রেস্যান্ট ওষুধ খেয়েই ভালো থাকেন।

এই সমস্যার পাশাপাশি ভারতীয় মহিলাদের যৌনজীবন থেকেও তৈরি হওয়া হতাশা এবং সেই হতাশা থেকে তৈরি হওয়া মানসিক অবসাদসংক্রান্ত দিকটিও কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । ভারতীয় মহিলাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিয়ে বা গোত্রান্তরের সঙ্গে সঙ্গেই ধরে নেওয়া হয় যে তারা পুরুষটির ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং তার সঙ্গে পুরুষটির ইচ্ছানুযায়ী যেকোনও সময়েই তার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করা যায়। মহিলাটির যৌনতাসংক্রান্ত ইচ্ছা, আবেগ বা সম্মতি কোনও কিছুরই ধার ধারার প্রয়োজন বলে ভারতীয় সমাজে মনে করা হয় না। আজও একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও অধিকাংশ ভারতীয় মহিলাই যৌন অরগ্যাজম সম্পর্কে অনবহিত এবং অনেকেই ম্যারিটাল রেপের শিকার, যেকথা কাউকে মুখ ফুটে বলার পরিসরটুকুও থাকে না। ভারতীয় মহিলাদের মানসিক অবসাদের কারণগুলির মধ্যেও এটি একটি অন্যতম কারণ।

এছাড়াও ছোটবেলায় বাবা, মায়ের মধ্যে অতিরিক্ত অশান্তি অথবা ছোটবেলায় কোনও শারীরিক অত্যাচার বা মানসিকভাবে বাবা, মায়ের সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব তৈরি হলে যার থেকেও কিন্তু পরবর্তীকালে মানসিক অবসাদ আসতে পারে। যে কোনও ধরনের স্ট্রেস-ব্যাক্তিগত সম্পর্কে, কর্মক্ষেত্রে, বা জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রে ওঠা-পড়া থেকেও মানসিক চাপ এমনকি অবসাদ ও গ্রাস করতে পারে। এর পাশাপাশি জিনগত কারণেও অর্থাৎ পরিবারের মধ্যে কারোর মানসিক অবসাদজনিত সমস্যা থাকলে পরবর্তীকালে পরিবারের অন্য কোনও সদস্যের মধ্যে এই অসুখের সম্ভাবনা বেশি।

কীভাবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব?
আপনার কোনও কাছের মানুষ মানসিক অবসাদের শিকার হচ্ছেন এটা বোঝা মাত্র আপনার প্রথম যা কর্তব্য তা হল আপনার কাছের মানুষের সঙ্গে কথা বলা এবং যদি দেখেন যে তিনি মানসিক অবসাদের শিকার হচ্ছেন ধীরে ধীরে তাহলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা আরম্ভ হলে কিন্তু কেবলমাত্র সাইকোথেরাপি এর মাধ্যমেও রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। তবে সমস্যা যদি বাড়ে তাহলে সেক্ষেত্রে ওষুধ খাওয়া কিন্তু আবশ্যক এবং অধিকাংশ মানুষেরই এইজাতীয় ওষুধ নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা আছে,যে এই জাতীয় ওষুধের অনেক সাইড এফেক্টস থাকে বা এই সমস্ত ওষুধ খাওয়ার কারণে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ইত্যাদি। প্রথমত খুব স্পষ্টভাবেই জানিয়ে রাখাটা দরকার যে, এই সমস্ত ওষুধের সাইড এফেক্টস বলতে খুব বেশি হলে গ্যাস, অ্যাসিডিটি, ঘুম ঘুম ভাব, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য র মতো সমস্যা খুব অল্প সময়ের জন্য দেখা দিতে পারে, কিন্তু যথাযথ জীবনচর্যার ফলে কিন্তু এই সমস্ত সমস্যা থেকে মুক্তি মিলতে পারে অচিরেই এবং যে সমস্যা আপনার জন্য প্রাণঘাতী এক রোগে পরিণত হতে পারত সেই রোগ থেকেও আপনি মুক্তি পেতে পারেন অচিরেই।
আপনার মনের প্রকৃত অস্তিত্ব কিন্তু আসলে আপনার মগজে, যার নাগাল পাওয়া আপনার সাধ্যের বাইরে, আর তাই এক সুস্থ জীবনের জন্য সবার আগে কিন্তু প্রয়োজন আপনার মগজটিকে ঠিক সময়মতো খাদ্য, জল, বাতাস এবং যথাযথ পুষ্টি প্রদান করা, তবে আপনার মগজের জন্য যথার্থ পুষ্টির খবর কিন্তু আছে আপনার বিশেষজ্ঞের কাছেই, তাই অন্য কেউ বা অন্য কোনও পন্থা নয় আপনার বিশেষজ্ঞই হয়ে উঠতে পারেন আপনার সুস্থ জীবনের যথার্থ বন্ধু, যথার্থ পথপ্রদর্শক।

Skip to content