রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি সংগৃহীত।

যবক্রীতের কাছ থেকে তাঁর এই বরপ্রাপ্তির সংবাদ শুনে ভরদ্বাজ মোটেও খুশি হলেন না। কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে এর ফলে যবক্রীতের মনে অহংকার তৈরি হবে। আর সেই অহংকারের ফলেই অধীত বেদবিদ্যা বিনষ্ট হবে। পুত্র যবক্রীতকে উদ্দেশ্য পিতা বলে উঠলেন, ‘হে পুত্র! তোমার এই প্রাপ্তি আমার মনে কোনও আনন্দ দেয়নি। এ বিষয়ে তোমায় একটি আখ্যান বলছি। শ্রবণ করো।’ ভরদ্বাজ বলে চলেন প্রাচীন সেই আখ্যান। এই আখ্যানকে দেবতারাও উদাহরণ হিসেবে বলে থাকেন।
প্রাচীনকালে বালধি নামধারী এক মুনি ছিলেন। তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। তাঁর কোনও পুত্র ছিল না। তাই তিনি একসময় অত্যন্ত অস্থিরচিত্ত হয়ে পড়েন। একটি অমর পুত্রের কামনায় তিনি তীব্র তপস্যা আরম্ভ করেন। একসময় তাঁর সেই তপস্যা ফলপ্রসূ হয়। তিনি একটি পুত্রের জনক হন। তবে দেবতারা তাঁর ছেলেকে অমরত্ব দেননি। কারণ মর্ত্যবাসী কখনও অমর্ত্য হতে পারে না। তবে দেবতারা পিতাকে বলেন, কোনও নিদর্শনের মতো তাঁর পুত্রের আয়ু হতে পারে। বালধি তখন বলে ওঠেন—
‘যথেমে পর্বতাঃ শশ্বত্তিষ্ঠন্তি সুরসত্তমাঃ।
অক্ষয়াস্তন্নিমিত্তং মে সুতস্যায়ুর্ভবিষ্যতি।।’
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৬: বেদজ্ঞান লাভের জন্য কঠোর তপস্যায় ব্রতী হলেন যবক্রীত

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৮: ভরত কি ফিরবে শূন্য হাতে?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১: আর্ষ মহাকাব্যের স্রষ্টাদ্বয়ের কথা

পর্বতেরা যেমন চিরকাল অক্ষয় হয়ে রয়েছে, আমার পুত্রের আয়ুও সেইরূপই অক্ষয় হোক। দেবতাদের আশীর্বাদে বালধিমুনির পুত্র জন্ম নিল বটে। তবে সে অত্যন্ত কোপন স্বভাব বিশিষ্ট হল। সে ছোট বয়স থেকেই জেনেছিল যে তার আয়ু পর্বতের মতো। ফলে সে অত্যন্ত গর্বিত ছিল। এই দর্পের ফলে সে সর্বত্যাগী মুনিদের অসম্মান করতে লাগল। কিন্তু প্রতিটি দিন তো আর সমান যায় না। বালধিমুনির অহংকারী পুত্র মেধাবী মুনিদের অনিষ্ট করতে করতে পৃথিবী বিচরণ করতে লাগল। তারপর সে একসময় অসাধারণ জ্ঞানী আর তপস্বী এবং প্রভাবশালী ধনুষাক্ষমুনির কাছে উপস্থিত হল। নিজের স্বভাববশে সে মুনির স্বভাব বুঝতে পারল না। যথারীতি মুনিকেও সে অবজ্ঞা করল এবং তাঁর অপকার করল। তখন ধনুষাক্ষমুনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে মেধাবীকে বলে উঠ্লেন, ‘তুই ভস্ম হ’। কিন্তু মেধাবী ভস্ম হল না। ধনুষাক্ষমুনি প্রথমটায় অবাক হলেও পরে তপোবলে প্রকৃত সত্য জানতে পেরে মেধাবীর আয়ুর নিদর্শন পর্বতগুলোকে মহিষদের সাহায্যে ভেঙে ফেললেন। পর্বতগুলো নষ্ট হতেই মেধাবী তত্ক্ষলণাত মৃত হল। পিতা বালধি মৃতপুত্রের মাথা কোলে রেখে অত্যন্ত বিলাপ করতে লাগলেন। পিতার এমন বিলাপ সকল পণ্ডিতব্যক্তিকে শোকগ্রস্ত করল। সকলে একবাক্যে বললেন, ‘বিধিকে কেই বা খণ্ডাতে পারে! মেধাবীর অতিরিক্ত দর্পই পর্বতের বিনাশের মধ্যে দিয়ে তার বিনাশের কারণ হল।’
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৫: নৌকো উল্টে সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পড়তে যাওয়া বানচাল হতে বসেছিল

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৬: প্রাণী জগতের অন্যতম দায়িত্বশীল বাবা হল ড্রাগন ফিশ

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১০: সাধনা যে সত্যের আশ্রয় পাওয়ার তরে…

এ পর্যন্ত বলে ভরদ্বাজমুনি থামলেন। তারপর সখেদে বলে উঠলেন,‘ হে পুত্র! মুনিপুত্রেরা বর পেলে এমন দর্পশালী হয়ে ওঠে। আমি পিতা। তুমি আমার প্রাণাধিক প্রিয়। আমি কখনোই চাই না তোমার এমনভাবে দর্পের কারণে বিনাশ হোক।’ পিতা আরও সাবধান করলেন, রৈভ্যমুনি আর তাঁর পুত্ররাও অত্যন্ত প্রভাবশালী আর কোপনস্বভাব। মুনি বলেন, ‘হে পুত্র! তুমি এ কথা জেনে সাবধানে থেকো।’ যবক্রীত পিতাকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন, ‘হে পিতঃ! আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনি যেমন আমার কাছে মাননীয়, মহর্ষি রৈভ্যও তেমনি মাননীয়। কারণ তিনি আপনার বন্ধু। আমি তাঁর কোনো অনিষ্ট করব না অথবা তাঁর বিরাগের কারণ হব না।’
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১০: আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন, ইতিহাস এবং কিছু প্রশ্ন

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২: ‘আও টুইস্ট করে’ গানের জন্য পঞ্চমের সঙ্গে শচীনকর্তার বাক্যালাপও বন্ধ ছিল বেশ কিছুদিন

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৫: কালাদেওর কিস্‌সা

যবক্রীত পিতাকে আশ্বস্ত করলেও কার্যকালে দেখা গেল অকুতোভয়ে মুনিদের যথেচ্ছ অনিষ্ট সাধন করছেন তিনি। তারপর এক বৈশাখমাসের দিনে রৈভ্যমুনির আশ্রমে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রবধূকে দেখে তাঁর মনে কামের উদয় হল। মুনি তখন আশ্রমে অনুপস্থিত ছিলেন। যবক্রীত কোনোপ্রকার বিবেচনা না করেই তিনি নিজের কামনা তত্ক্ষিণাত ব্যক্ত করলেন। রৈভ্যমুনির পুত্রবধূ লজ্জায় ভয়ে কাতর হয়ে উঠলেন। দৈবাত সেই সময়ে আশ্রমে মুনি ফিরে এলেন। পুত্রবধূর কাছে যবক্রীতের এমন আচরণের কথা শুনে মুনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। রৈভ্যমুনি স্বভাবক্রোধী ছিলেন। তদুপরি এমন ঘটনা তাঁর ক্রোধকে বাড়িয়ে তুলল। যবক্রীতের বিনাশ ঘনিয়ে এল।
* মহাভারতের আখ্যানমালা (Mahabharater Akhayanmala – Mahabharata) : ড. অদিতি ভট্টাচার্য (Aditi Bhattacharya) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content