বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


চ্যবনসুকন্যার বিবাহের পর বেশ কিছু কাল কেটে গিয়েছে। সেদিন সুকন্যা একলাটি সরোবরে স্নান করছিলেন। দৈবাৎ সেই সরোবরের পাশ দিয়ে অশ্বিনীকুমারেরা যাচ্ছিলেন। সুকন্যাকে দেখে তাঁরা মুগ্ধ হলেন। সরোবরের পাশটিতে এসে সুকন্যাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সুন্দরি! কে তুমি?’ সুকন্যা দেবতাদের দেখে অত্যন্ত লজ্জা পেলেন। মাথা নীচু করেই তিনি বলে উঠলেন নিজের পরিচয়।

অশ্বিনীকুমারেরা আবারও বলে উঠলেন, ‘তোমার মতো এমন সুন্দরী কন্যাকে তোমার পিতা কেনই বা বৃদ্ধের হাতে তুলে দিয়েছেন? তুমিই বা কীভাবে বৃদ্ধ পতিকে স্বীকার করে নিয়ে সংসারজীবন যাপন করছো। তুমি সুন্দরী। সামনে তোমার দীর্ঘ জীবন ও যৌবন। তুমি বরং আমাদের দু’ জনের একজনকে পতিত্বে বরণ করে নাও। কারণ, এই বনের জীবন, অতি দীনহীন বসন কিংবা কামভোগশূন্য পতি কোনোটিই তোমাকে শোভা পায় না।’ সুকন্যা অপরূপরূপবান দুই দেবতার কথা শুনে সাময়িকভাবে বিহ্বল হয়ে পড়েন। পরমুহূর্তেই আত্মসংবরণ করে বলে ওঠেন, ‘হে দেবদ্বয়! চ্যবনমুনি বৃদ্ধ অথবা যেমনই হোন না কেন তিনি আমার পতি। তিনি আমার আশ্রয়। আর আমি আমার পতির প্রতি অনুরক্ত।’
দেবতারা বলে ওঠেন, ‘কল্যাণি! তুমি হয়তো আমাদের পরিচয় জানো না। আমরা দেবচিকিত্সক। আমরা তোমার পতিকে যৌবন ফিরিয়ে দেব। কিন্তু তাতে একটি শর্ত আছে। তোমার পতি আর আমরা দু’ জন এক সারিতে দাঁড়াব। তুমি যদি নিজের পতিকে চিনে নিতে পারো তবে তুমি আবারো নিজের পতির কাছে ফিরে যেতে পারবে। যদি তোমার চিনে নেওয়ায় কোনও ভুল হয় তবে যাকে পতি বলে ভুল করবে তাকেই পতিরূপে বরণ করতে হবে।’

সুকন্যা এই প্রস্তাবে রাজি হলেন। চ্যবনমুনির যৌবন ফিরে পাওয়ার জন্য এটুকু ঝুঁকি নিতে তিনি রাজি। সব শুনে চ্যবনও সম্মত হলেন এই প্রস্তাবে। এরপর রূপ আর যৌবন চেয়ে চ্যবনমুনি অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের সঙ্গে সরোবরের জলে ডুব দিলেন। তাঁরা তিনজনে যখন উঠলেন, দেখা গেল, দেবচিকিত্সকদের অলৌকিক ইচ্ছায় তিনজনেই সমান বয়স্ক আর রূপবিশিষ্ট। এমনকি তাঁদের পরনেও একই রকম বস্ত্র আর অলংকার। তারপর তাঁরা সকলে মিলে একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘তুমি আমাদের মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে পতিরূপে বরণ করো।’ চ্যবনমুনি যৌবন ফিরে পেয়ে পুরো ঘটনা ভীষণভাবে উপভোগ করতে লাগলেন।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৮: অবশেষে বৃদ্ধ চ্যবনমুনি শর্যাতিরাজার কন্যার পাণিপ্রার্থী হলেন

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-১: চলার পথে খানিক ভণিতা

সকলেই ভাবছেন, সুকন্যা কি আদৌ নিজের পতিকে চিনতে পারবেন? একসময় তিনজনের আশংকাই ভুল বলে প্রমাণিত হল। সুকন্যা বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সকলের সমান বয়স আর রূপযৌবন সত্ত্বেও নিজের পতির চোখের দিকে তাকিয়ে প্রেমপূর্ণ দৃষ্টি চিনতে ভুল করলেন না।

চ্যবনসুকন্যার মিলন হল। এ যেন আবার নতুন করে শুরু হওয়া কোন গল্পকথা। এদিকে চ্যবনমুনি পুনর্যৌবন পেয়ে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের প্রতি অত্যন্ত তু্ষ্ট হলেন। দেবতাদের চিকিত্সক ছিলেন অশ্বিনীকুমারদ্বয়। তাঁরা দেবতাদের কাঙ্ক্ষিত সোমরসের ভাগ পেতেন না। চ্যবনমুনি বলে উঠলেন, ‘হে দেবগণ! তোমরা আমায় যৌবন ফিরিয়ে দিয়েছ। আমি তোমাদের সামান্য উপহার দিতে চাই। দেবরাজ ইন্দ্রের সামনে আমি তোমাদের সোমরসের ভাগীদার করব।’
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৭: পুরীতে বাড়ি— রবীন্দ্রনাথের, গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১: অমৃতের সন্ধানে…

এদিকে, শর্যাতিরাজা চ্যবনমুনির যৌবনপ্রাপ্তির সংবাদ শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন। পরিবার পরিজন-সহ রাজা চ্যবনমুনি আর সুকন্যার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। চ্যবনমুনিও অশ্বিনীকুমারযুগলকে সোমরসের ভাগীদার করবেন বলে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন। তিনি শর্যাতিরাজাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘হে রাজন! আপনি একটি যজ্ঞের আয়োজন করুন। আমি সেই যজ্ঞের পৌরোহিত্য করব।’ রাজা সানন্দে সম্মতি দিলেন। যথাসময়ে যজ্ঞ শুরু হল। চ্যবনমুনি যথাসময়ে অশ্বিনীকুমারযুগলের উদ্দেশ্যে সোমরস প্রস্তুত করেছেন, এমন সময়ে ইন্দ্র সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। নিষেধ করলেন তিনি। বললেন, ‘হে মুনিবর! এ আপনি কী করছেন? দেববৈদ্য এঁরা। কোনও মতেই এঁদের সোমরসের ভাগ দেওয়া যেতে পারে না। একমাত্র উচ্চপদমর্যাদার দেবতারাই এই সোমের ভাগ পেতে পারেন।’ চ্যবন এই কথার তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলেন। তিনি বললেন, ‘কী কারণে এঁরা সোমের ভাগ থেকে বঞ্চিত থাকতে পারেন? এঁরা আমাকে জরা থেকে মুক্ত করেছেন। শুধু দেববৈদ্য বলে এঁদের কোনও ভাবেই বঞ্চিত করে রাখা যায় না।’
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১: স্নানের আগে রোজ সর্ষের তেল মাখেন?

ইংলিশ টিংলিশ: মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা সহজে শিখে নাও Transformation of Sentences by changing the DEGREES of Adjectives

ইন্দ্র চ্যবনের কথায় অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি বললেন, ‘যদি আপনি অশ্বিনীকুমারযুগলকে সোমের ভাগ দেওয়ার জন্য মনস্থির করেন, তবে আমিও আমার বজ্র দিয়ে আঘাত করব।’ একথা শুনে চ্যবনও ক্রোধে ফেটে পড়লেন। তপোবলে ইন্দ্রের বজ্রে নিক্ষেপে উদ্যত বাহু থামিয়ে দিলেন তিনি। তিনি মদ নামের ভয়ানক অসুরকে তৈরি করলেন। বিকটদেহী সেই অসুর ইন্দ্রের দর্প চূর্ণ করতে, তাঁকে বিনাশ করতে এগিয়ে এল। এবার ইন্দ্র ভয় পেলেন। চ্যবনমুনির ক্ষমতার কাছে তিনি নতজানু হলেন। ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন, ‘হে মুনিবর! আপনার ইচ্ছাই পূরণ হোক। আজ থেকে দেব্যবৈদ্যযুগলও অন্যান্য দেবতাদের সাথে সোমরসের ভাগ পাবেন।’
অন্যদিকে ইন্দ্রের কথানুসারে চ্যবনকর্তৃক সৃষ্ট মদ বা অহংকারও রয়েই গেল নানারূপ ধরে। তার বিনাশ হল না।
* মহাভারতের আখ্যানমালা (Mahabharater Akhayanmala – Mahabharata) : ড. অদিতি ভট্টাচার্য (Aditi Bhattacharya) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content