শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


বৃহদশ্বমুনি নলরাজার গল্প শুনিয়ে যুধিষ্ঠিরকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন, ‘হে রাজন আমি তোমায় অক্ষবিদ্যা শিখিয়ে দেব। তাহলে তোমায় আর সবসময় পাশাখেলার ভয়ে দিন কাটাতে হবে না।’ মুনি কথা রাখলেন। শিখিয়ে দিলেন পাশাখেলা। অক্ষবিদ্যা শিখে যুধিষ্ঠিরের কৌরবদের থেকে পরাজয়ের আশঙ্কা দূর হল বটে। তবে বনবাসজীবনে পুরোপুরি সুখের হল না। না, রাজ্যহারা হওয়ার কারণে নয়, বরং অর্জুনের বিরহ বড় কষ্ট দিচ্ছিল অপর চার ভাইকে। এতটা কাল পরস্পরকে ছেড়ে কবেই বা থেকেছেন! তাঁরা পাঁচজনে মিলেই তো একটা সম্পূর্ণ শক্তি। একটা জোট। যে জোটকে কৌরবেরাও সমঝে চলেন।
অর্জুনছাড়া কাম্যকবনে বাস তাঁদের কাছে ক্রমে দুর্বিষহ হয়ে উঠতে লাগল। যুধিষ্ঠির মনস্থির করলেন যে, কাম্যকবন ছেড়ে বেরোবেন। তীর্থে যাবেন। ব্রাহ্মণ বলেছেন, ‘চরন বৈ মধু বিন্দতি।’ যদি বিচরণের পথে শান্তি মেলে! মনে মনে এসমস্ত কিছু স্থির করেও ভরসা পান না। হয়তো বয়োজ্যেষ্ঠ অভিজ্ঞের সৎপরামর্শের জন্য অপেক্ষা করেন। তীব্র ইচ্ছা বিফলে যায় না। আকস্মিকভাবেই সাক্ষাৎ হয় দেবর্ষি নারদের সঙ্গে। নারদ সর্বত্র ভ্রমণ করে বেড়ান। নারদের কাছে যুধিষ্ঠির মনের কথা খুলে বলেন। দেবর্ষির ওপরে নিশ্চিন্তে ভরসা করা যায়। যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে নারদমুনি তীর্থযাত্রার ফল বিশদে বর্ণনা করেন। এরপর দেবর্ষি নারদ পাণ্ডবদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাঁর নিজ গন্তব্যে ফিরে গেলে ধৌম্য পুরোহিত ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ তীর্থগুলি সম্পর্কেও যুধিষ্ঠিরকে সম্যক ধারণা দেন। মহাতেজা লোমশমুনিও সেইসময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন। তিনিও পাণ্ডবদের সাহস যোগান।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৭: পুষ্কররাজাকে পরাস্ত করে রাজ্য ফিরে পেলেন নলরাজা

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২০: আকস্মিক অভিঘাত-আনন্দের পাত্রে বিষাদবিষ

অবশেষে যুধিষ্ঠির কৃতনিশ্চয় হলেন। ইতিপূর্বে তিনি অর্জুনকে নানান জায়গায় পাঠিয়েছেন। কখনও অন্য ভাইয়েরাও গিয়েছেন নানা প্রয়োজনে। কিন্তু সপরিবারে তীর্থভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেরোনো এই প্রথম। যদিও অর্জুন নেই সঙ্গে। শুরু হল পাণ্ডবদের পথ চলা, তীর্থে বাস আর দানকার্য।

একের পর তীর্থে বাসের পর প্রয়াগ গঙ্গা-যমুনা নদীর সংযোগস্থলে স্নানাদির পর এগিয়ে চললেন। পাণ্ডবদের এর পরের গন্তব্য ছিল গয়শির পর্বত। আজকের গয়া অঞ্চলে অবস্থিত ছিল এই স্থান। সেই স্থানের কাছ দিয়ে অতীব রমণীয় মহানদী নামের এক নদী প্রবাহিত হতো। সেই স্থান ঋষিদের, তীর্থযাত্রীদের অতিপ্রিয় বলে পরিচিত ছিল। সে স্থানেই ছিল এক প্রকাণ্ড বটগাছ যা অক্ষয়বট নামে পরিচিত ছিল। পাণ্ডবদের বড় ভালো লাগল এই মনোরম স্থানটি। তাঁরা সেখানে দিনকতক কাটাবেন বলে মনস্থির করলেন। তাঁদের ব্যবস্থাপনায় সেখানে চাতুর্মাস্যব্রতের আয়োজন করা হল। আমন্ত্রিত হলেন স্থানীয় জ্ঞানীগুণীবিদ্বজ্জনেরা আর তপস্বীরা। প্রতিদিন যজ্ঞানুষ্ঠানের শেষে গল্পকথার আসর বসত।
আরও পড়ুন:

ছোটদের যত্নে: আপনার সন্তান কি প্রায়ই কাঁদে? শিশুর কান্না থামানোর সহজ উপায় বলে দিচ্ছেন ডাক্তারবাবু

যোগা-প্রাণায়াম: ঘাড়ের ব্যথায় যোগাভ্যাস খুব উপকারী

একদিন শমঠ নামধারী এক ব্রাহ্মণ এগিয়ে এসে বললেন, ‘আজ আমি আপনাদের গয়রাজার আখ্যান শোনাতে চাই।’ সকলে সমস্বরে আগ্রহ প্রকাশ করতে, শমঠ তাঁর গল্পবলা শুরু করলেন। রাজা অপূর্ত্তরয়ার পুত্র গয় ছিলেন রাজর্ষি। গয়শির পর্বতের কাছে ধরণীধর নামে একটি স্বচ্ছজলের বিশাল সরোবর ছিল। সেই সরোবরের তীরের গয়রাজা বহু যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন। গয়রাজার যজ্ঞকার্যে নিমন্ত্রিত অনিমন্ত্রিত নির্বিশেষে সকলের অবারিত দ্বার ছিল। সেই সব যজ্ঞের শেষে কেউই শূন্য হাতে ফিরে যেতেন না। বহু অন্ন আর বহু দক্ষিণা প্রদান করা হত সেই যজ্ঞগুলিতে। গয়রাজা সম্পর্কে এরূপ প্রবাদ ছিল—
সিকতা বা যথা লোকে যথা বা দিবি তারকাঃ।
যথা বা বর্ষতো ধারা অসংখ্যেয়াঃ স্ম কেনচিত্‍।
তথা গণয়িতুং শক্যা গযযজ্ঞে ন দক্ষিণাঃ।।


যেমন বালি, কিংবা আকাশের তারা অথবা বৃষ্টির ধারা যেমন কেউ গুণে শেষ করতে পারে না তেমনি গয়রাজার দক্ষিণাদানের সংখ্যাও গুণেও শেষ করা অসম্ভব। ব্রাহ্মণ শমঠের মুখে গয়রাজার কাহিনী শুনে গয়শিরপর্বতে অবস্থানকালে যুধিষ্ঠিরও দান করবেন বলে মনস্থির করলেন। তারপর সেখানে উপস্থিত ব্রাহ্মণদের বহু দক্ষিণা দিয়ে এগিয়ে চললেন পরবর্তী তীর্থের পথে। যাত্রাপথের তপস্যায় তাঁদের হৃদয় শুচিস্নিগ্ধ হয়ে উঠতে লাগল।

Skip to content