বুধবার ১৩ নভেম্বর, ২০২৪


মেয়ের ফিরে আসায় রাজ্যে যতই উত্সব চলুক, মেয়ের বিষণ্ণ মুখখানা কিন্তু রানীর চোখ এড়াল না। মেয়ের কষ্ট তাঁকেও দগ্ধ করতে লাগল অন্তরে। ধীরে ধীরে সেই বিষণ্ণতা গ্রাস করে ফেলল অন্তঃপুরের সকলকে। রানিমা নিজেকে সামলাতে না পেরে রাজাকে দময়ন্তীর কথা খুলে বলেন। রানির অনুরোধে ভীমরাজা নলের খোঁজে দিকে দিকে ব্রাহ্মণদের পাঠালেন। রাজার পাঠানো ব্রাহ্মণদূতেরা ছড়িয়ে পড়েন এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে, নলের খোঁজে। দময়ন্তীর বিলাপ যে তাঁদেরও স্পর্শ করেছে। সে বিষণ্ণতা বয়ে নিয়ে চলেছেন তাঁরাও। রাজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসবার সময়ে দময়ন্তীর বলা কথাগুলো তাঁদের কানে যেন এখনও বাজছে। দময়ন্তী কাতর সুরে তাঁদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘হে ব্রাহ্মণেরা আপনারা যেভাবেই হোক নলরাজা খুঁজে বের করুন।’ ব্রাহ্মণেরা একের পর এক রাজ্যে ঘুরে ফেরেন আর তাঁদের কথায় কথায় ছড়িয়ে পড়ে দময়ন্তীর ব্যথার বাণী—
‘উৎসৃকজ্য বিপিনে সুপ্তামনুরক্তাং প্রিয়াং প্রিয়!
সা বৈ তথা ত্বয়া দৃষ্ট্বা তথাস্তে তৎপ্রতীক্ষিণী।’


হে জুয়াড়ি, তুমি আজ কোথায়! সেই যে প্রিয়তমা স্ত্রীর বস্ত্রার্ধ ছেদন করে তাকে না জানিয়ে চলে গেলে, তোমার সেই স্ত্রী তোমার বিরহে শোকের আগুনে পুড়ে সেইরকমই অবশিষ্ট অর্ধবস্ত্রে নিজের আব্রু রক্ষা করে আজও তোমার প্রতীক্ষায় রয়েছে!
ব্রাহ্মণেরা একের পর এক রাজ্যে ঘুরেও কোনও সদর্থক সংবাদ দিতে পারেন না। এ ভাবে দিনের পর দিন কাটে। দময়ন্তীর আশা মরে না। সেদিন সন্ধ্যাবেলা রাজবাড়ির অন্দরমহলে দময়ন্তী একলাটিই বসে রয়েছেন। রাজবাড়ির পরিচিত স্বাচ্ছন্দ্যেও মনে তাঁর আগের সহজতা নেই। নলরাজার চিন্তাই এখন তাঁর সঙ্গের সঙ্গী। এমনসময় দ্বারী এসে সংবাদ দেয়, পর্ণাদ নামের এক ব্রাহ্মণ রাজকন্যার দর্শনার্থী হয়ে দ্বারে অপেক্ষমান। রাজকন্যা ডেকে পাঠালেন তাঁকে। পর্ণাদ রাজকন্যাকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে তাঁর যাত্রাকালের অদ্ভুত কাহিনী বলে চলেন। পর্ণাদ বলে চলেন, ‘নানা রাজ্যে নলরাজার সন্ধানে ঘুরে বেড়ানোর পর সেদিন উপস্থিত হয়েছিলাম অযোধ্যানগরীতে। সেখানে ঋতুপর্ণরাজার সভায় আমি আপনার শেখানো কথাগুলো বলে উঠলে অন্য রাজার সভার মতো সেই সভায় উপস্থিত জনগণেরও কোনও বিকার হল না।

এমনকি রাজাও কোনও মন্তব্য করলেন না। বাহুক নামে রাজার এক বিকৃতদেহী সারথি সভায় উপস্থিত না থেকেও আড়াল থেকে সমস্ত কথাই শুনছিল। সভাশেষে সে আমায় ডেকে নিয়ে গিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করে নানান কথা বলতে লাগত। বাহুকের চোখ দিয়ে সেসময় অনবরত জল পড়ছিল। আচরণও অসংলগ্ন ছিল। তার কথার যাথার্থ্য আমি বুঝতে পারিনি।’ পর্ণাদ এক নিঃশ্বাসে বলে চলেন, বাহুক নিজেকে রন্ধনবিদ্যা বিশারদ আর অশ্ববিদ্যায় পারদর্শী বলে পরিচয় দিয়েছিল। বেঁটেখাটো বিকটদর্শন সেই ব্যক্তি বলতে লাগল, বিপদে পড়ে কোন পতি যদি পত্নীকে ত্যাগ করেন, তবে পত্নী কখনই তাঁর প্রতি ক্রুদ্ধ হতে পারেন না। সেই প্রেমিক পতি যদি খিদে তেষ্টায় কাতর হয়ে প্রাণপণে বেঁচে থাকবার চেষ্টাটুকু চালিয়ে যাওয়ার সময় এমতাবস্থায়, পাখিরা তার পরনের কাপড়খানা চুরি করে নিয়েছিল। রাজ্যহারা, ক্ষুধার্ত্ত, অসহায় পতির ওপর পত্নীর কখনই ক্রোধ করা উচিত নয়।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৬: রাম-পরশুরাম দ্বৈরথ অযোধ্যার পথে

ডাক্তারের ডায়েরি, পর্ব-৩১: সাহিত্যিক যখন কাছের মানুষ: প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং বুদ্ধদেব গুহ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-২৮: কাদম্বরী বিহারীলালকে দিয়েছিলেন ‘সাধের আসন’

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-২৮: অনুপুষ্টিতে ভরপুর পুঁটিমাছ ছোটদের দৃষ্টিশক্তির বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

এই অবধি বলে পর্ণাদ থামেন। তারপর বলেন, ‘এমন আশ্চর্য কথা শোনার পর আমি আর তিলমাত্র দেরি না করে আপনার কাছে এসেছি।’ এই সমস্তকিছু শুনে দময়ন্তী তত্ক্ষ ণাৎ মনস্থির করে সুদেব নামের ব্রাহ্মণকে ডেকে পাঠালেন। সুদেবকে তিনি ভরসা করতেন। সুদেব এলে দময়ন্তী তাঁকে বলেন, ‘আপনি অযোধ্যানগরীতে গমন করুন। সেখানে রাজাকে বলবেন, ভীমরাজার কন্যা দময়ন্তী দ্বিতীয়বার বিবাহ করবেন। সেজন্য পুনরায় স্বয়ংবরসভার আয়োজন করা হয়েছে।’ রাজা নল যথার্থই অশ্বচালনে সুদক্ষ ছিলেন। তাই দময়ন্তী বাহুকই নল কিনা তা পরীক্ষা করবার জন্য স্বয়ংবরসভার দিন হিসেবে এমন একটি দিন ধার্য করলেন, যাতে অযোধ্যা থেকে বিদর্ভে একদিনের মধ্যে পৌঁছতে হবে।

এদিকে রাজকন্যা দময়ন্তীর পরামর্শমত সুদেব অযোধ্যায় ঋতুপর্ণরাজার সভায় গিয়ে জানালেন, দময়ন্তীর স্বযংবরসভায় দেশবিদেশের রাজা আর রাজপুত্রদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ঋতুপর্ণরাজা সেই শুনে সভায় যাওয়ার জন্য তোড়জোড় করতে লাগলেন। সারথি বাহুককে ডেকে রাজা বললেন, ‘বাহুক, তুমি অশ্ববিদ্যায় পারদর্শী। যদি তুমি ইচ্ছা কর, তবে আমি একদিনের মধ্যে বিদর্ভদেশে পৌঁছে বিদর্ভরাজকন্যার স্বয়ংবরসভায় যোগ দিতে পারি।’ বাহুকরূপী নলরাজা দময়ন্তীর দ্বিতীয়বিবাহের কথা শুনে দুঃখে যেন বিদীর্ণ হলেন। কিন্তু তিনি নিজেকে সংযত করলেন পরক্ষণেই শুধু দময়ন্তীকে চোখের দেখা দেখতে পাবেন, এই আশায়, ঘটনার সত্যাসত্য বিচার করতে পারা যাবে, এই আশাতেও বটে। রাজার আদেশে বাহুক ঘোড়াশালে গিয়ে কতগুলি ঘোড়া পছন্দ করলেন, যেগুলি আপাতদৃষ্টিতে বেশ রোগাসোগা বটে, কিন্তু নলরাজা ঘোড়া চিনতেন। তিনি জানতেন, এই ঘোড়াগুলিই পারে রাজাকে একদিনের মধ্যে এত রাস্তা পার করে দিতে। ঋতুপর্ণরাজা ঘোড়াগুলি দেখে অবিশ্বাসীর মন নিয়েও বাহুকের ভরসাতেই রথে চড়ে বসলেন। বাহুকের চালনে ঘোড়াগুলি তীব্র বেগে রাজাকে মুগ্ধ করে যেন উড়ে চলল বিদর্ভের পথে।

Skip to content