দময়ন্তী যতটা না নিজের জন্য কাতর হলেন, নলের জন্য শোক তাঁকে আরও আকুল করে তুলল। তাঁর সে হাহাকার এক ব্যাধের কানে পৌঁছল। ব্যাধ দময়ন্তীর রূপে মুগ্ধ হল। মনে তার তীব্র কামনার উদ্রেক হল। কিন্তু সে কথা মুখে প্রকাশ করল না। নির্জন জনমানুষহীন বনে দময়ন্তীকে ভোগ করবার বাসনায় সে প্রথমে দময়ন্তীর বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করল। অজগরটি সেই মুহূর্তে দময়ন্তীকে গ্রাস করতে যাচ্ছিল। ব্যাধ মুহূর্তের মধ্যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে অজগরটির ভবলীলা সাঙ্গ করল। অপরূপ রূপসম্পন্না দময়ন্তীর পরনে তখন খণ্ডবস্ত্র। কিন্তু নিজের প্রতি সেই মূহুর্তে তিনি সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। ব্যাধের মনোভাব তিনি প্রথমটায় বুঝতে না পারলেও বোঝামাত্র ক্রোধে জ্বলে উঠলেন। নলের প্রতি অনন্যমনা দময়ন্তী সেই সময়ে সমস্ত প্রকার ভয়কে জয় করে ফেলেছিলেন যেন।
এদিকে ব্যাধও কোমলাঙ্গী দময়ন্তীকে বলবৎ ভোগ করতে চেয়েও না পেরে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হল। তবে ব্যাধ এও বুঝতে পারল যে ইনি কোনো সামান্যা নারী নন। রাজ্যহারা পতিবিসর্জিতা একাকিনী দময়ন্তীর শরীরে যেন বাঁচার তাগিদেই অসীম শক্তি ভর করল। ব্যাধের বলপ্রয়োগ আর তাতে দময়ন্তীর তীব্র বাধাদানের মাঝেই দময়ন্তী মরিয়া হয়ে আত্মরক্ষার তাগিদে তীব্র আঘাত করলেন ব্যাধকে। প্রাণপণ সে আকস্মিক আঘাত ব্যাধ সহ্য করতে পারল না। প্রাণ হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
এমন এক কঠিন পরিস্থিতি দময়ন্তীকে যেন এক লহমায় নির্ভীক করে তুলল। নির্জন ভয়ঙ্কর বন, যত বিচিত্র গাছপালা সেখানে তত বিচিত্র বুনো জানোয়ারদের অবাধ বিচরণ। সেই বনে একলা মানবী দময়ন্তী। পৃথিবীর কোনো ভয়ই তাঁকে স্পর্শ করতে পারল না। একটাই খোঁজ তাঁর। নল কোথায়? কখনও বিলাপ করেন, কখনও নির্বাক হয়ে শুধু পথ চলেন। জনমানবহীন সে বনে কোনও মানুষকে না পেয়ে পশুদেরই প্রশ্ন করেন, কখনও পাহাড়কে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন, ‘বলতে পারো তোমরা? নলরাজা কোথায়? কেউ দেখেছো রাজাকে’
কোথাও কোনও উত্তর মেলে না। একাকিনী দময়ন্তী হেঁটে চলেন। এ ভাবে চলতে চলতে একদিন এক অতিমনোহর তপোবনে উপস্থিত হলেন তিনি। সে তপোবনের আশ্রমগুলিতে বৃদ্ধ তপস্বীদের বাস ছিল। নির্জন অরণ্যে দীর্ঘপথ একা যাত্রা করে এতকাল পর মানুষের সঙ্গ পেয়ে দময়ন্তী আকুল হয়ে উঠলেন। তপস্বীদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, ‘এমন ভয়ঙ্কর বনপথে যাঁর খোঁজে আমি পথ চলেছি, তাঁকে যদি দেখতে না পাই তবে আমি শিগগিরই প্রাণত্যাগ করব।’ ভূয়োদর্শী তপস্বীরা তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন, খুব শীঘ্রই তাঁর এমন দশা অতীত হবে।
তপস্বীদের সঙ্গে সাক্ষাতের পরমূহুর্তেই সেই তপোবন আর তপস্বীরা যেন ভোজবাজির মতো উবে গেল। আর দময়ন্তী মনে মনে ভাবতে বসলেন, ‘এ কি মায়া ছিল? নাকি আমারই কোনও ভুল ? অথবা কোনও দৈবী শক্তি এমন ভাবে সাহস যুগিয়ে গেলেন, এখনও আশা রয়েছে। এখনও সবটুকু ফুরিয়ে যায়নি।’
তপস্বীদের সঙ্গে সাক্ষাতের পরমূহুর্তেই সেই তপোবন আর তপস্বীরা যেন ভোজবাজির মতো উবে গেল। আর দময়ন্তী মনে মনে ভাবতে বসলেন, ‘এ কি মায়া ছিল? নাকি আমারই কোনও ভুল ? অথবা কোনও দৈবী শক্তি এমন ভাবে সাহস যুগিয়ে গেলেন, এখনও আশা রয়েছে। এখনও সবটুকু ফুরিয়ে যায়নি।’
আবারও দময়ন্তী পথ চলেন। নলরাজার খোঁজে বনের আনাচকানাচ, পর্বতের গুহাকন্দর কিছুই বাদ দেন না। একদিন এমনই পথ চলতে গিয়ে দময়ন্তী দেখেন, এক দল বণিক একটি পাহাড়ী নদী পার হচ্ছে। দময়ন্তীর মনে যেন আশার আলো জাগল। তিনি বণিকদের দলে প্রবেশ করে পথ চলতে থাকলেন। দময়ন্তীর পরনের খণ্ড বস্ত্র তখন ধূলিধূসরিত। শোকে দুঃখে পাগলপারা দময়ন্তীকে দেখে বণিকদের মনে বহুবিচিত্রভাবের উদয় হল। কেউ ভয় পেল। কেউ গভীর চিন্তাগ্রস্ত হল। কেউ আবার হাসতে লাগল। কেউ কেউ নানান প্রশ্নবাণে তাঁকে বিদ্ধ করতে লাগল। কেউ কেউ তাঁকে বনদেবী ভেবে হাতজোড় করে প্রার্থনা করতে লাগল, ‘হে দেবী, তুমি প্রসন্ন হও। আমাদের প্রতি কৃপা করো। আমরা যেন এ দুর্গম বনপথ নির্বিঘ্নে পার হয়ে যেতে পারি।’
দময়ন্তী তাদের উদ্দেশ্যে কাতর স্বরে বলে উঠলেন, ‘তোমরা ভুল ভাবছ। আমি কোনও দেবী নই। আমি মানবী। রাজার মেয়ে আমি। নলরাজার বিবাহিতা স্ত্রী। আজ ভাগ্যদোষে আমার এমন দুর্দশা। তোমরা কি কেউ নলরাজাকে দেখেছো ?’ এবার বণিকদলের দলনেতা এগিয়ে আসেন। তিনি বলে ওঠেন, এ ভয়ানক বনে আমরা তোমায় ছাড়া আর কোন মানুষজন দেখিনি। আমরা চেদিরাজ্যের দিকে চলেছি। তুমি চাইলে আমাদের সঙ্গে যেতে পারো।’ দময়ন্তী মনে মনে চিন্তা করলেন, এ জনহীন বনে একলা রাজার খোঁজে ঘুরে বেড়ানো বড় কঠিন কাজ। তার চেয়ে বণিকদলের সঙ্গে যাত্রা করাই শ্রেয় বলে মনে করলেন তিনি। চেদিরাজ্যের পথে এগিয়ে চলল বণিকের দল আর দময়ন্তী।