রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


পুষ্কররাজার আহ্বান নল অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। একে তিনি পাশা খেলতে পছন্দ করেন, তায় পুষ্কররাজা পত্নী দময়ন্তীর সামনে তাঁকে ডেকেছেন। এমতাবস্থায় না বলাটা অসম্মানজনক হবে। কলি নলকে আগেই আশ্রয় করেছেন। নিজের প্রতিকূল দৈবের বশে নলরাজা একে একে সব হারাতে লাগলেন। পুরবাসী, মন্ত্রীরা রাজাকে নিবৃত্ত করতে রাজভবনের দ্বারে উপস্থিত হলেন। পাশার নেশা তখন রাজাকে গ্রাস করেছিল। তিনি তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন না। দময়ন্তী প্রমাদ গুনলেন। তিনি বৃহৎসেনা নামের নিজের ধাত্রীকে রাজার কাছে পাঠালেন রাজাকে নিবৃত্ত করবার জন্য। রাজা তার কথা গ্রাহ্যও করলেন না। দমযন্তী বুদ্ধিমতী। রাজা পাশার অধীন হয়ে পড়েছেন আর এ রাজ্যও খুব শীঘ্রই পরের অধীন হতে চলেছে এ তিনি অনুমান করতে পেরে রাজার বিশ্বস্ত বার্ষ্ণেয় নামের সারথিকে ডেকে পাঠালেন। নিজের প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র আর কন্যাকে বার্ষ্ণেয়ের হাতে সমর্পণ করে বললেন, বার্ষ্ণেয়, তুমি এদের আমার পিতৃগৃহে পৌঁছে দিয়ে এসো।

বার্ষ্ণেয় নলের দুর্দশা দেখে শোক করতে করতে সে রাজ্য ছেড়ে চলে গেল। রাজার বিশ্বস্ত বার্ষ্ণেয় রাজাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পরই যেন রাজার দুর্দশা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পেল। যেটুকু অবশিষ্ট ধন ছিল তাও পাশায় চলে যেতে পুষ্কর রাজা প্রস্তাব দিলেন, ‘রাজা, তোমার শ্রেষ্ঠ ধন দময়ন্তী। তাকে পণ রেখে তুমি আবারো পাশা খেলতে পারো।’ একথা রাজার হৃদয়ে যেন তীরের ফলার মতো বিঁধল। যেন হঠাত্ইম সম্বিত ফিরে এল তাঁর। রাজবেশের দৌলতে যেটুকু অলংকার তাঁর দেহে অবশিষ্ট ছিল সব খুলে রেখে শোকসন্তপ্ত প্রজাদের পিছনে ফেলে একবস্ত্রে রাজধানী থেকে বেরিয়ে এলেন। একমাত্র দময়ন্তী তাঁর সঙ্গে চললেন। নলরাজা তিনদিন কেবল জলমাত্র পান করে নিজের রাজধানীর বাইরে অবস্থান করলেন। প্রজারা তাদের প্রাণাধিক প্রিয় রাজাকে কোন
এদিকে তিনদিন পর রাজা খিদেতেষ্টায় কাতর হয়ে খাদ্যের সন্ধানে রাজধানী ছেড়ে এগিয়ে চললেন। সঙ্গে চললেন দময়ন্তী। এমনি করে বহুকাল চলে গেল। রাজা আর রানি ক্ষুধার্ত্ত অবস্থায় ভাগ্যের খোঁজে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একদিন হঠাৎ রাজা আকাশে সোনালি পাখার কতগুলি পাখিকে দেখতে পেয়ে মনে মনে উল্লসিত হয়ে ভাবলেন, আজ এই পাখিগুলোকে যদি ধরতে পারি তবে এরাই আমার আহার হতে পারে আর এদের পাখাগুলো আমার ভবিষ্যতের ধনলাভের উপায় হতে পারে। দৈবপীড়িত হয়েই যেন রাজা তার নিজের পরনের কাপড় খুলে ফেলে পাখিগুলোকে ঢেকে ফেললেন। আর সেইমাত্র ঘটে গেল এক অবাঞ্ছিত ঘটনা। পাখিগুলো রাজার পরনের কাপড় নিয়ে উড়ে গেল আর যাওয়ার সময় নলের কাতর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে গেল, ‘রাজা সত্যই তোমার বুদ্ধিনাশ হয়েছে। আমরা হলাম সেই পাশা। তোমার বস্ত্র হরণ করবার জন্যই এসেছিলাম। তোমায় কপর্দকশূন্য বস্ত্রহীন দেখাতেই আমাদের আনন্দ।’ এই বলে সেই পাখিরা উড়ে গেল। রাজা কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন।

এরপর প্রাণাধিক প্রিয় দময়ন্তীর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ হে দময়ন্তী, আমি তোমার পতি অতএব সর্বান্তঃকরণে তোমার মঙ্গল চাই। এই সামনের পথ বিদর্ভদেশের পথ, আর অপরদিকের পথটি গিয়েছে অযোধ্যার দিকে। দক্ষিণদিকের পথটি দাক্ষিণাত্যদেশে যাওয়ার পথ।’ রাজার এমন কথা বলবার উদ্দেশ্য দময়ন্তী সহজেই বুঝতে পারেন। সখেদে তিনি বলে ওঠেন, ‘রাজন! কেন আপনি আমাকে পিতৃগৃহের পথনির্দেশ করছেন? এমন নির্জ্জন শ্বাপদসংকুল বনে ক্ষুধার্ত্ত বস্ত্রহীন আপনাকে ছেড়ে পিতার গৃহে কেন কোথাও গিয়ে শান্তি পাব না। যদি যেতেই হয়, চলুন আমরা একসঙ্গে সেখানে যাই।’ রাজা সে কথায় রাজি হন না। যে রাজ্যে একদিন তিনি বীরের মত মাথা উঁচু করে সে রাজ্যের কন্যাকে সঙ্গে করে উপযুক্ত জামাতার মতো গিয়েছেন, আজ এমন দুর্দশার দিনে নিঃস্ব অবস্থায় সেখানে কিভাবে যাওয়া সম্ভব?
শেষে দময়ন্তীর অনুরোধে নলরাজা দময়ন্তীর শাড়িখানিকে দু’ টুকরো করে সেটি উভয়ে পরিধান করলেন। তারপর ক্লান্ত দেহকে কোনমতে বয়ে নিয়ে এসে এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে একটা মাথা গোঁজবার ঠাঁই পেলেন। জনমানবহীন সে পান্থশালায় পৌঁছে রাজা দময়ন্তী উভয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। দময়ন্তী নিদ্রা গেলেও রাজার ঘুম এলো না। তিনি নানারকম চিন্তা করতে লাগলেন। ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আর দময়ন্তীর দুর্দশা তাঁকে অত্যন্ত পীড়া দিতে লাগল। সাতপাঁচ ভেবে মনস্থির করলেন, দময়ন্তীকে না ত্যাগ করলে এমন ভাগ্যবিপর্যয় দময়ন্তীরও পিছু ছাড়বে না। বরং রাজা সঙ্গে না থাকলে সাময়িকভাবে শোক এলেও পিতার গৃহে ফিরে গিয়ে দময়ন্তী সুখেই থাকবেন। বনে বনে এমন ভবঘুরের দুর্দশার জীবন তো আর কাটাতে হবে না!

কলি রাজাকে আশ্রয় করেছিল। রাজার ইতিপূর্বেই বুদ্ধিনাশ হয়েছিল। ঘুমন্ত দময়ন্তীকে সেই অবস্থায় ফেলে রেখে রাজা দ্রুত সেই পান্থশালা ত্যাগ করলেন। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরেই রাজার সম্বিত ফিরল। দময়ন্তীর প্রতি স্নেহ যেন তাঁর পথরোধ করতে লাগল। তিনি আবার ফিরে এলেন। দুষ্ট কলি রাজার বুদ্ধি হরণ করেছিল। ফিরে এসেও রাজা চিন্তা করলেন, দেবতারা নিশ্চয়ই দময়ন্তীকে রক্ষা করবেন। অতি মনোকষ্টেও সেই জনশূন্য বনে একাকিনী দময়ন্তীকে ত্যাগ করে তিনি চলে গেলেন।

এদিকে নির্জন সেই বনে দময়ন্তীর যখন ঘুম ভাঙল, পাশে রাজাকে দেখতে না পেয়ে আকুল হলেন তিনি। শোকে দুঃখে হাহাকার করতে লাগলেন তিনি। সেই পান্থশালা থেকে বেরিয়ে উন্মত্তের মতো নলের নাম ধরে বিলাপ করতে লাগলেন। এমন সময় তাঁর অগোচরেই এক বিশালদেহী অজগর তাঁকে গ্রাস করতে এলো।

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

Skip to content