রোহিত বনে গিয়েছিল। উঠতি বয়সের ছেলে ছিল সে। বাবা কবে কোন দেবতাকে কথা দিয়ে রেখেছেন, ছেলে হলে তাকে উৎসর্গ করে যজ্ঞ করবেন, একথা জানার পর থেকে সে ঘরছাড়া। বাবার কথা সে মানবে কেন? তাই ঘর থেকে বেরিয়ে বনে বনে ঘোরে। এই ভাবে বছর কাটে। হঠাৎ কানে খবর এসে পৌঁছয়, বাবা অসুস্থ। অসুস্থ বাবাকে দেখতে অভিমানী ছেলে তড়িঘড়ি রাজধানীর পথে দৌড়োয়। পথে দেখা হয়ে যায়, ব্রাহ্মণবেশী ইন্দ্রের সঙ্গে। ইন্দ্র তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার বনের পথে, বিচরণের পথে ফেরত পাঠান। ইন্দ্রের কথায় দেশে ফেরার জন্য উদ্যোগী হয়েও রোহিত আবার ফিরে যায় বনের পথে, বিচরণের পথে। ইন্দ্র তাকে ভ্রমণের সাধু ফল নিয়ে উপদেশ দেন। রোহিতের সে সব কথা বেশ মনে ধরে। পিতার রাজ্যে কি আর এসব হবার জো ছিল? রাজার ছেলের বড় বাঁধা গতের জীবন। তাই তার বিচরণ দীর্ঘায়িত হতে থাকে, ভরতে থাকে অভিজ্ঞতার ঝুলি। এ তো গেল রাজা হরিশ্চন্দ্রের ছেলে রোহিতের কথা।
মহাভারতেও পাণ্ডবেরা চলেছেন বনের পথে। সে পথ আরামের পথ নয় মোটেই। এর আগেই দুর্যোধনের অনিষ্টের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে অনেককটা দিন। কিন্তু সেদিন আর এদিন তো এক নয়। এ যে রীতিমতো সভাশুদ্ধ বিশিষ্ট জনদের সামনে বসে পাশাখেলায় হেরে শর্ত মতো বারো বছরের বনবাস। সঙ্গে আবার এক বছরের অজ্ঞাতবাসেও কাটাতে হবে, এই কথা দিয়ে আসতে হয়েছে। তাই দ্রৌপদী আর পুরোহিত ধৌম্যকে সঙ্গে নিয়ে চলেছেন পাণ্ডবেরা। যাবতীয় সুখ, ঐশ্বর্য, ঐশ্বর্যের জন্য লড়াই, ঈর্ষা সবকিছুকে পিছনে ফেলে রেখে পথ চলেছেন সকলে। এ পথ পরিব্রাজকের পথ। কিন্তু এপথ তাঁদের আত্মশুদ্ধির পথ।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণে শুনঃশেপের গল্পে বলা হয়েছে— ‘চরন বৈ মধু বিন্দতি’। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গ নিয়েছেন তাঁর অনুগামী ব্রাহ্মণেরাও। রাজাকে তাঁরা ছাড়তে রাজি নন। তাঁদের পথ চলায় যুধিষ্ঠির অস্বস্তিতেই রয়েছেন। রাজা তিনি। নাই বা রইল রাজপাট। রাজার মনটাকে তো আর বিসর্জন দিতে পারেননি! তাই চিন্তা তাঁর পিছু ছাড়ে না। কীভাবে এঁদের ভরণপোষণ সম্ভব হবে! যতই তাঁরা বলুন যে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেবেন, যুধিষ্ঠিরের মন মানে না। এ দিকে ব্রাহ্মণেরা মোটেই দুর্যোধনের রাজ্যে থাকতে চান না। শুধু তাঁরা যুধিষ্ঠিরকে রাজা বলে মানতে চান। তাঁর সঙ্গ চান। সেই ব্রাহ্মণদের মধ্যে শৌনক নামে এক বিদ্বান ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি রাজাকে উপদেশ দেন, ‘রাজন্, বনবাসের পথ হল কৃচ্ছসাধনের পথ, ত্যাগের পথ, ইন্দ্রিয়দমনের পথ। এতকাল রাজ্য নিয়ে যেসকল ক্লেদ সঞ্চিত হয়েছিল মনে আজ তাকে বিসর্জনের সময় এসেছে। দেবতারা যেভাবে প্রাণিদের পালন করেন, তেমনি লোভ বর্জন করে, ইন্দ্রিয় দমন করে আরও আত্মমগ্ন হয়ে পথ চলুন। ব্রাহ্মণদের ভরণের উপায়ও এতেই মিলবে।’
ব্রাহ্মণদের নিজ সিদ্ধান্তে অটল দেখে যুধিষ্ঠির পুরোহিত ধৌম্যের আশ্রয় নেন। ধৌম্য বলেন, ‘মহারাজ, সূর্যদেবতাকে ডাকুন। তিনি প্রত্যক্ষদেবতা। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি প্রাণিদের প্রাণধারণের জন্য সূর্যই অন্নে আবির্ভূত হন। আজ তিনি অনুগ্রহ করলে আপনার ইষ্টসিদ্ধি হবে।’ ধৌম্যের কথায় যুধিষ্ঠির সংযতচিত্ত হয়ে সূর্যের ধ্যানে ডুবে যান। ‘জগতশ্চক্ষুস্ত্বমাত্মা সর্ব্বদেহিনাম’— বেদের মন্ত্রের অনুকরণে যুধিষ্ঠিরকৃত স্তবে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। পুরোহিত ধৌম্য যেভাবে সূর্যের মহিমা বর্ণনা করেছেন, সেভাবে জগত্স্রষ্টারূপে তাঁকে বন্দনা করেন যুধিষ্ঠির। তাঁর একাগ্র আহ্বানে সন্তুষ্ট হন সূর্যদেব। যে রাজ্যলোভ মনকে ক্লিন্ন করেছিল, সে মনটাকে ফেলে এসেছেন যুধিষ্ঠির। আজ তাঁর এ প্রার্থনা শুধু পরহিতার্থে। দেবতা তাই কাছে আসেন। কৃপা করেন যুধিষ্ঠিরকে। বররূপে এক আশ্চর্য পাত্র দেন যুধিষ্ঠিরকে। তামার এ পাত্রটির গুণ হল রান্না করা ফল শাক-সবজি অথবা আমিষ দ্রব্য রাখা হলে, যতক্ষণ অবধি দ্রৌপদী অনাহারে থাকবেন ততক্ষণ পাত্রের অন্ন ফুরাবে না। দ্রৌপদীর খাওয়া শেষ হওয়ামাত্র অন্নও নিঃশেষিত হবে।
সূর্যদেবের দেওয়া সে আশ্চর্যপাত্র নিয়ে অত্যন্ত খুশি হয়ে যুধিষ্ঠির পুরোহিত ধৌম্যকে প্রণাম করলেন সবার প্রথমে। তারপর ভাইদের এ আনন্দ সংবাদ জানালেন। আর দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে তত্ক্ষণাৎ রান্নাঘরে গেলেন। পাত্রটির গুণাগুণ পরীক্ষা করবার জন্য তাঁর আর তর সইছিল না। ভাঁড়ারে যা ছিল সেই সব দিয়ে তৈরি হল নানানরকমের সুস্বাদু আহার্য। প্রথমে ব্রাহ্মণেরা ভোজন করলেন। দেবব্রাহ্মণপিতৃগণ আর অন্যান্য প্রাণিদের ভোজনের পর অবশিষ্ট যে অন্ন, তাকে বলা হয় বিঘস। ছোট ভাইদের খাইয়ে যুধিষ্ঠির নিজে সেই বিঘস অন্ন ভোজন করতে বসলেন। সবার ভোজনাদি শেষ হলে দ্রৌপদী আহার করলেন। দ্রৌপদীর খাওয়া শেষ হতেই আশ্চর্যজনকভাবে পাত্রের অন্নও শেষ হয়ে গেল। এ ভাবে বনে চলার পথে প্রথম প্রাপ্তি হল যুধিষ্ঠির। স্বয়ং বেদ বলেছেন বিচরণ করতে। সে পথ আত্মশুদ্ধির পথ, বিবেকলাভের পথ, তপস্যার আর মুক্তির পথ। সে পথে পরিব্রাজকের মন নিয়ে চললেন যুধিষ্ঠির। সঙ্গে চললেন পত্নী আর ভাইয়েরাও।
ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
মহাভারতেও পাণ্ডবেরা চলেছেন বনের পথে। সে পথ আরামের পথ নয় মোটেই। এর আগেই দুর্যোধনের অনিষ্টের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে অনেককটা দিন। কিন্তু সেদিন আর এদিন তো এক নয়। এ যে রীতিমতো সভাশুদ্ধ বিশিষ্ট জনদের সামনে বসে পাশাখেলায় হেরে শর্ত মতো বারো বছরের বনবাস। সঙ্গে আবার এক বছরের অজ্ঞাতবাসেও কাটাতে হবে, এই কথা দিয়ে আসতে হয়েছে। তাই দ্রৌপদী আর পুরোহিত ধৌম্যকে সঙ্গে নিয়ে চলেছেন পাণ্ডবেরা। যাবতীয় সুখ, ঐশ্বর্য, ঐশ্বর্যের জন্য লড়াই, ঈর্ষা সবকিছুকে পিছনে ফেলে রেখে পথ চলেছেন সকলে। এ পথ পরিব্রাজকের পথ। কিন্তু এপথ তাঁদের আত্মশুদ্ধির পথ।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণে শুনঃশেপের গল্পে বলা হয়েছে— ‘চরন বৈ মধু বিন্দতি’। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গ নিয়েছেন তাঁর অনুগামী ব্রাহ্মণেরাও। রাজাকে তাঁরা ছাড়তে রাজি নন। তাঁদের পথ চলায় যুধিষ্ঠির অস্বস্তিতেই রয়েছেন। রাজা তিনি। নাই বা রইল রাজপাট। রাজার মনটাকে তো আর বিসর্জন দিতে পারেননি! তাই চিন্তা তাঁর পিছু ছাড়ে না। কীভাবে এঁদের ভরণপোষণ সম্ভব হবে! যতই তাঁরা বলুন যে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেবেন, যুধিষ্ঠিরের মন মানে না। এ দিকে ব্রাহ্মণেরা মোটেই দুর্যোধনের রাজ্যে থাকতে চান না। শুধু তাঁরা যুধিষ্ঠিরকে রাজা বলে মানতে চান। তাঁর সঙ্গ চান। সেই ব্রাহ্মণদের মধ্যে শৌনক নামে এক বিদ্বান ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি রাজাকে উপদেশ দেন, ‘রাজন্, বনবাসের পথ হল কৃচ্ছসাধনের পথ, ত্যাগের পথ, ইন্দ্রিয়দমনের পথ। এতকাল রাজ্য নিয়ে যেসকল ক্লেদ সঞ্চিত হয়েছিল মনে আজ তাকে বিসর্জনের সময় এসেছে। দেবতারা যেভাবে প্রাণিদের পালন করেন, তেমনি লোভ বর্জন করে, ইন্দ্রিয় দমন করে আরও আত্মমগ্ন হয়ে পথ চলুন। ব্রাহ্মণদের ভরণের উপায়ও এতেই মিলবে।’
ব্রাহ্মণদের নিজ সিদ্ধান্তে অটল দেখে যুধিষ্ঠির পুরোহিত ধৌম্যের আশ্রয় নেন। ধৌম্য বলেন, ‘মহারাজ, সূর্যদেবতাকে ডাকুন। তিনি প্রত্যক্ষদেবতা। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি প্রাণিদের প্রাণধারণের জন্য সূর্যই অন্নে আবির্ভূত হন। আজ তিনি অনুগ্রহ করলে আপনার ইষ্টসিদ্ধি হবে।’ ধৌম্যের কথায় যুধিষ্ঠির সংযতচিত্ত হয়ে সূর্যের ধ্যানে ডুবে যান। ‘জগতশ্চক্ষুস্ত্বমাত্মা সর্ব্বদেহিনাম’— বেদের মন্ত্রের অনুকরণে যুধিষ্ঠিরকৃত স্তবে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। পুরোহিত ধৌম্য যেভাবে সূর্যের মহিমা বর্ণনা করেছেন, সেভাবে জগত্স্রষ্টারূপে তাঁকে বন্দনা করেন যুধিষ্ঠির। তাঁর একাগ্র আহ্বানে সন্তুষ্ট হন সূর্যদেব। যে রাজ্যলোভ মনকে ক্লিন্ন করেছিল, সে মনটাকে ফেলে এসেছেন যুধিষ্ঠির। আজ তাঁর এ প্রার্থনা শুধু পরহিতার্থে। দেবতা তাই কাছে আসেন। কৃপা করেন যুধিষ্ঠিরকে। বররূপে এক আশ্চর্য পাত্র দেন যুধিষ্ঠিরকে। তামার এ পাত্রটির গুণ হল রান্না করা ফল শাক-সবজি অথবা আমিষ দ্রব্য রাখা হলে, যতক্ষণ অবধি দ্রৌপদী অনাহারে থাকবেন ততক্ষণ পাত্রের অন্ন ফুরাবে না। দ্রৌপদীর খাওয়া শেষ হওয়ামাত্র অন্নও নিঃশেষিত হবে।
সূর্যদেবের দেওয়া সে আশ্চর্যপাত্র নিয়ে অত্যন্ত খুশি হয়ে যুধিষ্ঠির পুরোহিত ধৌম্যকে প্রণাম করলেন সবার প্রথমে। তারপর ভাইদের এ আনন্দ সংবাদ জানালেন। আর দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে তত্ক্ষণাৎ রান্নাঘরে গেলেন। পাত্রটির গুণাগুণ পরীক্ষা করবার জন্য তাঁর আর তর সইছিল না। ভাঁড়ারে যা ছিল সেই সব দিয়ে তৈরি হল নানানরকমের সুস্বাদু আহার্য। প্রথমে ব্রাহ্মণেরা ভোজন করলেন। দেবব্রাহ্মণপিতৃগণ আর অন্যান্য প্রাণিদের ভোজনের পর অবশিষ্ট যে অন্ন, তাকে বলা হয় বিঘস। ছোট ভাইদের খাইয়ে যুধিষ্ঠির নিজে সেই বিঘস অন্ন ভোজন করতে বসলেন। সবার ভোজনাদি শেষ হলে দ্রৌপদী আহার করলেন। দ্রৌপদীর খাওয়া শেষ হতেই আশ্চর্যজনকভাবে পাত্রের অন্নও শেষ হয়ে গেল। এ ভাবে বনে চলার পথে প্রথম প্রাপ্তি হল যুধিষ্ঠির। স্বয়ং বেদ বলেছেন বিচরণ করতে। সে পথ আত্মশুদ্ধির পথ, বিবেকলাভের পথ, তপস্যার আর মুক্তির পথ। সে পথে পরিব্রাজকের মন নিয়ে চললেন যুধিষ্ঠির। সঙ্গে চললেন পত্নী আর ভাইয়েরাও।
ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে