রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সৌতির বলে যাওয়া মহাভারতের গল্প তার গতিতে এগিয়ে চলেছে৷ কৌরব পাণ্ডবদের কথা বলবার আগে তো অবশ্যই তাদের পূর্বপুরুষদের কথা বলা জরুরি৷ আর এখানে উত্সুক শ্রোতা যখন সেই বংশেরই উত্তরাধিকারী রাজা জনমেজয়, তখন প্রসঙ্গ যে আসবেই সেটা স্বাভাবিক৷ সৌতি বলে চলেছেন, প্রজাপতি ব্রহ্মার পুত্র মনু আর মনুর পুত্র ইলার পুত্র ছিলেন পুরূরবা৷ পুরূরবার পৌত্র নহুষের যতি অযাতি প্রভৃতি ছয়পুত্রের অন্যতম হলেন এই যযাতি৷ মহাভারত বলছেন, যযাতি প্রবল বিক্রমের জোরে সম্রাট হয়েছিলেন৷ যযাতির গল্প বলবার আগে বরং যযাতির সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষজনের কথা আগে জেনে নেওয়া যাক৷

দেবতা আর অসুরদের মধ্যে বিবাদ চিরন্তন৷ একবার তিন ভুবনের সম্পত্তি কে পাবে সেই নিয়ে দেবতা আর অসুরদের মধ্যে বিবাদের সূত্রপাত হয়৷ দেবতারা অসুরদের জয় করবার ইচ্ছায় যে যজ্ঞের আয়োজন করেছিল, তাতে বৃহস্পতিকে নিজেদের পুরোহিত বলে স্বীকার করেন আর দৈত্যেরা শুক্রাচার্যকে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য ছিলেন খুব শক্তিশালী৷ তিনি মৃতসঞ্জীবনীবিদ্যা জানতেন৷ ফলে দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধে যদি কোনও দানবের প্রাণহানি ঘটত, শুক্রের বিদ্যায় তত্ক্ষণাৎ সে প্রাণ ফিরে পেত৷ এই বিদ্যা আবার দেবপুরোহিত বৃহস্পতি জানতেন না৷ ফলত, দেবতারা অসুরদের পরাক্রমের কাছে নত হতে হবে এই আশঙ্কায় বৃহস্পতিপুত্র কচের শরণাপন্ন হলেন৷ যুবাপুরুষ তিনি৷ তিনিই পারেন, শত্রুর ঘরে হানা দিয়ে সেই বিদ্যে শিখে আসতে৷ দেবতারা কচকে ছলের আশ্রয় নেবার কূটবুদ্ধি দিলেন৷ তাঁরা জানতেন, শুক্রাচার্যের কন্যাই জীবন, ওই হল তাঁর দুর্বল জায়গা৷ সুতরাং একমাত্র সেই কন্যাকে যদি তুষ্ট করতে পারেন কচ, তবেই কাজ হাসিল হতে পারেন৷ কচও দেবতার কথায় উপস্থিত হলেন অসুররাজ বৃষপর্ব্বার বাড়িতে৷ শুক্রাচার্য কচের শিষ্য হবার অভিপ্রায় শুনে রাজি হলেন হৃষ্টমনেই৷ এদিকে কচও তাঁর উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য নিবিষ্ট মনে ব্রহ্মচর্যব্রত পালন করতে লাগলেন৷ আর দেবতাদের সঙ্গে করা পূর্বপরিকল্পনামতো পিতার অনুরাগভাজন হবার মানসে কন্যা দেবযানীকেও নানা উপায়ে তুষ্ট করার চেষ্টা করতে লাগলেন৷

কচের কাছে দেবযানী তাঁর সঞ্জীবনীবিদ্যায় অভিজ্ঞ পিতার কাছে পৌঁছনোর এক মাধ্যম ছিলেন৷ রূপবান, সুভাষী, গানবাজনায় চৌখস কচ-এর প্রতি অনুরক্ত হলেন দেবযানী৷ এভাবেই বেশ দিন কাটছিল৷ কিন্তু শেষরক্ষা হল না৷ একদিন দানবেরা কচের এই অভিসন্ধি টের পেয়ে গেল এবং সঞ্জীবনীবিদ্যা ও তার সঙ্গে নিজেদের ঘরের মেয়েকে বাঁচাবার জন্য কচকে বধ করল৷ এদিকে কচকে দেখতে না পেয়ে দেবযানী আকুল হলেন৷ পিতা কন্যার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কচকে মৃতসঞ্জীবনীবিদ্যার সাহায্যে বাঁচিয়ে দিলেন৷ এমনি করে কচকে দৈত্যরা আবারও মেরে ফেলল এবং পুনরায় তিনি প্রাণ ফিরে পেলেন শুক্রের বিদ্যায়৷ তৃতীয়বার দৈত্যরা আর ঝুঁকি নিল না? তারা এবার কচকে মেরে ফেলার পর পুড়িয়ে সেই ছাই সুরার সঙ্গে মিশিয়ে স্বয়ং শুক্রাচার্যকেই পান করতে দিল৷ কচের বিয়োগে দেবযানীর শোক যথারীতি পিতাকে আকুল করল৷ পুত্রীকে তিনি সান্ত্বনা দিলেন এই বলে যে, মৃত্যু অতি স্বাভাবিক৷ কচের সঙ্গে যখন এমন ব্যাপার বারংবার ঘটছে তখন কচের মৃত্যু মেনে নেওয়াই যুক্তিসংগত৷ দেবযানী মানতে নারাজ৷ মহর্ষি অঙ্গিরার পৌত্র এবং স্বয়ং বৃহস্পতির পুত্র বিদ্বান সুপুরুষ কচ, যিনি তাঁর এমন প্রীতির পাত্র, সেই কচের এমন অগৌরবের মৃত্যু তিনি মানতে নারাজ৷ এবারেও পিতা পুত্রীর কাতর অনুরোধ ফেলতে পারলেন না৷ সঞ্জীবনীবিদ্যার প্রভাবে কচ গুরু শুক্রাচার্যের উদরস্থ অবস্থাতেই সংজ্ঞালাভ করলেন৷ কিন্তু গুরুর মৃত্যু হবে এই ভয়ে বাইরে আসতে পারলেন না৷ উদরস্থ অবস্থাতেই গুরুকে তাঁর এমন অবস্থাপ্রাপ্তির কারণ জানালেন৷ শুক্রাচার্য সব শুনে কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়ে কন্যা দেবযানীকে বললেন, ‘বৎসে, কচের জীবন অথবা আমার জীবন কোনটা তোমার কাছে বেশি কাম্য? কারণ আমার মৃত্যু ছাড়া কচকে বাঁচানো সম্ভব নয়৷’

দেবযানী একথা শুনে আকুল হয়ে বলে উঠলেন, ‘পিতঃ! আপনার আর কচের এই উভয়ের মৃত্যুই আমায় অগ্নিতুল্য দগ্ধ করবে৷’ তাহলে এ থেকে মুক্তির উপায়? গত্যন্তর না দেখে শুক্রাচার্য পুত্রতুল্য প্রিয় শিষ্যকে মৃতসঞ্জীবনীবিদ্যা দান করলেন৷ কচেরও এখানে আসবার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল৷ অসীম বলশালী হলেন তিনি৷ শুক্রাচার্যের কাছে থাকবার মেয়াদ যখন ফুরোল, কচ স্বর্গে ফিরে যাবার উপক্রম করলেন৷ দেবতাদের কাছে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ৷ ইতিমধ্যে দেবযানী তাঁর প্রণয়প্রার্থিনী হলেন৷ জানালেন তাঁর মনের অভিপ্রায়৷ বিনম্রসুরে কচ তাঁর প্রার্থনা ভগিনী সম্বোধনে ফিরিয়ে দিলেন৷ নিজের কাজের প্রতি একনিষ্ঠ তিনি৷ বড় গুরুদায়িত্ব তাঁর কাঁধে সঁপেছেন দেবতারা৷ অনন্যমনা কচের প্রতি ক্রুদ্ধ হলেন দেবযানী৷ উচ্চারণ করে বসলেন নির্মম অভিশাপবাণী, কচ যে বিদ্যা নিয়ে খুশিমনে স্বর্গের পথে চলেছেন, তাঁর সে বিদ্যা কখনও ফলপ্রসূ হবে না৷ এদিকে কচ তাঁর ওপর ন্যস্ত কাজ ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছেন৷ প্রকৃত দূতের হয়তো এই কাজ! দেবযানীকে তুষ্ট করে যে তাঁর পিতা তথা দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের সান্নিধ্যলাভ করেছেন, এতে তিনি কোনও দোষ দেখেন না৷ তাই দেবযানীর অভিশাপে তিনি বিশেষ বিচলিত হলেন না৷ তবে কিছুটা বিরক্ত হলেন বইকি৷ কারণ গুরুকন্যা দেবযানীকে তিনি ভগিনীজ্ঞানই করে এসেছেন এতাবত্কাল৷ কামপ্রণোদিত হয়ে করা তাঁর সেই অভিশাপ মেনে নিতে পারলেন না৷ অভিশাপ দিলেন তিনিও৷ কোনও ঋষিপুত্র কখনও দেবযানীর পাণিগ্রহণ করবেন না৷

দেবযানীর অভিশাপ ছিল কেবল কচের প্রতি৷ বুদ্ধিমান কচ জানতেন, অধীত এই বিদ্যা তিনি নিজে প্রয়োগ করতে না পারলেও অন্য দেবতাদের শিখিয়ে দিতে পারবেন৷ সেক্ষেত্রে প্রয়োগে কোনও বাধা থাকবে না৷ এভাবে সঞ্জীবনীবিদ্যার শিক্ষক হলেন কচ আর সেই বিদ্যা রয়ে গেল দেবতাদের মধ্যে৷

Skip to content