গরুড়ের জন্মবৃত্তান্ত৷ ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে৷
মহাভারত হল কৌরব ও পাণ্ডবভাইদের জন্ম, তাদের বড় হওয়া, কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে তাদের যুদ্ধ এসবকে কেন্দ্র করে নানান আখ্যানের সমাহার। সুতগণ এক এক আখ্যান বলতে গিয়ে জুড়েছেন আরও কতশত আখ্যান। সেইসব আখ্যানমালা আর নানা চরিত্র নিয়েই এই গল্প বলা— মহাভারতের আখ্যানমালা। প্রতি সপ্তাহে এই ধারাবাহিকটি লিখছেন বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজ -এর অধ্যাপক ড. অদিতি ভট্টাচার্য।
পর্ব-২
জনমেজয়ের যজ্ঞসভায় শোনা আখ্যান সৌতি উগ্রশ্রবা বলে চলেছেন নৈমিষারণ্যে ঋষিমহর্ষিদের উপস্থিতিতে৷ মহাভারতের সে অপূর্ব আখ্যান শুনে যেন তাঁদের মন আর ভরে না৷ তাই আরও বিশদে শুনতে চান সকলে৷ সকলের হয়ে শৌনকই এই আর্জি রাখলেন সৌতির কাছে৷ সৌতিও নিরাশ করলেন না৷ এ আখ্যান বক্তা আর শ্রোতা উভয়ের পক্ষেই তো আনন্দজনক৷ সৌতির কাছে শৌনক জানতে চেয়েছিলেন সর্পসত্রের আসল কারণ৷ সৌতি বলা শুরু করেছিলেন সে আখ্যান৷ প্রজাপতির কশ্যপের ভার্যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কদ্রু ও বিনতা নামের দক্ষ প্রজাপতির দুই কন্যা৷ কদ্রুর সন্তান ছিল সর্পকুল৷ দৈবের দ্বারা তাড়িত হয়েই যেন কদ্রু এদের অতি তুচ্ছ কারণে তীব্র অভিশাপ দেন৷ মা হয়ে সন্তানদের প্রতি তাঁর অভিশাপ ছিল, রাজা জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞের আগুন এদের সকলের মৃত্যুর কারণ হবে৷ অন্য সকল অভিশাপ খণ্ডানোর উপায় থাকলেও মায়ের অভিশাপ খণ্ডাবে এমন সাধ্য কার! সাপেদের তীব্র দংশনে আর বিষের প্রভাবে সকলে উন্মত্তপ্রায় হয়ে থাকে, তাই হয়তো নিয়তির এমন বিধান! কদ্রুর সন্তান যেমন ছিল সর্পকুল৷ তেমনি কদ্রুর ভগিনী বিনতার পুত্র ছিলেন গরুড়৷ শৌনক প্রশ্ন করেন কে এই গরুড়? কীভাবে তার জন্ম হয়েছিল, কীভাবেই বা সে অমিতশক্তির অধিকারী হয়েছিল, কীভাবেই বা কশ্যপের পুত্র পক্ষীরাজ হলেন, এই ছিল তাঁর প্রশ্ন৷ সৌতি তখন সেই প্রাচীন আখ্যান বর্ণনা করেন৷ প্রজাপতি কশ্যপ পুত্রকামনা করে পুত্রযাগ করেন৷ তাঁর সেই যজ্ঞে ঋষি, দেবতা, গন্ধর্বেরা শামিল হয়েছিলেন সাহায্য করবার জন্য৷ একদিকে ইন্দ্র যেমন যজ্ঞের কাঠ আনবার দায়িত্ব পেয়েছিলেন, অন্যদিকে তেমনি অন্যান্য দেবতা মুনিরাও সে ভার পেয়েছিলেন৷ এত বড় যজ্ঞ বলে কথা কাঠও তো নিতান্ত সামান্য নয়৷ মুনিদের মধ্যে বালখিল্যমুনিরাও এই ভার পেয়েছিলেন৷ এই বালখিল্যমুনিরা আকৃতিতে অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ হলেও বড় সামান্য ছিলেন না৷ বলশালী ইন্দ্র নিজের বলের অনুরূপ বিপুল পরিমাণ কাঠ যখন বয়ে নিয়ে আসছিলেন, তখন এই খুদে বালখিল্যমুনিদের সকলে মিলে একটি পাতার বোঁটা বয়ে নিয়ে যেতে দেখে অত্যন্ত অবাক হলেন৷ বালখিল্যমুনিরা সেই সময় দীর্ঘ অনাহারে প্রায় বলহীন ছিলেন৷ ওই পাতার বোঁটার ভারে তাঁরা একটি গর্তে পড়ে কষ্ট পাচ্ছিলেন৷ ইন্দ্র স্বভাবগত অহংকারবশত নিদারুণ কাণ্ড ঘটিয়ে বসলেন৷ তাঁদের অক্ষমতা নিয়ে উপহাস করলেন আর লঙ্ঘন করে রওনা দিলেন যজ্ঞস্থলে৷ ফিরে আর তাকিয়ে দেখলেন না৷ এতে তো সাধারণ মানুষেরই ক্রোধ জন্মানোর কথা৷ আর বালখিল্যমুনিরা তো সাধারণ কেউ ছিলেন না৷ তাঁরা ইন্দ্রকে ভয় দেখাতে মনের মতো বেগবান আর একজন ইন্দ্রের কামনায় যজ্ঞ শুরু করলেন৷ এখন, দেবতাদের শ্রেষ্ঠ পদ ইন্দ্র৷ তা তো একটাই হতে পারে, দুটো কীভাবে সম্ভব? এদিকে বালখিল্যমুনিদের যজ্ঞও বিফলে যেতে পারে না৷ প্রজাপতি কশ্যপ তখন এর একটা মীমাংসা করে দিলেন৷ বালখিল্যমুনিদের তিনি আশ্বস্ত করে বললেন, আপনার সংকল্পানুসারে অতি বলশালী এবং অত্যুত্সাবহী পক্ষীন্দ্রের জন্ম হোক৷ প্রজাপতি কশ্যপের পুত্রযাগ আর বালখিল্যমুনিদের ইন্দ্রকামনায় যাগ যেন এক সুরে এসে মিলে গেল৷ বিনতার গর্ভে যথাসময়ে জন্ম নিল অরুণ আর গরুড় নামের দুই পাখি৷ অরুণ ছিলেন সূর্যসারথি৷ আর গরুড় মহাবলশালী পক্ষীন্দ্র৷ সাপেদের দাসত্ব থেকে মাকে রক্ষার করবার জন্য গরুড় গিয়েছিলেন অমৃত আহরণে৷ সেই সময়ে বিবিধ বাধাবিঘ্ন পার করবার জন্য প্রয়োজনে নানাবিধ শরীর ধারণ করেছিলেন গরুড়৷ সেইসব আকৃতির মধ্যে উল্লেখ্য ছিল গরুড়ের স্বর্ণময় আকৃতি দেবতাদের আশ্রয়ে যে অমৃত, তা নিয়ে আসা তো বড় সহজ কথা নয়৷ তারপর সেখানে রয়েছেন দেবাদিদেব ইন্দ্র৷ কিন্তু বালখিল্যমুনিদের আশীর্বাদে, পিতামাতার আশীর্বাদে যাঁর জয়যাত্রা অপ্রতিহত, তাঁকে তো দমানো কঠিন৷ ইন্দ্রের সাথে সম্মুখসমরেও তিনি দমেননি, বরং বজ্রের সম্মানপ্রদর্শনার্থে একটি পালক ত্যাগ করেন৷ স্বর্ণময় সে অপূর্ব পক্ষ দেখে তাঁকে উপস্থিত সকলে সুপর্ণ বলে সম্বোধন করতে লাগল৷ সৌতির মুখে শৌনকাদি মুনিরাও সেদিন শোনেন, মহাভারতের সেই গল্প, যেখানে বিষ্ণু গরুড়ের পরাক্রমে তুষ্ট হয়ে বলছেন, আজ থেকে তুমি আমার বাহন হলে৷ অন্যদিকে যখন ইন্দ্রও পরে গরুড়ের পরাক্রমে তুষ্ট হলেন, গরুড় দেবরাজের কাছে চেয়ে নিলেন এক বর, সাপেরা যেন তাঁর খাদ্য হয়৷ সাপেদের দাসত্ব আর অন্যায় আবদারে তাঁর ও তাঁর মায়ের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল৷ সে আর এক গল্প৷
গল্প শুনে মুগ্ধ শ্রোতারা৷ আর গল্পের আসরে সমবেত বেদজ্ঞ ঋষি বিদ্বজ্জনেদের মনেও দোলা লাগিয়ে গেল না এই ভাবনা যে, গরুড়ের এই আখ্যান কি বেদের তার্ক্ষ্য বা গরুত্মান্ এর আখ্যানের অনুরণন? বেদের তার্ক্ষ্য ছিলেন সূর্যের অতি বেগবান ঘোড়া যার আবার পাখা আছে বলে ঋষিরা কল্পনা করেছেন৷ তাঁকে বেদের অন্যত্র আবার শ্যেনপাখি বলে তারই উল্লেখ আছে৷ বেদের সবিতা বা আদিত্যদেবই তো বিষ্ণু৷ বিষ্ণুর দ্রুতগামী অশ্ব যার নামও ছিল সুপর্ণ, কোথাও বা তিনি গরুত্মান্, যিনি সোমহরণ করেছিলেন, তিনিই কি মহাভারতের পক্ষীন্দ্র গরুড়? আর সোমই কি অমৃত? এ তো আর যুক্তিতর্কমীমাংসার আসর নয় ! বরং মুগ্ধ শ্রোতার আসনে তখন রাজা আর ঋষিকুল৷ একের পর এক গল্পকথার মালা গেঁথে চলেছেন সৌতি৷