ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
ধীবররাজের গৃহে বেড়ে উঠতে লাগলেন সত্যবতী। দাসরাজার কোনও সন্তানাদি ছিল না। ফলে সত্যবতী একাধারে তাঁর পুত্র আর কন্যা দুই-ই ছিলেন। দাসরাজার নৌকো যাত্রী পারাপার করত। কন্যা পিতার সাহায্য করবার জন্য এই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। দীর্ঘকাল ধরে ধীবরদের সঙ্গ করবার জন্য তাঁর শরীরে মৎস্যের গন্ধ থাকায় অনেকে তাঁকে মৎস্যগন্ধা বলেও ডাকত। ধীবরকন্যার শরীরে যে মৎস্যের গন্ধ থাকবে এ তো স্বাভাবিক ! কিন্তু ধীবরদের রাজ্যে এ কন্যা যেন বেমানান এ সকলেই বুঝতে পারত। মেয়েটিও বুঝতে পারতেন এ জায়গা তার নয়। আকুল হত তাঁর মন প্রাণ কি তার আসল পরিচয়? জন্মদাতা পিতামাতার কথা জানতে ইচ্ছে করত। কিন্তু কে তাঁকে বলে দেবে সেসব কথা! তাই মনের কথা মনেই থাকত।
তারপর কোনও একদিন পরাশরমুনি তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে নৌচালনরত ধীবরকন্যাকে দেখে মুগ্ধ হলেন, জানতে চাইলেন, কেন সে এরূপ কষ্টসাধ্য কাজ করছে। কন্যা স্বেচ্ছায় পিতার কাজের ভার কমাতে এমন দায়িত্ব নিয়েছেন জেনে তাঁর মুগ্ধতা বাড়ল বই কমল না। পরাশরমুনির ইতিপূর্বেই মৎস্যগন্ধার পিতৃপরিচয় জানতেন। সত্যবতীর এ অতি দুর্বলস্থান সেসব বুঝেশুনেই তিনি বললেন, তোমার পিতৃপরিচয় আমি জানি। এতবছর ধরে যে দুঃখকে লালন করে এসেছেন মেয়েটি, আজ অপরিচিত এক পুরুষের কাছে সে দুঃখকে ভাগ করে নেওয়া যাবে জেনে, সে শোক-এর সাময়িক প্রশম হবে জেনে আকুল হয়ে ওঠেন। এদিকে পরাশরও মনে মনে কামনা করেছিলেন সত্যবতীকে। সামান্য সমবেদনাটুকু যেন দাহে মলমের কাজ করল। কিছুটা আত্মপরিচয় জানার প্রলোভনে, কিছুটা আবার পরাশরমুনির শাপের ভয়ে সত্যবতী সমর্পণ করলেন নিজেকে পরাশরের কাছে। সত্যবতী অবিবাহিত। এমতাবস্থায় আবেগের বশে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় অনুশোচনা করতে দেখে পরাশরমুনি আশ্বস্ত করলেন তাঁকে। গোপন রইল সম্পূর্ণ ঘটনা। উপরন্তু মৎস্যগন্ধার অভিলাষক্রমে তাঁকে বর দিলেন পরাশরমুনি, সন্তানের জন্মের পর আবার কুমারী হবেন তিনি আর সেই থেকে পরাশরের বরে উত্তম গাত্রগন্ধের অধিকারিণী হলেন সত্যবতী। এক যোজন দূর থেকেও সত্যবতীর শরীরের অপূর্ব গন্ধ আঘ্রাণ করতে পারত লোকে। যোজনগন্ধাকে গন্ধবতীও বলা হত। পরাশর আর সত্যবতীর পুত্র জন্মালেন যথাসময়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে যমুনাদ্বীপে। নাম হল দ্বৈপায়ন। পরবর্তীকালে তিনিই বেদবিভাগ করেন বলে ব্যাস নামে পরিচিতি লাভ করেন। যাই হোক এসব বৃত্তান্ত জনমনুষ্যের কর্ণগোচর হয়নি।
সত্যবতীর যথার্থ পরিচয় পেয়ে দেবব্রত দাসরাজার প্রস্তাব মেনে নিলেন। দাসরাজার অন্যায় আবদারও মেনে নিলেন যে তিনি নন, বরং সত্যবতীর সন্তানই হবেন কুরুবংশের উত্তরাধিকারী। কিন্তু না, দাসরাজার শর্ত এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর আশঙ্কা ছিল, এমন উপযুক্ত পুত্র দেবব্রত৷ তাঁর সন্তানও যদি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন তবে তাঁর কন্যার কীই বা গুরুত্ব থাকবে? তিনি বলে বসলেন সেই ভীষণ শর্তের কথা। পিতার ভালোলাগার কাছে দেবব্রতের এ শর্তও যেন অতি সামান্য ছিল। দাসরাজার কথা মেনে নিয়ে তিনি সেই ভীষণ প্রতিজ্ঞা করলেন, কখনও বিবাহই করবেন না। সত্যবতীর সন্তানই হবেন এ পরিবারের উত্তরাধিকারী। দেবব্রতের এ ভীষণ প্রতিজ্ঞার কথা শুনে চমকিত হল রাজ্যবাসী। পরিচিতসমাজে ভীষ্ম নাম হল তাঁর। ভীষণ সে প্রতিজ্ঞার ভার আর সে নাম বয়ে নিয়ে চললেন আজীবন।
নিজে উদ্যোগ নিয়ে পিতার বিবাহ দিলেন দেবব্রত ভীষ্ম। পিতার জন্য এমন আত্মত্যাগে পিতা আর কীই বা পারেন বলতে! তিনি বললেন, ‘পুত্র! তোমায় ইচ্ছামৃত্যুর বর দিলাম। তোমার অনুমতিক্রমেই মৃত্যু তোমার দ্বারস্থ হবে।’ সত্যবতীর গর্ভে শান্তনুর দুটি পুত্র জন্ম নিল, চিত্রাঙ্গদ আর বিচিত্রবীর্য। বিদ্বান বীর চিত্রাঙ্গদের ছিল বংশগরিমা, বীরত্বের অহংকার। মায়ের স্নেহে, পিতার আদরে, বড়ভাইয়ের স্নেহচ্ছায়ায় বড় হয়ে উঠতে উঠতে ভুলে গিয়েছিলেন, যে শুধু পূর্বপুরুষদের কীর্তি তাঁকে বা তাঁর রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। ভুলে গিয়েছিলেন বিনয়ের শিক্ষা। তার মাশুল তাঁকে দিতে হল। গন্ধর্বরাজার সঙ্গে যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হল।
প্রতিজ্ঞামতো ভীষ্ম সিংহাসনে আরোহণ করতে পারবেন না। অগত্যা কিশোরবয়স্ক বিচিত্রবীর্য কুরুরাজসিংহাসনে আসীন হলেন। বড়ভাই ভীষ্ম নিলেন রাজ্যের দায়িত্ব। তবে ভীষ্ম ছিলেন সত্যপরায়ণ আর বুদ্ধিমান। বিমাতা সত্যবতীর মতই ছিল রাজ্যশাসনের ক্ষেত্রে শেষকথা। বিচিত্রবীর্য যৌবনে পদার্পণ করলে ভীষ্ম যখন সংবাদ পেলেন কাশীরাজের পরমাসুন্দরী তিনকন্যা বিবাহযোগ্যা আর তাদের স্বয়ংবরসভার আয়োজন করা হয়েছে, তিনি উপস্থিত হলেন সে সভায়। উপস্থিত হয়ে তিনকন্যাকেই অপহরণ করলেন নিজের বৈমাত্রেয় ভ্রাতার সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার মানসে। তিনকন্যার বড়টি মনে মনে ভালোবেসেছিল শাল্বরাজাকে। স্পষ্টভাষায় ভীষ্মকে সে জানাল সে কথা। ভীষ্ম তাকে মুক্তি দিলেন। অম্বিকা আর অম্বালিকার সঙ্গে বিবাহ হয়ে গেল বিচিত্রবীর্যের। এদিকে বিচিত্রবীর্য ইতিপূর্বে কখনও নারীসঙ্গ করেননি। সুন্দরী দুই পত্নীকে কাছে পেয়ে অত্যন্ত কামোন্মত্ত হয়ে পড়লেন। এই মাত্রাতিরিক্ত আসক্তিই তাঁর জীবনে কাল হল। যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হলেন তিনি। কুরুবংশের শেষ প্রদীপও অকালে নির্বাপিত হল।
সত্যবতীর এ আঘাত বড় আঘাত। পতিবিয়োগ আর তারপরে এক পুত্রের বিয়োগে কোনও মতে অপর পুত্রকে নিয়ে বড় আশার সংসার গড়েছিলেন। কিন্তু বিধাতাপুরুষের ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। কে হবে এ বংশের উত্তরাধিকারী? পুত্রবধূদুটিও বড় ছেলেমানুষ। তাদেরই বা কী অবলম্বন হবে? এসব ভেবে তিনি ভীষ্মকে ডেকে পাঠালেন একদিন। বললেন, এ বংশকে ভীষ্মই পারেন রক্ষা করতে। নিয়োগপ্রথার মাধ্যমে ভীষ্মের সন্তানের মাতা হোক অম্বিকা আর অম্বালিকা। এই ছিল সত্যবতীর অভিলাষ। তাঁর পালকপিতার জন্যই ভীষ্মের এমন কঠিন প্রতিজ্ঞা। সে প্রতিজ্ঞা যদি কোনওমতে ভঙ্গ করানো যায়! কিন্তু ভীষ্ম তাঁর প্রতিজ্ঞায় অটল।
ভীষ্ম বলে ওঠেন, এ নিয়োগপ্রথায় কোনও গুণবান ব্রাহ্মণ তাঁদের সহায় হতে পারেন। সত্যবতী ভীষ্মের বিচক্ষণতার ওপর ভীষণভাবে নির্ভর করতেন। তাঁর মনে হল, এই উপযুক্ত সময়, তাঁর কানীনকালের গোপন কথা প্রকাশ করবার। হয়তো পরাশরপুত্র, তাঁর গর্ভজাত সন্তান বেদব্যাস, যাকে তিনি সে কোন শৈশবে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, এ দুঃসময়ে তাঁদের রক্ষাকর্তা হতে পারেন। সত্যবতী অকপটে সে সত্য উন্মোচন করলেন সপত্নীপুত্রের কাছে। ভীষ্ম সত্যবতীর প্রতি অত্যন্ত আস্থাশীল ছিলেন। কুরুবংশের কল্যাণই ছিল তাঁর সবসময়ের কাম্য। মায়ের আহ্বানে বেদব্যাস উপস্থিত হলেন মায়ের প্রিয়কার্য করবার মানসে। বহু ঝড়জলের পর মাতাপুত্রের মিলন হল চোখের জলে।
ব্যাস ছিলেন অত্যন্ত কুরূপ। তিনি জানতেন তাঁর এমন বিকৃত রূপ হয়তো অম্বিকা কিংবা অম্বালিকা সহ্য করতে পারবেন না। মাতা সত্যবতীকে সে বিষয়ে সতর্ক করে বললেন, অম্বিকা ও অম্বালিকা যেন মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আসেন। সত্যবতী ছিলেন বুদ্ধিমতী। তিনি জানতেন কাশীরাজের কন্যারা শ্বশ্রূমাতার কথায় বংশরক্ষার স্বার্থে অপরিচিত পুরুষগমন মেনে নিলেও সে পুরুষের কদর্যরূপ বা অদ্ভুতবেশ মেনে নেবেন না। রাজমাতা তিনি। রাজনীতিতে তিনি বড় অপটু নন। সব জেনেবুঝেও পুত্রবধূদের ধর্মের উপদেশ দিলেন, কখনও আবার বংশরক্ষার দায় যে তাঁদেরও সে কথা বুঝিয়ে তৈরি করলেন তাঁদের মন। কিন্তু নিজপুত্র বেদব্যাসের বিষয়ে কিছুই প্রায় জানালেন না।
বিবাহের পর কটা দিনই বা পতিসঙ্গলাভ হয়েছে! তারপর তো বিধবার জীবন। অম্বিকা মনে মনে ভেবেছিলেন, হয়তো ভীষ্ম আসবেন তাঁর কাছে, ভীষণ সে প্রতিজ্ঞা ভেঙে, নয়তো বা অপর কোনও সুপুরুষ কুরুকুলশ্রেষ্ঠ! রাত্রিকালে দেবরস্থানীয় কুরুবংশের পুরুষদের কথা মনে করতে করতে অম্বিকার যখন অপেক্ষার অবসান ঘটল, সামনে পিঙ্গল জটাশ্মশ্রুধারী বেদব্যাসকে দেখে তাঁর প্রায় মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হল। একপ্রকার অনিচ্ছাকৃত সে মিলনে জন্ম নিলেন ধৃতরাষ্ট্র। তপোবলশালী জন্মদাতার পিতার অভিশাপে তিনি হলেন জন্মান্ধ। আর কনিষ্ঠা অম্বালিকা বেদব্যাসকে দেখে ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিলেন। অম্বালিকার গর্ভে বেদব্যাসের যে সন্তান জন্ম নিলেন তিনি পিতার অভিশাপে জন্ম থেকে পাণ্ডুরোগগ্রস্ত হলেন। এদিকে সত্যবতী চেয়েছিলেন সুস্থ সবল সন্তান। তাঁর সে ইচ্ছা চরিতার্থ না হওয়ায় পুনরায় তিনি জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ অম্বিকাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে পাঠালেন বেদব্যাসের কাছে। অম্বিকা এমন বঞ্চনা জেনেশুনে আর মেনে নেবেন কেন? তিনি আরও বড় ছলনার আশ্রয় নিলেন। তিনি আর গেলেন না। পাঠিয়ে দিলেন নিজের এক দাসীকে বেদব্যাসের কাছে৷ দাসী বেদব্যাসকে অত্যন্ত পরিচর্যা করল আর বেদব্যাসও দাসীর সঙ্গসুখে আনন্দলাভ করলেন। দাসীর গর্ভে জন্ম হল বিদুরের। বেদব্যাসের আশীর্বাদে বিদুর অত্যন্ত জ্ঞানী ও ধর্মপরায়ণ হলেন।
বেদব্যাস চলে যাওয়ার আগে মা সত্যবতীকে এই সমস্ত বৃত্তান্তই জানিয়ে গেলেন। জন্মান্ধ বলে ধৃতরাষ্ট্র রাজ্যলাভ করলেন না। আর অন্যদিকে শূদ্রাদাসীর সন্তান বিদুরও বিদ্বান হওয়া সত্ত্বেও রাজ্য থেকে বঞ্চিত হলেন। দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও রাজা হলেন পাণ্ডু। সত্যবতীর সংসার ধীরে ধীরে ভরে উঠতে লাগল। বিবাহ হল ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর। তাদেরও সন্তানাদি হল। পাণ্ডুরাজা পরামর্শদাতা হিসেবে পাশে পেলেন একাধারে সাংসারিক ও রাজনৈতিক উভয়ত তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্না পিতামহী সত্যবতীকে অন্যদিকে পিতা বেদব্যাস ও পিতৃব্য ভীষ্মকে পেলেন অভিভাবক হিসেবে।
এরও বহুকাল পর পাণ্ডুর মৃত্যু হয়। পাণ্ডুর মৃত্যুশোক সত্যবতী সহ্য করতে পারেননি। দীর্ঘজীবন তাঁর। আজন্ম কত দুঃখশোক সয়েছেন। কিন্তু প্রাণপ্রিয় পৌত্রের মৃত্যু তাঁর হৃদয়ে বড় বেজেছিল। বুঝেছিলেন এবার সংসারের মায়াত্যাগের সময় এসেছে। এরপর বহুদিনের সঙ্গিনী দুই পুত্রবধূকে নিয়ে তিনি বনবাসিনী হন এবং যোগবলে মৃত্যুবরণ করেন।
তারপর কোনও একদিন পরাশরমুনি তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে নৌচালনরত ধীবরকন্যাকে দেখে মুগ্ধ হলেন, জানতে চাইলেন, কেন সে এরূপ কষ্টসাধ্য কাজ করছে। কন্যা স্বেচ্ছায় পিতার কাজের ভার কমাতে এমন দায়িত্ব নিয়েছেন জেনে তাঁর মুগ্ধতা বাড়ল বই কমল না। পরাশরমুনির ইতিপূর্বেই মৎস্যগন্ধার পিতৃপরিচয় জানতেন। সত্যবতীর এ অতি দুর্বলস্থান সেসব বুঝেশুনেই তিনি বললেন, তোমার পিতৃপরিচয় আমি জানি। এতবছর ধরে যে দুঃখকে লালন করে এসেছেন মেয়েটি, আজ অপরিচিত এক পুরুষের কাছে সে দুঃখকে ভাগ করে নেওয়া যাবে জেনে, সে শোক-এর সাময়িক প্রশম হবে জেনে আকুল হয়ে ওঠেন। এদিকে পরাশরও মনে মনে কামনা করেছিলেন সত্যবতীকে। সামান্য সমবেদনাটুকু যেন দাহে মলমের কাজ করল। কিছুটা আত্মপরিচয় জানার প্রলোভনে, কিছুটা আবার পরাশরমুনির শাপের ভয়ে সত্যবতী সমর্পণ করলেন নিজেকে পরাশরের কাছে। সত্যবতী অবিবাহিত। এমতাবস্থায় আবেগের বশে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় অনুশোচনা করতে দেখে পরাশরমুনি আশ্বস্ত করলেন তাঁকে। গোপন রইল সম্পূর্ণ ঘটনা। উপরন্তু মৎস্যগন্ধার অভিলাষক্রমে তাঁকে বর দিলেন পরাশরমুনি, সন্তানের জন্মের পর আবার কুমারী হবেন তিনি আর সেই থেকে পরাশরের বরে উত্তম গাত্রগন্ধের অধিকারিণী হলেন সত্যবতী। এক যোজন দূর থেকেও সত্যবতীর শরীরের অপূর্ব গন্ধ আঘ্রাণ করতে পারত লোকে। যোজনগন্ধাকে গন্ধবতীও বলা হত। পরাশর আর সত্যবতীর পুত্র জন্মালেন যথাসময়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে যমুনাদ্বীপে। নাম হল দ্বৈপায়ন। পরবর্তীকালে তিনিই বেদবিভাগ করেন বলে ব্যাস নামে পরিচিতি লাভ করেন। যাই হোক এসব বৃত্তান্ত জনমনুষ্যের কর্ণগোচর হয়নি।
সত্যবতীর যথার্থ পরিচয় পেয়ে দেবব্রত দাসরাজার প্রস্তাব মেনে নিলেন। দাসরাজার অন্যায় আবদারও মেনে নিলেন যে তিনি নন, বরং সত্যবতীর সন্তানই হবেন কুরুবংশের উত্তরাধিকারী। কিন্তু না, দাসরাজার শর্ত এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর আশঙ্কা ছিল, এমন উপযুক্ত পুত্র দেবব্রত৷ তাঁর সন্তানও যদি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন তবে তাঁর কন্যার কীই বা গুরুত্ব থাকবে? তিনি বলে বসলেন সেই ভীষণ শর্তের কথা। পিতার ভালোলাগার কাছে দেবব্রতের এ শর্তও যেন অতি সামান্য ছিল। দাসরাজার কথা মেনে নিয়ে তিনি সেই ভীষণ প্রতিজ্ঞা করলেন, কখনও বিবাহই করবেন না। সত্যবতীর সন্তানই হবেন এ পরিবারের উত্তরাধিকারী। দেবব্রতের এ ভীষণ প্রতিজ্ঞার কথা শুনে চমকিত হল রাজ্যবাসী। পরিচিতসমাজে ভীষ্ম নাম হল তাঁর। ভীষণ সে প্রতিজ্ঞার ভার আর সে নাম বয়ে নিয়ে চললেন আজীবন।
নিজে উদ্যোগ নিয়ে পিতার বিবাহ দিলেন দেবব্রত ভীষ্ম। পিতার জন্য এমন আত্মত্যাগে পিতা আর কীই বা পারেন বলতে! তিনি বললেন, ‘পুত্র! তোমায় ইচ্ছামৃত্যুর বর দিলাম। তোমার অনুমতিক্রমেই মৃত্যু তোমার দ্বারস্থ হবে।’ সত্যবতীর গর্ভে শান্তনুর দুটি পুত্র জন্ম নিল, চিত্রাঙ্গদ আর বিচিত্রবীর্য। বিদ্বান বীর চিত্রাঙ্গদের ছিল বংশগরিমা, বীরত্বের অহংকার। মায়ের স্নেহে, পিতার আদরে, বড়ভাইয়ের স্নেহচ্ছায়ায় বড় হয়ে উঠতে উঠতে ভুলে গিয়েছিলেন, যে শুধু পূর্বপুরুষদের কীর্তি তাঁকে বা তাঁর রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। ভুলে গিয়েছিলেন বিনয়ের শিক্ষা। তার মাশুল তাঁকে দিতে হল। গন্ধর্বরাজার সঙ্গে যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হল।
প্রতিজ্ঞামতো ভীষ্ম সিংহাসনে আরোহণ করতে পারবেন না। অগত্যা কিশোরবয়স্ক বিচিত্রবীর্য কুরুরাজসিংহাসনে আসীন হলেন। বড়ভাই ভীষ্ম নিলেন রাজ্যের দায়িত্ব। তবে ভীষ্ম ছিলেন সত্যপরায়ণ আর বুদ্ধিমান। বিমাতা সত্যবতীর মতই ছিল রাজ্যশাসনের ক্ষেত্রে শেষকথা। বিচিত্রবীর্য যৌবনে পদার্পণ করলে ভীষ্ম যখন সংবাদ পেলেন কাশীরাজের পরমাসুন্দরী তিনকন্যা বিবাহযোগ্যা আর তাদের স্বয়ংবরসভার আয়োজন করা হয়েছে, তিনি উপস্থিত হলেন সে সভায়। উপস্থিত হয়ে তিনকন্যাকেই অপহরণ করলেন নিজের বৈমাত্রেয় ভ্রাতার সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার মানসে। তিনকন্যার বড়টি মনে মনে ভালোবেসেছিল শাল্বরাজাকে। স্পষ্টভাষায় ভীষ্মকে সে জানাল সে কথা। ভীষ্ম তাকে মুক্তি দিলেন। অম্বিকা আর অম্বালিকার সঙ্গে বিবাহ হয়ে গেল বিচিত্রবীর্যের। এদিকে বিচিত্রবীর্য ইতিপূর্বে কখনও নারীসঙ্গ করেননি। সুন্দরী দুই পত্নীকে কাছে পেয়ে অত্যন্ত কামোন্মত্ত হয়ে পড়লেন। এই মাত্রাতিরিক্ত আসক্তিই তাঁর জীবনে কাল হল। যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হলেন তিনি। কুরুবংশের শেষ প্রদীপও অকালে নির্বাপিত হল।
সত্যবতীর এ আঘাত বড় আঘাত। পতিবিয়োগ আর তারপরে এক পুত্রের বিয়োগে কোনও মতে অপর পুত্রকে নিয়ে বড় আশার সংসার গড়েছিলেন। কিন্তু বিধাতাপুরুষের ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। কে হবে এ বংশের উত্তরাধিকারী? পুত্রবধূদুটিও বড় ছেলেমানুষ। তাদেরই বা কী অবলম্বন হবে? এসব ভেবে তিনি ভীষ্মকে ডেকে পাঠালেন একদিন। বললেন, এ বংশকে ভীষ্মই পারেন রক্ষা করতে। নিয়োগপ্রথার মাধ্যমে ভীষ্মের সন্তানের মাতা হোক অম্বিকা আর অম্বালিকা। এই ছিল সত্যবতীর অভিলাষ। তাঁর পালকপিতার জন্যই ভীষ্মের এমন কঠিন প্রতিজ্ঞা। সে প্রতিজ্ঞা যদি কোনওমতে ভঙ্গ করানো যায়! কিন্তু ভীষ্ম তাঁর প্রতিজ্ঞায় অটল।
ভীষ্ম বলে ওঠেন, এ নিয়োগপ্রথায় কোনও গুণবান ব্রাহ্মণ তাঁদের সহায় হতে পারেন। সত্যবতী ভীষ্মের বিচক্ষণতার ওপর ভীষণভাবে নির্ভর করতেন। তাঁর মনে হল, এই উপযুক্ত সময়, তাঁর কানীনকালের গোপন কথা প্রকাশ করবার। হয়তো পরাশরপুত্র, তাঁর গর্ভজাত সন্তান বেদব্যাস, যাকে তিনি সে কোন শৈশবে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, এ দুঃসময়ে তাঁদের রক্ষাকর্তা হতে পারেন। সত্যবতী অকপটে সে সত্য উন্মোচন করলেন সপত্নীপুত্রের কাছে। ভীষ্ম সত্যবতীর প্রতি অত্যন্ত আস্থাশীল ছিলেন। কুরুবংশের কল্যাণই ছিল তাঁর সবসময়ের কাম্য। মায়ের আহ্বানে বেদব্যাস উপস্থিত হলেন মায়ের প্রিয়কার্য করবার মানসে। বহু ঝড়জলের পর মাতাপুত্রের মিলন হল চোখের জলে।
ব্যাস ছিলেন অত্যন্ত কুরূপ। তিনি জানতেন তাঁর এমন বিকৃত রূপ হয়তো অম্বিকা কিংবা অম্বালিকা সহ্য করতে পারবেন না। মাতা সত্যবতীকে সে বিষয়ে সতর্ক করে বললেন, অম্বিকা ও অম্বালিকা যেন মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আসেন। সত্যবতী ছিলেন বুদ্ধিমতী। তিনি জানতেন কাশীরাজের কন্যারা শ্বশ্রূমাতার কথায় বংশরক্ষার স্বার্থে অপরিচিত পুরুষগমন মেনে নিলেও সে পুরুষের কদর্যরূপ বা অদ্ভুতবেশ মেনে নেবেন না। রাজমাতা তিনি। রাজনীতিতে তিনি বড় অপটু নন। সব জেনেবুঝেও পুত্রবধূদের ধর্মের উপদেশ দিলেন, কখনও আবার বংশরক্ষার দায় যে তাঁদেরও সে কথা বুঝিয়ে তৈরি করলেন তাঁদের মন। কিন্তু নিজপুত্র বেদব্যাসের বিষয়ে কিছুই প্রায় জানালেন না।
বিবাহের পর কটা দিনই বা পতিসঙ্গলাভ হয়েছে! তারপর তো বিধবার জীবন। অম্বিকা মনে মনে ভেবেছিলেন, হয়তো ভীষ্ম আসবেন তাঁর কাছে, ভীষণ সে প্রতিজ্ঞা ভেঙে, নয়তো বা অপর কোনও সুপুরুষ কুরুকুলশ্রেষ্ঠ! রাত্রিকালে দেবরস্থানীয় কুরুবংশের পুরুষদের কথা মনে করতে করতে অম্বিকার যখন অপেক্ষার অবসান ঘটল, সামনে পিঙ্গল জটাশ্মশ্রুধারী বেদব্যাসকে দেখে তাঁর প্রায় মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হল। একপ্রকার অনিচ্ছাকৃত সে মিলনে জন্ম নিলেন ধৃতরাষ্ট্র। তপোবলশালী জন্মদাতার পিতার অভিশাপে তিনি হলেন জন্মান্ধ। আর কনিষ্ঠা অম্বালিকা বেদব্যাসকে দেখে ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিলেন। অম্বালিকার গর্ভে বেদব্যাসের যে সন্তান জন্ম নিলেন তিনি পিতার অভিশাপে জন্ম থেকে পাণ্ডুরোগগ্রস্ত হলেন। এদিকে সত্যবতী চেয়েছিলেন সুস্থ সবল সন্তান। তাঁর সে ইচ্ছা চরিতার্থ না হওয়ায় পুনরায় তিনি জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ অম্বিকাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে পাঠালেন বেদব্যাসের কাছে। অম্বিকা এমন বঞ্চনা জেনেশুনে আর মেনে নেবেন কেন? তিনি আরও বড় ছলনার আশ্রয় নিলেন। তিনি আর গেলেন না। পাঠিয়ে দিলেন নিজের এক দাসীকে বেদব্যাসের কাছে৷ দাসী বেদব্যাসকে অত্যন্ত পরিচর্যা করল আর বেদব্যাসও দাসীর সঙ্গসুখে আনন্দলাভ করলেন। দাসীর গর্ভে জন্ম হল বিদুরের। বেদব্যাসের আশীর্বাদে বিদুর অত্যন্ত জ্ঞানী ও ধর্মপরায়ণ হলেন।
বেদব্যাস চলে যাওয়ার আগে মা সত্যবতীকে এই সমস্ত বৃত্তান্তই জানিয়ে গেলেন। জন্মান্ধ বলে ধৃতরাষ্ট্র রাজ্যলাভ করলেন না। আর অন্যদিকে শূদ্রাদাসীর সন্তান বিদুরও বিদ্বান হওয়া সত্ত্বেও রাজ্য থেকে বঞ্চিত হলেন। দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও রাজা হলেন পাণ্ডু। সত্যবতীর সংসার ধীরে ধীরে ভরে উঠতে লাগল। বিবাহ হল ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর। তাদেরও সন্তানাদি হল। পাণ্ডুরাজা পরামর্শদাতা হিসেবে পাশে পেলেন একাধারে সাংসারিক ও রাজনৈতিক উভয়ত তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্না পিতামহী সত্যবতীকে অন্যদিকে পিতা বেদব্যাস ও পিতৃব্য ভীষ্মকে পেলেন অভিভাবক হিসেবে।
এরও বহুকাল পর পাণ্ডুর মৃত্যু হয়। পাণ্ডুর মৃত্যুশোক সত্যবতী সহ্য করতে পারেননি। দীর্ঘজীবন তাঁর। আজন্ম কত দুঃখশোক সয়েছেন। কিন্তু প্রাণপ্রিয় পৌত্রের মৃত্যু তাঁর হৃদয়ে বড় বেজেছিল। বুঝেছিলেন এবার সংসারের মায়াত্যাগের সময় এসেছে। এরপর বহুদিনের সঙ্গিনী দুই পুত্রবধূকে নিয়ে তিনি বনবাসিনী হন এবং যোগবলে মৃত্যুবরণ করেন।