তিন রত্ন। ছবি: সংগৃহীত।
‘চলতি কা নাম গাড়ি’ থেকে শুরু করে ‘শোলে’ অব্দি প্রায় ২০টির মতো গানে গলা মিলিয়েছেন মান্না-কিশোর জুটি। ‘আমির গরিব’ ছবির ‘মেরে প্যায়ালে মে শরাব ডাল দে’-তেও কিশোরের ছায়ায় যেন ম্লান মান্না। কথা ছিল—সুর, তাল, ছন্দে শুধু মান্নাকে অনুকরণ করতে হবে তাঁকে। কিশোর জানালেন, তাহলে রেকর্ডিং শুধু মান্নাকে দিয়েই করতে, তাঁর গেয়ে আর কাজ নেই। গানটি শুনলে বোঝা যাবে, তাঁর গলার আকর্ষণী ক্ষমতা কীভাবে শ্রোতাকে এক যুগলবন্দিতে কিশোরের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এক লহমায়। প্রথম শব্দটি থেকেই।
পণ্ডিত হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর একবার কোনও এক গানের রেকর্ডিংয়ে কিশোরকে বেশ উঁচু স্কেলে গাইতে বললেন, পাশে পড়ে থাকা একটা টুল টেনে নিয়ে তার ওপর দাঁড়িয়ে কিশোর বললেন, ‘আমি এর চেয়ে উঁচুতে গাইতে পারবো না।’ হতবাক পন্ডিত হৃদয়নাথ। বিভিন্ন সময়ে তাঁর নানাবিধ মশকরার জন্য বারবার তিনি ধমক খেতেন দাদামণির কাছে।
আরও পড়ুন:
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৬: তোমার গানের এই ময়ুরমহলে
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১১: মাতৃরূপে প্রথম পুজোগ্রহণ
কর্মজীবনের প্রথম দিকে অভিনয় বেশ কিছুটা সাহায্য করেছিল তাঁকে, তার গায়কীতে। একটি গান লেখা, সুরারোপিত হওয়ার পর, চিত্রনাট্যের সঙ্গে মানানসই করে কীভাবে উপস্থাপিত বা চিত্রিত হবে, তার একটা সম্যক ধারণা ছিল তাঁর। অভিনেতারা ক্যামেরার সামনে কীভাবে গানটিকে তাঁর নিজস্ব স্টাইলে দাঁড় করাবেন, তার জন্যে রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে চলতো তার মহড়া। রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে লম্ফঝম্প করা ছিল আকছার ঘটনা। এ সব কারণে এমন বহুবার হয়েছে যে, তাঁর সঙ্গী গায়িকা মূলত আশা ভোঁসলে বা লতা মঙ্গেশকর হয় গানের রেকর্ডিং বাতিল করতে বলেছেন বা কিশোরকে অনুরোধ করেছেন ষ্টুডিয়ো থেকে চলে যাওয়ার জন্য। না হলে গান গাওয়া তো দূরের কথা হাসতে হাসতে তাঁদের স্বাভাবিক থাকা ছিল দুঃসাধ্য কাজ।
আরও পড়ুন:
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৫: ‘আপনজন’ Chronicles
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৭: নাক বন্ধ হলেই নাকের ড্রপ? এতে শরীরে কোনও ক্ষতি হচ্ছে না তো?
‘বাপরে বাপ’ ছবির ‘পিয়া পিয়া পিয়া’ গানের রেকর্ডিংয়ে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা, যার থেকে কিশোরের তাৎক্ষণিক দূরদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায় হাতেনাতে। আশা-কিশোরের ডুয়েট। দ্বিতীয় অন্তরার মাঝে এক জায়গায় আশা ভুল করেই কিশোরের লাইনগুলোর মাঝে গান ধরতে গেলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে কিশোর হাত দিয়ে আশার মুখ চেপে ধরে ভুলটা থামিয়ে দিলেন। লজ্জিত আশা তখনই নিজের ভুল বুঝতে পেরে হাত তুলে আবার রেকর্ডিং শুরু করার ইশারা করলেন। কিশোরও ইশারায় বোঝালেন গান চালিয়ে যেতে।
গান শেষ হলে আশা ও সুরকার কিশোরকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি গান থামালেন না কেন? উত্তরে তিনি বললেন, গানটির চিত্রগ্রহণের সময় বাস্তবেই তিনি দৃশ্যটি ওভাবে রাখার জন্য পরিচালককে অনুরোধ করবেন। মনে হবে খুব সচ্ছ্বল ও স্বাভাবিক ভাবেই যেন প্রেমিকার ঠোঁটে হাত রেখে বা থামিয়ে প্রেমিক নিজে গান গেয়ে চললো। আজও গানটি দেখলে বোঝা যায়, ওই আপাত ভাবে ছোট্ট আর তুচ্ছ মুহূর্তটি কীভাবে এক অন্য মাত্রা এনে দেয় সামগ্রিক দৃশ্যায়নে।
গান শেষ হলে আশা ও সুরকার কিশোরকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি গান থামালেন না কেন? উত্তরে তিনি বললেন, গানটির চিত্রগ্রহণের সময় বাস্তবেই তিনি দৃশ্যটি ওভাবে রাখার জন্য পরিচালককে অনুরোধ করবেন। মনে হবে খুব সচ্ছ্বল ও স্বাভাবিক ভাবেই যেন প্রেমিকার ঠোঁটে হাত রেখে বা থামিয়ে প্রেমিক নিজে গান গেয়ে চললো। আজও গানটি দেখলে বোঝা যায়, ওই আপাত ভাবে ছোট্ট আর তুচ্ছ মুহূর্তটি কীভাবে এক অন্য মাত্রা এনে দেয় সামগ্রিক দৃশ্যায়নে।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৩: সুন্দরবনের গ্রামরক্ষক দেবতা আটেশ্বর
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৮: প্যায়ার করনে ওয়ালে প্যায়ার করতে হ্যায় শান সে— আশার কণ্ঠ ও আরডি-র সুর, অনবদ্য
রাজেশ খান্না-কিশোর কুমার জুটির শুরু সেই ‘আরাধনা’ ছবি থেকেই। ছবির গান রেকর্ডিংয়ের আগে সেই সময় নবাগত রাজেশকে রীতিমতো বাড়িতে ডেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতেন কিশোর। রাজেশের কথা বলার কায়দা, চাল-চলন খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছিলেন, যাতে পর্দায় যেন সুস্পষ্ট হয় যে, নায়কই গানগুলি গাইছেন, কিশোর নয়। তিনি তখনই বুঝেছিলেন, এই তরুণ, রুপোলি পর্দায় পাকাপাকি জায়গা করে সুপারস্টার হওয়ার জন্যই কাজে হাত দিয়েছেন। আগামী দিনে তাঁদের জুটি হিন্দি সিনেমার জগতে সাড়া ফেলে দিতে চলেছে। ‘অমর প্রেম’, ‘কাটি পতঙ্গ’, ‘সফর’, ‘আন্দাজ’, ‘দুশমন’, ‘মেহেবুবা’ অগুনতি ছবিতে তাঁরা যেন অবিচ্ছেদ্য।
আরও পড়ুন:
যে উপদেশ গিয়েছি ভুলে…/২
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৪: মুহূর্ত মিলায়ে যায় তবু ইচ্ছা করে, আপন স্বাক্ষর রবে যুগে যুগান্তরে
বার বারই এ প্রসঙ্গ উঠেছে যে, প্রথাগত সংগীত শিক্ষার কোনও তালিম সে অর্থে ছিল না এই মহান শিল্পীর। বরং নিজে নিজেই ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি, পন্ডিত ভীমসেন জোশী-সহ দিকপাল সংগীতজ্ঞদের গানের নির্যাস তিনি নিভৃতে আহরণ করতেন। তিনি নিজেকেই নিজে শিক্ষা দিতেন সে সব অমূল্য রত্নের মূল্যায়ন ও সঠিক প্রয়োগে।—চলবে।
* ঋত্বিক চক্রবর্তী, পেশাগত ভাবে একটি বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। কর্মসূত্রেই স্পেনে থাকা। কাজের কাজ ও অকাজ করে সময় পেলেই বইপড়া, গান শোনার চেষ্টা আর পাঁচটা বাঙালির মতোই মজ্জাগত। রুজি রোজগারের বাইরে নিজের মনের জন্য কিছু পুষ্টি সঞ্চয়ে উন্মুখ। তাই পেশা আর নেশার টানাপোড়েনে পড়ে থাকা আর এক বাঙালি।