'পড়োশন' ছবিতে।
অভিনেতা হিসেবেও কিশোর মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন এক স্বতন্ত্র আসনে। ঝোড়ো দমকা অথচ প্রাণোচ্ছল হাওয়ার মতোই ছিল তার পর্দায় আনাগোনা। ‘হোয়াট ক্রিসমাস’ বা ‘ইন্সপেক্টর জেনারেল’-এর ‘ড্যানি কায়ে’কে মনে আছে কারও? কিশোরের অভিনয়ে ড্যানির প্রভাব যে সুস্পষ্ট, তা অনস্বীকার্য। তবে তার নিজস্বতা ও স্বকীয়তায় কিশোর ছিলেন তাঁর নিজের জায়গায়। এক বাক্যে তা যেমন মানতেন সাধারণ মানুষ, তেমনি মানতেন প্রখ্যাত নির্দেশক, পরিচালকরাও। নিজের প্রথম পরিচালনার কাজ কিশোরের সঙ্গে করতে গিয়ে সে-কথা উপলব্ধ করেছিলেন স্বয়ং হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়।
দিকপাল এই পরিচালক প্রথম ছবি ‘মুসাফির’-এ কিশোরের সঙ্গে কাজ করার পর, তাঁর নিজস্ব অভিনয় স্টাইলে এমনিই মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলেন যে, ১৯৭০ এর সেই কালজয়ী ‘আনন্দ’ ছবিতে নামভূমিকায় কিশোরকেই চেয়েছিলেন তিনি। আক্ষরিক অর্থে কিশোরকে মাথায় রেখেই যেন চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন হৃষিকেশবাবু। জীবনমুখর, সদাহাস্যময়, প্রাণোচ্ছল কিশোর ছাড়া যেন কারও পক্ষে সম্ভব নয় পরিচালকের মনের ভাব পর্দায় ফোটানো।
এখানেও জড়িয়ে এক মজার ঘটনা। নাছোড়বান্দা হৃষিকেশ যেমন চান কিশোর কুমারকে নামভূমিকায়, ওদিকে কিশোরও কিছুতেই রাজি নন মৃত্যুপথযাত্রী কর্কট রোগগ্রস্ত এক চরিত্রে কাজ করতে। তাছাড়া সেই সময় হাতে গানের কাজও অনেক। কী করা যায়? তবে কিশোর চিরকালই একজন অশান্তশিষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত ভদ্রলোক। শুটিং লোকেশন, তারিখ সব ঠিক করে হৃষিকেশবাবু যখন কিশোরের কাছে হাজির, তিনি দেখলেন কিশোর তখন সমস্ত মস্তক মুণ্ডন করে এক সন্ন্যাসীপ্রায় রূপ নিয়ে বসে আছেন। এখানেই শেষ নয়, আবার শেষ পেরেকটা ঠোকার মতোই তিনি পরিচালককে বললেন, ‘চলুন আমি তৈরি শুটিংয়ের জন্য।’ প্রথমে তেলেবেগুনে জলে উঠলেও পরে হাসতে হাসতে মুখার্জীবাবু এসেছিলেন তার বাড়ি থেকে, ‘আনন্দ’ ছবির জন্যে কিছু প্রাণ সঞ্চয় করে।
এখানেও জড়িয়ে এক মজার ঘটনা। নাছোড়বান্দা হৃষিকেশ যেমন চান কিশোর কুমারকে নামভূমিকায়, ওদিকে কিশোরও কিছুতেই রাজি নন মৃত্যুপথযাত্রী কর্কট রোগগ্রস্ত এক চরিত্রে কাজ করতে। তাছাড়া সেই সময় হাতে গানের কাজও অনেক। কী করা যায়? তবে কিশোর চিরকালই একজন অশান্তশিষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত ভদ্রলোক। শুটিং লোকেশন, তারিখ সব ঠিক করে হৃষিকেশবাবু যখন কিশোরের কাছে হাজির, তিনি দেখলেন কিশোর তখন সমস্ত মস্তক মুণ্ডন করে এক সন্ন্যাসীপ্রায় রূপ নিয়ে বসে আছেন। এখানেই শেষ নয়, আবার শেষ পেরেকটা ঠোকার মতোই তিনি পরিচালককে বললেন, ‘চলুন আমি তৈরি শুটিংয়ের জন্য।’ প্রথমে তেলেবেগুনে জলে উঠলেও পরে হাসতে হাসতে মুখার্জীবাবু এসেছিলেন তার বাড়ি থেকে, ‘আনন্দ’ ছবির জন্যে কিছু প্রাণ সঞ্চয় করে।
আরও পড়ুন:
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৩: অভিনয় নয়, কিশোর মনে-প্রাণে একজন গায়ক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১১: মশ্যা রে তুঁহু মম শ্যাম-সমান
আড্ডা যখন জমেই উঠেছে তখন বলি, আর এক কিশোর কীর্তির কথা। গুলজার এ কথা বলেছিলেন একদা এক সাক্ষাৎকারে। কোনও এক ছবির শুটিংয়ের এক দৃশ্যে কিশোরের গাড়ি চালিয়ে চলে যাওয়ার কথা। বেশ, তো কথা মতো কাজ, কিশোর গাড়ি চালিয়ে চলে যাচ্ছেন। তবে পরিচালক বেখেয়ালে কাট বলতে ভুলে যান। আর পায় কে, কিশোরও আর গাড়ি থামালেন না। চলে যেতেই লাগলেন। সোজা পানভেল। তার আর কী দোষ? পরিচালক তো আর কাট বলেননি। আসলে এমন ছুতোয় তিনি বারবার অভিনয় ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েছেন। চেয়েছিলেন শুধু গায়ক ও একমাত্র গায়কই হতে।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, আলোকের ঝর্ণাধারায়
প্রথম আলো, পর্ব-২: পৃথিবীর কোথায় প্রথম হাসপাতাল গড়ে উঠেছিল?
১৯৬৮-৬৯ অবধি একচেটিয়া শুধু গান গেয়ে যশ, খ্যাতি, অর্থ বা এক শব্দে তার গায়কি প্রতিভার যথার্থ দাম তিনি পাননি। তাই সেই রাগ মেটাতেন, ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুল সংলাপ বলে, প্রযোজককে নানা ভাবে অপদস্থ করে, কোনও কিছুই বাদ রাখেননি। তবুও তার প্রাণখোলা, অগোছালো, এলোমেলো অভিনয়ই তখন ‘সেলিং লাইক হটকেক’। পর্দার কিশোর আর বাস্তব কিশোর যেন অবিচ্ছেদ্য। আসলে তিনি আলাদা করে অভিনয় করতেন না। একাধিক চরিত্রে তিনি নিজ চরিত্রের নামও রেখেছিলেন কিশোর কুমারই। সমালোচকরা যদিও বারবার তাকে বিদ্ধ করেছেন সমালোচনার জালে। তাতে অষ্টরম্ভা। কারণ, তিনিই যে তখন প্রযোজক, নির্দেশকের অন্যতম সম্বল।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৪: গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে ওষুধ খেলে গলে যায়?
কলকাতার পথ-হেঁশেল: উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া—প্রাণের আশ-প্যান্থেরাস
নিছক হালকা স্বাদের চরিত্রেই শুধু নয়, প্রয়োজনে গুরুগম্ভীর চিত্রনাট্যেও তিনি সমান সাবলীলতার পরিচয় রেখে গিয়েছেন। দাদামণির সঙ্গে ‘ভাই ভাই’, ‘ঝুমরু’ বা বাংলায় ‘লুকো চুরির’ অনেকাংশেই পাওয়া যায় তার প্রমাণ। অভিনয়, নিজের জন্য গাওয়া গানের পাশাপাশি ‘ঝুমরু’তে সংগীত পরিচালনার দায়িত্বও নিয়েছিলেন। আর তাঁর সুমিষ্ট ফল আমরা আজও উপভোগ করে যাচ্ছি।
দাদামণি আশোক কুমারের সঙ্গে।
১৯৬৮ সালে মেহমুদ যখন ভাবলেন ‘পড়োশন’ বানানোর কথা, তখন ডাক পড়লো কিশোরের। এ কথা অনেকের অজানা যে, ৫২ সালে বাংলায় তৈরি, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, অনুপ কুমার, ভানু বন্দোপাধ্যায় ও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য অভিনীত ‘পাশের বাড়ি’ ছবিটিই ছিল ৬৮-এর ওই হিন্দি মাইলস্টোন ছবিটির উৎস। তবে ‘পাশের বাড়ি’ ছবিতে সে অর্থে কিশোর কুমার অভিনীত বিদ্যাপতির চরিত্রটিই ছিল না। ছবি বানানোর পরিকল্পনার সময় মেহমুদ কিশোরের কথা মাথায় রেখেই চরিত্রটি সংযোজনের কথা ভাবেছিলেন।—চলবে।
* ঋত্বিক চক্রবর্তী, পেশাগত ভাবে একটি বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। কর্মসূত্রেই স্পেনে থাকা। কাজের কাজ ও অকাজ করে সময় পেলেই বইপড়া, গান শোনার চেষ্টা আর পাঁচটা বাঙালির মতোই মজ্জাগত। রুজি রোজগারের বাইরে নিজের মনের জন্য কিছু পুষ্টি সঞ্চয়ে উন্মুখ। তাই পেশা আর নেশার টানাপোড়েনে পড়ে থাকা আর এক বাঙালি।