রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


দাদামণি নিজেই অবশ্য ছোট্ট কিশোরকে একটি হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিলেন বটে, তবুও তা নেহাত সাধারণ ভাবেই। তবে শুরু থেকেই কিশোর সবার গলা নকল করতে ছিলেন পক্ক, যাকে বলে ওস্তাদ। প্রধানত কেএল সায়গলের গলা নকল করা ছিল মূল কাজ। বিভিন্ন গায়কের গলা নকল করে এক আনা দু’ আনা কামানোও ছিল তাঁর নিত্য কর্ম। মেজোদাদা অনুপ কুমার, দাদামণি আর বাড়ির অনেকেই তাঁর এই গানের ঠেলায় ছিলেন বেজায় অস্থির। শুধু আমাকে আপনাকে নয়, ছোটবেলায় তাঁকেও শুনতে হয়েছে, ‘ভাঙা বাঁশের চ্যালার মতো আওয়াজ থামা বাপু।’
তবুও থামেননি কিশোর। এরপরই ঘটে এক আশ্চর্য ঘটনা। একদিন হল কি, বছর দশেকের কিশোর বাঁধালেন এক চরম বিপত্তি। দুষ্টুমি করতে গিয়ে মায়ের সব্জি কাটার বঁটিতে পড়লো তার পা। পায়ের পাতা ফালা হয়ে গেল কেটে। ডাক্তার-বদ্যি দেখানোর পরও প্রায় মাসখানেক যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে ছোট্ট কিশোর। দিনের পর দিন শুধু কাঁদতেন যন্ত্রণায়। তবে এতেই হল শাপে বর। তার গলা হল আরও সুরেলা। যে সুরে আজও আমি, আপনি আছি মজে। কারণ ‘নামটি যে তাঁর কিশোর কুমার গাঙ্গুলি’।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১: একটু শুরুর কথা হলে ক্ষতি কী…

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৪: কোন সকালে মুক্তির অপেক্ষায় ‘ত্রিযামা’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩২: আটার চেয়ে ময়দা ঢের গুণ ভালো?

পরবর্তীকালে ইন্দোর খ্রিস্টান কলেজে গিয়ে সেখানেও সবার মন জয় করতে সময় লাগেনি এই রঙিন মানুষটির। বাড়ির সবাই প্রথমে ভেবেছিল, আপাত ঘরকুনো কিশোরের হয়তো কলেজে মন টিকবে না কিছুতেই। প্রতি হপ্তা শেষেই বাড়ি ফেরার জন্যে মুখিয়ে থাকবে সে, তার প্রিয় মাছ ভাতের লোভে। যদিও ঘটল উলট পুরাণ। বাড়ির শাসনের বাইরে, স্বাধীনতার হাওয়ায় তাঁর যেন ‘মন ছুটি চায়’ এবার। তিনি কলেজের সিনিয়রদের চোখের মণি ছিলেন।

কিছু মজার কথা বলি। সে সময় তাঁর চেহারা ছিল বেশ ‘রোগা-সোগা’। আর সেই শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে সারাদিন গায়ে এক কালো ওভারকোট পরে ঘুরতেন তিনি। তা সে ক্লাসই হোক বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলতেন, তার ওই কোট নাকি খুব পয়া। ও ছাড়া তিনি মণি হারা ফণী। একবার তো ওই কোট পরেই কলেজের স্পোর্টসে ফুটবল ম্যাচে গোলও করলেন, আর তাতেই কেল্লা ফতে। আরও সবাই চিনে গেলো তাঁকে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৩: দো লাফজো কি হ্যায়… অমিতাভ-জিনাতের লিপ, পঞ্চমের সুর আর আশার কণ্ঠ, মনে পড়ছে?

শম্ভু, শম্ভু, শিব মহাদেব শম্ভু, খুদার ইবাদত যাঁর গলায় তাঁর আর কাকে ভয়?

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮: সুন্দরবনের নিশ্চিহ্ন প্রাণী

এ দিকে রাতে বন্ধুদের সঙ্গে বসত গানের আসর। অনেক রাত পর্যন্ত চলতো ফিল্মি গানের জলসা। একবার এক সিনিয়র নালিশও জানালেন পড়ার ক্ষতি হওয়ার কারণে হোস্টেল সুপারিন্ডেন্টের কাছে। তবে সে কি আর জানতো সেই সুপারিন্ডেন্ট এসে কিশোরের গান শুনে মুগ্ধ হবেন। আর গান গাইতে বারণ তো দূরের কথা উল্টে তিনিও যোগ দেবেন সে আসরে! এমনই জাদুকর ছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭০: অন্য বাইশে শ্রাবণ

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৯: তা বলে কি প্রেম দেব না!

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬: গার্হস্থ্য জীবনের প্রারম্ভে ভৈরবী ব্রাহ্মণীর আগমন

তবে কলেজ জীবনের এ সব কীর্তিকলাপ কিছুই চাপা থাকল না। খবর গেল মুম্বইয়ে (তখন বম্বে) দাদামণির কাছে। শীঘ্রই তিনি চিঠি লিখলেন, দেশে খান্ডওয়াতে মা-বাবাকে। চিঠির বয়ান ছিল এরকম, ভাই কিশোর পড়াশুনো ফেলে আসর মাতিয়ে বেড়াচ্ছে কলেজের নাম করে। এতেও হল আরেক শাপে বর। পত্রপাঠ বম্বে থেকে দাদামণি অশোক কুমার আর কলেজ হতে কিশোরের ডাক পড়ল বাড়িতে। ঠিক হল আর পড়াশোনা নয়, তাহলে বম্বে যাত্রাই হোক, বরং রুপোলি পর্দাতেই হোক ভাগ্য বিচার।
তবে শুরুতেই কিশোর শর্ত রাখলেন। কী সেই শর্ত? না তিনি দাদামণির কথা মতো বা দেখানো পথে চলবেন, আর না দাদামণি তার কাজের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন। এ কথাও পরিষ্কার করে দিলেন কারও দয়া দাক্ষিণ্যে নয়, নিজের ক্ষমতায় কাজ জোগাড় করবেন।

অদম্য আত্মবিশ্বাসে অষ্টাদশের কিশোর যেন তখনি জানতেন যে, ‘কী উপহার তিনি সাজিয়ে দেবেন’ আমাদের মতো ভাগ্যবান অগুনতি ভক্তদের মাঝে। দাদামণিও সম্মান দিয়েছিলেন ভাইয়ের এই ইচ্ছেকে। একই ছাদের নিচেও থেকে, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র জীবন কাটাতেন স্ট্রাগলিং কিশোর। সে যুগের তারকা অশোককুমারের গাড়িতে নয়, লোকাল ট্রেন, বাসে ঘুরতেন কাজের আশায়। এমনকি বম্বে টকিজে কাজের সন্ধানেও দূরত্ব বজায় রাখতেন সর্বদা দাদামণির থেকে।—চলবে।
* ঋত্বিক চক্রবর্তী, পেশাগত ভাবে একটি বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। কর্মসূত্রেই স্পেনে থাকা। কাজের কাজ ও অকাজ করে সময় পেলেই বইপড়া, গান শোনার চেষ্টা আর পাঁচটা বাঙালির মতোই মজ্জাগত। রুজি রোজগারের বাইরে নিজের মনের জন্য কিছু পুষ্টি সঞ্চয়ে উন্মুখ। তাই পেশা আর নেশার টানাপোড়েনে পড়ে থাকা আর এক বাঙালি।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content