বাংলাদেশ স্বাধীন। পাক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি সই করছেন আত্মসমর্পণপত্রে।
এ বার আসা যাক একাত্তরে ওপারের মুক্তি যুদ্ধের কথায়। ত্রিপুরা সে সময় দেশে বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে ত্রিপুরার নাম। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা প্রবাহের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল ত্রিপুরা রাজ্যে। সেখানকার মানুষের উপর পাক সেনাদের বর্বর হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্ত রাজ্য ত্রিপুরায় বিপুল সংখ্যক শরণার্থী আগমন ঘটে। রাজ্যের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি মানুষ তখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরণার্থী হয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিল। ত্রিপুরা সেদিন দেশ বিদেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
নানা কারণে ওপারে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ত্রিপুরাকে এ জন্য প্রচণ্ড চাপও সামলাতে হয়েছিল। কিন্তু ত্রিপুরার তদানীন্তন প্রশাসনিক পরিকাঠামো পরিস্থিতির কার্যকরী মোকাবেলায় মোটেই যথেষ্ট ছিল না। একটা রাজ্যে যদি মোট জনসংখ্যার বেশি মানুষ শরণার্থী হয়ে আসে তা হলে পরিস্থিতিটা কী হতে পারে সেটা সহজেই অনুমেয়। ত্রিপুরার নানা অঞ্চলে সেদিন বহুসংখ্যক শরণার্থী শিবির তৈরি হয়েছিল। তাদের কাছে ত্রাণ সাহায্য পৌঁছে দেওয়া ছিল এক বিরাট কাজ। রাজ্যের সীমান্তে ওপারের মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট নানা ঘটনায় আশঙ্কা, উদ্বেগ ছিল মানুষের নিত্য সঙ্গী। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হবার পর যেমন পূর্ব রণাঙ্গণের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিতে পর্যবসিত হয়েছিল ত্রিপুরা, তেমনই যুদ্ধের আগেও কামানের গোলা এসে পড়েছিল রাজধানী আগরতলার কর্মচঞ্চল এলাকায়। ত্রিপুরার অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলেও এমন ঘটনা ঘটেছিল।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৮: ভারতভুক্তির পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৬: সুন্দরবনের লৌকিক চিকিৎসায় ম্যানগ্রোভ—হরগোজা ও কেয়া
আকাশবাণীর শ্রোতা তখন সব অংশের মানুষ। সে সময় অবশ্য ঘরে ঘরে রেডিও ছিল না। আর টিভির মতো বস্তু তো কল্পনাতেই নেই। তাই শহর বা গঞ্জের হাটে রেডিও’র সামনে ভিড়। তখন সময় কাটে এক উত্তেজনার মধ্যে। নজর সবার ওপারের দিকে। মুখে মুখে শুধু ‘জয় বাংলা’। চায়ের দোকান, মানুষের জটলা-সর্বত্র একই আলোচনা। ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে কিনা, পাক-ভারত যুদ্ধ লাগবে কিনা-নানা প্রসঙ্গে আড্ডা, আলোচনা। মাঝে মাঝে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে যায় উদ্বাস্তুদের। আদৌ দেশ স্বাধীন হবে তো? নিজেদের বাড়ি ঘরে ফেরা যাবে তো? এ সবের মাঝেই ওপার থেকে উদ্বেগজনক নানা খবরাখবরও আসতে থাকে। পাক সেনারা তখন খান সেনা নামে পরিচিতি লাভ করেছে। খান সেনাদের অত্যাচারের নানা খবর এপারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। উত্তেজনায় টগবগ করে সবাই। এসবের মধ্যেই বেড়ে চলে মুক্তি যুদ্ধের তীব্রতা।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬০: আধুনিক ভারতীয় রাজনীতির চালচিত্রে কি দশরথ ও কৈকেয়ীর ছায়া?
সীমান্তের ওপার থেকে শোনা যায় মর্টারের শেল ফাটার তীব্র আওয়াজ। কখনও মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের খবর আসে, কখনও আসে খান সেনাদের অত্যাচারের খবর। নারী নির্যাতনের নানা খবরাখবর ভেসে আসে ওপার থেকে। খান সেনারা মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়েছে তাদের বাঙ্কারে। কখনও শোনা যায় মুক্তি বাহিনী খান সেনাদের ঘাঁটি ধ্বংস করে মেয়েদের উদ্ধার করেছে। ওপারে ‘রাজাকার’ নামে এক বাহিনীর তৎপরতার খবরও চাউর হয়। ‘রাজাকার’ খান সেনাদের নানা ভাবে সাহায্য করছে। সম্ভবত পাক সেনাদের কাছে বেসরকারি স্তরে তথ্য সরবরাহের দায়িত্ব ছিল রাজাকারদের। এক সময় ইতিহাসের মীরজাফর শব্দের সমার্থক হয়ে পড়ে একাত্তরের ‘রাজাকার’।
ত্রিপুরা বিধানসভা।
ত্রিপুরার সীমান্ত এলাকায় মাইন বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটতে থাকে। গেরিলা কায়দায় হামলারত মুক্তি ফৌজকে ঠেকানোর জন্য পাক সেনারা ত্রিপুরার সীমান্ত এলাকায় সেদিন মাইন পুতে রেখেছিল। মাইন বিস্ফোরণে বেশ কিছু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছিল। যাইহোক, এরই মাঝে একদিন পাক-ভারত যুদ্ধের দামামা বেজে গেল। রেডিয়ো, পত্রিকায় তখন আন্তর্জাতিক নানা উত্তেজনাকর খবরাখবর। রাষ্ট্রসংঘ-রাশিয়া-আমেরিকা-বঙ্গোপসাগরের দিকে সপ্তম নৌ বহর,কত কি!মানুষ যেন রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে।সবার কান রেডিওতে আকাশবাণীর খবরে। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বর যেন রেডিয়োর প্রতি আকর্ষণে এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল সেদিন।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৬: যন্ত্রণাদগ্ধ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাঁচিতে পেয়েছিলেন সান্ত্বনার প্রলেপ
পাক-ভারত যুদ্ধ শুরুর পর ত্রিপুরার সব সীমান্ত শহর যেন রণাঙ্গণে পরিণত হয়। বিভিন্ন এলাকায় কামান বসানো হয়। ত্রিপুরার উপর দিয়ে ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া ইত্যাদি নানা সমর সম্ভার সহ আমাদের বাহিনি ওপারে যেতে থাকে। আকাশে চক্কর দেয় যুদ্ধ বিমান। অবাক ব্যাপার, যুদ্ধ দেখতে সাধারণ মানুষও বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়! মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে কামান দাগা দেখতে। আবার সীমান্ত শহরের উপর দিয়ে যুদ্ধে যাবার সময় আমাদের বীর সেনানিদের কপালে বিজয় তিলক এঁকে দিয়ে তাদের মঙ্গল কামনা করা হয়। যুদ্ধযাত্রার সময় দেশাত্মবোধক গান, ফল-ফুল-মালা, কপালে তিলক এঁকে দেশের বীর সেনানীদের উৎসাহ দেয়া হয়েছিল সেদিন। এই যুদ্ধে ঐতিহাসিক বিজয়ের মাধ্যমে মানচিত্রে ভূমিষ্ট হলো বাংলাদেশ। ঢাকায় আত্ম সমর্পণ করে বিপুল সংখ্যক পাক সেনা।
শচীন্দ্র লাল সিংহ।
যাইহোক, একাত্তরে ত্রিপুরাকে এক সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। যুদ্ধের আগেই রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংকটজনক হয়ে উঠেছিল। রাজ্য রাজনীতিতে কংগ্রেসের গোষ্ঠি কোন্দলের পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরাগ ভাজন হয়েছিলেন। আর এসবের ফলশ্রুতিতে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। ১৯৭১ সালের ৪ নভেম্বর শচীন্দ্র লাল সিংহের সরকারকে বরখাস্ত করে ত্রিপুরায় প্রথম বারের মতো রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়েছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ত্রিপুরা পূর্ণ রাজ্যে উন্নীত হয়।উত্তর-পূর্ব এলাকা সমূহ (পুনর্গঠন) আইন, ১৯৭১ অনুসারে ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি মেঘালয় ও মণিপুরের সঙ্গে ত্রিপুরাও পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে।৩০ থেকে বেড়ে ত্রিপুরা বিধানসভার আসন সংখ্যা হয় ৬০। —চলবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ত্রিপুরা পূর্ণ রাজ্যে উন্নীত হয়।উত্তর-পূর্ব এলাকা সমূহ (পুনর্গঠন) আইন, ১৯৭১ অনুসারে ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি মেঘালয় ও মণিপুরের সঙ্গে ত্রিপুরাও পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে।৩০ থেকে বেড়ে ত্রিপুরা বিধানসভার আসন সংখ্যা হয় ৬০। —চলবে।
ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।