শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


পালিত হচ্ছে প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবস।

১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক ভাবে ত্রিপুরার ভারতভুক্তি ঘটে। সুদীর্ঘকাল মাণিক্য রাজবংশের শাসনের পর ত্রিপুরা ক্রমে ক্রমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে যাত্রা শুরু করে। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি চালু হয় ভারতের নতুন সংবিধান। দেশের অঙ্গ রাজ্যগুলোকে তখন ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছিল। ত্রিপুরা তখন ‘গ’ শ্রেণির রাজ্যে পরিগণিত হয়। তাতে বিধানসভা ও মন্ত্রিসভা গঠনের কোনও সংস্থান ছিল না। রাজ্যের শাসন পরিচালনার ভার ছিল কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত চিফ কমিশনারের উপর। তিনিই ছিলেন রাজ্যের সর্বময় কর্তা।

১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে স্বাধীনোত্তর ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ত্রিপুরায় দুটি লোকসভার আসন এবং রাজ্যসভার একটি আসনের জন্য ত্রিশ সদস্য বিশিষ্ট এক ইলেকটোরাল কলেজ গঠনে নির্বাচন হয়েছিল তখন। ত্রিপুরায় এই নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে। লোকসভার দুটি আসনেই কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। ইলেকটোরাল কলেজের নির্বাচনে কমিউনিস্ট ও তাদের সহযোগীরা সাফল্য অর্জন করে। ৩০টির মধ্যে ১৭টিতে তারা জয়লাভ করেছিল।
এই নির্বাচনের পর ত্রিপুরায় নির্বাচিত সরকার গঠনের দাবি জোরদার হতে থাকে। কেন্দ্রীয় সরকার তখন ত্রিপুরায় নির্বাচিত সরকার গঠনের পরিবর্তে রাজ্যের দৈনন্দিন শাসন কার্যে চিফ কমিশনারকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য কংগ্রেস নেতাদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে দেয়। লোকসভার আসন ও ইলেকটোরাল কলেজের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু কমিউনিস্টদের সেই বিজয়কে একরকম উপেক্ষা করেই সেদিন কংগ্রেস নেতাদের নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ধূমায়িত হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি সেদিন এই উপদেষ্টা পরিষদ বাতিলের দাবি তুলেছিল। নির্বাচিত ইলেকটোরাল কলেজকে বিধানসভায় পরিণত করা সহ উপদেষ্টা পরিষদ বাতিলের দাবিতে তারা আন্দোলন শুরু করেছিল।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৭: রাজা বীরবিক্রম মৃত্যুর কিছু দিন আগেই ত্রিপুরার ভারতভুক্তির সিদ্ধান্ত নেন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের প্রকৃত ম্যানগ্রোভ ও ম্যানগ্রোভ-সহযোগীরা

রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর ত্রিপুরা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়। কিন্তু তখনও শাসন ক্ষমতার শীর্ষে চিফ কমিশনার। তবে নির্বাচনের মাধ্যমে আঞ্চলিক পরিষদ বা টেরিটোরিয়েল কাউন্সিল গঠনের সংস্থান রাখা হয়েছিল কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের জন্য। তবে এই পরিষদের ক্ষমতা ছিল অনেকটা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ক্ষমতার অনুরূপ। ১৯৫৭ সালের মার্চ মাসে দেশে দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একই সঙ্গে ত্রিপুরায় ৩০ আসন বিশিষ্ট আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। ত্রিপুরার লোকসভার দুটি আসনের একটিতে কমিউনিস্ট ও অপরটিতে কংগ্রেস জয়লাভ করে। আঞ্চলিক পরিষদে কমিউনিস্ট ও কংগ্রেস উভয় দলই ১৫টি করে আসন লাভ করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার মনোনীত অতিরিক্ত দু’জন সদস্যের সমর্থন কংগ্রেস লাভ করায় পরিষদের ক্ষমতা দখলে কংগ্রেস সমর্থ হয়। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হন শচীন্দ্রলাল সিংহ।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৯: মহাভারতের বিচিত্র কাহিনিগুলিতে আছে মৃত্যুজয়ের অভয়বাণী

১৯৬২ সালের সাধারণ নির্বাচনে ত্রিপুরার লোকসভার দুটি আসনেই কমিউনিস্টরা বিজয়ী হলেও আঞ্চলিক পরিষদে কংগ্রেস জয়লাভ করে। আবার পরিষদের চেয়ারম্যান হন শচীন্দ্রলাল সিংহ। ১৯৬৩ সালের ১ জুলাই কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল আইন অনুযায়ী ত্রিপুরা আঞ্চলিক পরিষদ ত্রিপুরার প্রথম বিধানসভায় রূপান্তরিত হয়। মুখ্যমন্ত্রী হন শচীন্দ্রলাল সিংহ। এদিন তাঁর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কংগ্রেস মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ত্রিপুরা বিধানসভা ও মন্ত্রিসভা পেলেও তার জন্য তখন কোনও নির্বাচন হয়নি। ১৯৬২ সালের নির্বাচনে গঠিত আঞ্চলিক পরিষদই সে সময় বিধানসভায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু নতুন এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের সময় নৃপেন চক্রবর্তী সহ অনেক বিরোধী নেতা জেলে আটক ছিলেন।

১৯৬৭ সালের ১৩ মার্চ শচীন্দ্র লাল সিংহের নেতৃত্বে কংগ্রেস মন্ত্রিপরিষদ শপথ গ্রহণ করে।।

ত্রিপুরার ভারতভুক্তির পর থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত নির্বাচনগুলোতে কমিউনিস্ট পার্টি উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখালেও পরবর্তী নির্বাচনে কিন্তু তারা সেটা ধরে রাখতে পারেনি। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে লোকসভার দুটি আসনেই যেমন কংগ্রেস জয়লাভ করে তেমনই বিধানসভার ৩০টি আসনের মধ্যে ২৭টিতেই তারা জয়ী হয়। উল্লেখ্য, ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে সিপিআই এবং সিপিআই (এম) দুটি পার্টি হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের ভোটে কংগ্রেসের প্রবল উত্থানের পিছনে এটি বড় একটি কারণ বলে অনেকের অভিমত। যাইহোক, ১৯৬৭ সালের ১৩ মার্চ শচীন্দ্র লাল সিংহের নেতৃত্বে কংগ্রেস মন্ত্রিপরিষদ শপথ গ্রহণ করে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬০: একটু বসো চলে যেও না…

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৫: ভূপেনবাবুর ভূত

পরবর্তী সময়ে নানা ভাবেই ত্রিপুরায় রাজনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ত্রিপুরাকে পূর্ণ রাজ্যে উন্নীত করার জন্য সিপিএম আন্দোলন শুরু করে। উপজাতি ভিত্তিক একটি আঞ্চলিক দল উপজাতি যুব সমিতি গঠিত হয় তখন। শিক্ষিত অংশের উপজাতি যুবকেরা ব্যাপক ভাবে শামিল হয় এই দলে। উপজাতিদের জন্য স্বশাসিত জেলা পরিষদ গঠন, ত্রিপুরায় ইনার লাইন পারমিট প্রথা চালু করা ইত্যাদি দাবিতে যুব সমিতি তাদের তৎপরতা সংহত করতে থাকে। ত্রিপুরার রাজনীতিতে কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট এই দুই মেরুকরণের মধ্যে যুব সমিতির অভ্যুদয় স্বাভাবিক ভাবেই নতুন মাত্রার সঞ্চার করে।

ত্রিপুরায় শুরু হয় জাতি কেন্দ্রিক রাজনীতি। উপজাতিদের মধ্যে ক্ষোভ, অসন্তোষ বাড়ার যথেষ্ট কারণও ছিল। দেশ ভাগের পর থেকেই বিপুল হারে উদ্বাস্তুদের আগমন ঘটতে থাকে ত্রিপুরায়। উপজাতিরা ক্রমেই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। জমিও তাদের হাত ছাড়া হতে থাকে। সেই সঙ্গে ছিল অভাব অনটন সহ তাদের জীবন যাপনে নানা সংকট। উপজাতিদের এইসব ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে যুব সমিতি জঙ্গি আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকে। এদিকে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলেও অন্তর্দ্বন্দ্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। —চলবে।
ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content