মঙ্গলবার ২৫ মার্চ, ২০২৫


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এ বার আসা যাক রবীন্দ্রনাথ কীভাবে ত্রিপুরার ঐতিহাসিক তথ্য পেয়েছিলেন সে প্রসঙ্গে। ‘রাজর্ষি’কে পুষ্ট করার জন্য তিনি বীরচন্দ্র মাণিক্যকে চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই ‘বালক’-এ ‘রাজর্ষি’র ২৬টি অধ্যায় প্রকাশিত হয়ে যায় এবং সেই অধ্যায়গুলোতে ত্রিপুরার সে সময়কার কিছু কিছু ঐতিহাসিক তথ্যাদিও ছিল। এ ছাড়া ‘রাজর্ষি’র আগেই প্রকাশিত হয়েছে। ‘মুকুট’-ত্রিপুরার ইতিহাসাশ্রিত গল্প। তা হলে দেখা যাচ্ছে, বীরচন্দ্র মাণিক্যকে চিঠি দেয়ার আগেই ‘মুকুট’ ও ‘রাজর্ষি’র ঐতিহাসিক উপাদান রবীন্দ্রনাথের কাছে ছিল।
শুধু ঐতিহাসিক তথ্যই নয়, ত্রিপুরার প্রাকৃতিক বর্ণনা, শস্য উৎপাদন পদ্ধতি ইত্যাদিও তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। সে সময় ত্রিপুরায় জুম চাষের মাধ্যমেই প্রধানত ফসল উৎপাদন হত। সেই জুম চাষের পদ্ধতিও রবীন্দ্রনাথ যথাসম্ভব বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তিনি সে সব কী ভাবে সংগ্রহ করেছিলেন? রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় এ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, “স্বাধীন ত্রিপুরার ইতিহাস ‘রাজমালা’ গ্রন্হের সম্পাদক কৈলাসচন্দ্র সিংহ (১২৫৮-১৩২১) এই সময়ে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র সহকারী সম্পাদক; তিনি আদি ব্রাহ্ম সমাজের সহিত গভীর ভাবে সংশ্লিষ্ট। বঙ্কিমচন্দ্র ‘প্রচার’ পত্রিকার প্রবন্ধে ইঁহাকে ‘রবীন্দ্রবাবুর নায়েব’ বলিয়া উপেক্ষা করিয়াছিলেন। আমাদের মনে হয়,রবীন্দ্রনাথ কৈলাসচন্দ্রের ‘রাজমালা’র মালমশলা বোধ হয় তখনই কিছু কিছু সংগ্ৰহ করিয়াছিলেন।…”
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৬: ভারতীয় পারিবারিক জীবনে স্নেহময় জ্যেষ্ঠর ভূমিকায় রামচন্দ্র কতটা আকর্ষণীয়?

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫৩: ‘বালক’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই রবীন্দ্রনাথ ‘মুকুট’ লিখতে শুরু করেন

ত্রিপুরার ইতিহাসের আকর গ্রন্হ হিসেবে সকলের কাছে সমাদৃত ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’ প্রণেতা কৈলাসচন্দ্র সিংহ এক সময় ত্রিপুরার রাজকর্মচারী ছিলেন। পরবর্তী সময়ে মহারাজা বীরচন্দ্রের রোষানলে পড়েছিলেন তিনি। কৈলাসচন্দ্রের সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের সম্পর্ক ছিল আগে থেকেই। তিনি ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন। এই সুযোগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সংস্পর্শে এসেছিলেন। অল্প বয়সে এবং লেখালেখির প্রায় প্রথম পর্যায়ে ত্রিপুরার নানা ঐতিহাসিক তথ্যাদি তিনি কৈলাসবাবুর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। সেই সব তথ্যাদিতে শুধু রাজরাজড়ার কথা কিংবা যুদ্ধ বিগ্রহই ছিল না, ছিল জুম চাষ,সরল জুমিয়ার কথা ইত্যাদি। ত্রিপুরার তদানীন্তন জনজীবনের এক খণ্ডচিত্র যেন প্রতিফলিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সংশ্লিষ্ট রচনায়।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫০: রোজই দেখি আলাস্কা পর্বতশৃঙ্গের বাঁ দিকের চূড়া থেকে সূর্য উঠতে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’

শুধু অমর মাণিক্য নয়,সামগ্রিক ভাবে ত্রিপুরার মাণিক্য রাজাদের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা ওয়াকিবহাল হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে জন্য ‘মুকুট’-এর অব্যবহিত পরই তিনি ‘রাজর্ষি’ লিখতে শুরু করেন। ‘মুকুট’-এ যেমন ভ্রাতৃবিরোধ গল্পের মূল বিষয়, ‘রাজর্ষি’তেও চন্তাই রঘুপতির চক্রান্তের মূল হাতিয়ার তো গোবিন্দ মাণিক্যের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নক্ষত্ররায়ই! সেখানে রঘুপতি সৃষ্টি করেছেন ভ্রাতৃবিরোধ।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯২: দুর্গা টুনটুনি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৭: লুকাবো বলি, লুকাবো কোথায়?

রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত অমর মাণিক্যের আমলে মুকুট উপাখ্যান এবং গোবিন্দ মাণিক্যের রাজত্বকাল সম্পর্কে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তবে ‘রাজর্ষি’-ঐতিহাসিক উপাদান নির্ভর হলেও মূল ভাবধারায় ইতিহাস যেন গৌণ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,আসল গল্পটি হচ্ছে, ‘প্রেমের অহিংস পূজার সঙ্গে হিংস্র শক্তিপূজার বিরোধ’। ‘মুকুট’-এ প্রাধান্য পেয়েছে ত্রিপুরার রাজপরিবারের ভ্রাতৃবিরোধ, সিংহাসন নিয়ে ষড়যন্ত্রের এক প্রতীকী রূপ যেন ফুটে উঠেছে এতে।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৯: উদ্বোধনের ঠাকুরঘরে মা সারদার সঙ্গে স্বামী অরূপানন্দের কথোপকথন

আমরা জানি, ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘বালক’ পত্রিকার প্রয়োজনের তাগিদেই লেখা হয়েছিল ‘মুকুট’ ও ‘রাজর্ষি’। আবার ঠাকুর পরিবারের বালকদের অভিনয়ের প্রয়োজনেই এ দুটি রচনাকে সামনে রেখে রবীন্দ্রনাথ এ সবের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক উপাদানের পাশাপাশি চিরন্তন মানবিক আবেদন যেমন ‘মুকুট’, ‘রাজর্ষি’ ও ‘বিসর্জন’কে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে, তেমনই সে সবের মাধ্যমে ত্রিপুরাও রবীন্দ্র সাহিত্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে।—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content