শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


রবীন্দ্রনাথ ‘রাজর্ষি’র জন্য বীরচন্দ্রের কাছে গোবিন্দ মাণিক্যের রাজত্বকালীন বিবরণ চেয়েছিলেন। কেমন রাজা ছিলেন এই গোবিন্দ মাণিক্য? কেমন ছিল তাঁর রাজত্বকাল? ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে গোবিন্দ মাণিক্য ত্রিপুরার সিংহাসনে বসেন। কিন্তু রাজ্যাভিষেকের পর থেকে কনিষ্ঠ বৈমাত্রেয় ভ্রাতা নক্ষত্ররায়ের সঙ্গে মহারাজার অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রবল হয়ে ওঠে। এ নিয়ে রাজপরিবারে অশান্তি তীব্র আকার ধারণ করে। এমনকী নক্ষত্ররায় গোবিন্দ মাণিক্যের রাজ্যাভিষেককে অস্বীকার করে ছত্র মাণিক্য নাম ধারণ পূর্বক নিজ নামে মুদ্রা প্রচার করেন।
এই ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে মাত্র এক বছর রাজত্বের পর গোবিন্দ মাণিক্যের রাজ্যচ্যুতি এবং ছত্র মাণিক্যের সিংহাসন অধিকার ঘটে। কিন্তু ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের ঘটনা দুই ভাবে চিহ্নিত আছে ইতিহাসে। কৈলাসচন্দ্র সিংহ তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’-এ লিখেছেন, গোবিন্দ মাণিক্যের বংশধরদের কাছে যে ‘রাজমালা’ রয়েছে তাতে উল্লেখ রয়েছে যে,বাংলার সুলতান সুজার সাহায্যে উপযুক্ত শক্তি সঞ্চয় করে নক্ষত্ররায় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গোবিন্দ মাণিক্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন। কিন্তু মহারাজা কনিষ্ঠ ভ্রাতার অভিলাষ জেনে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ ও রক্তপাত এড়াতে স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করে বনে চলে যান। এরপর নক্ষত্ররায় সুজার বশ্যতা স্বীকার করে ছত্র মাণিক্য নাম ধারণ পূর্বক সিংহাসনে বসেন।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৮: আজও সকলের হৃদয়ে ‘রাজর্ষি’র গোবিন্দ মাণিক্যই উজ্জ্বল

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৮: সুন্দরবনের পাখি — শালিক

পক্ষান্তরে নক্ষত্ররায়ের বংশধরদের কাছে রক্ষিত ‘রাজমালা’য় রয়েছে যে,নক্ষত্ররায় ভীষণ যুদ্ধে গোবিন্দ মাণিক্যকে পরাস্ত করে ত্রিপুরার সিংহাসন অধিকার করেন। কৈলাসবাবু অবশ্য তদানীন্তন সময়ে ভারতের ইতিহাস পর্যালোচনা করে নক্ষত্ররায়ের বংশধরদের কাছে ‘রাজমালা’র বিবরণই সত্য বলে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু গোবিন্দ মাণিক্য সত্যিই কি ঋষিতুল্য রাজা ছিলেন? ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ তথা রক্তপাত এড়াতে তিনি সত্যিই কি সিংহাসন ছেড়ে দিয়েছিলেন? বীরচন্দ্র মাণিক্য ‘রাজর্ষি’র জন্য রবীন্দ্রনাথকে ‘মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্যস্য চরিতম্’ পাঠিয়েছিলেন। তাতেও ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের কথা চিত্রিত আছে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৩: গ্রহের ফের

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৩: গ্রহের ফের

বর্ণিত হয়েছে সমসাময়িক ইতিহাসও। বীরচন্দ্র প্রেরিত এই ঐতিহাসিক উপাদানে অবশ্য গোবিন্দ মাণিক্যের নির্লোভ চরিত্রটিই ধরা পড়েছে।ভ্রাতার মৃত্যুর পর প্রজাদের অনুরোধে তিনি এসে রাজ্যভার গ্রহণ করেন। যাই হোক, গোবিন্দ মাণিক্য স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করুন অথবা যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে সিংহাসন হারান-যাই ঘটুক না কেন, ভ্রাতৃবিরোধের কারণেই তিনি যে সিংহাসনচ্যুত হয়েছিলেন এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। সিংহাসনচ্যুতির পর তিনি প্রথমে চলে গিয়েছিলেন রাজ্যের প্রান্তীয় এলাকার রিয়াং অধ্যুষিত অঞ্চলে। সেখানে কিছুদিন বসবাসের পর তিনি চলে যান চট্টগ্রামের পূর্ব দিকের পার্বত্য এলাকায়।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১৬: পূতিমাংসজাতক—শেয়ালের বুদ্ধি না ছাগলের বুদ্ধি?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৭: উত্তরণ-অবতরণ শেষে স্বপ্নের ‘সূর্যতোরণ’

ত্রিপুরার রাজপরিবারে যখন ভ্রাতৃবিরোধ তীব্র আকার ধারণ করেছিল তখন ভারতের প্রধান শাসনকেন্দ্রেও মোগল পরিবারের তীব্র ভ্রাতৃবিরোধ সাম্রাজ্যের প্রায় সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। সম্রাট শজাহানের জীবদ্দশাতেই তাঁর পুত্রদের মধ্যে মসনদ নিয়ে সংঘর্ষ শুরু হয়ে গিয়েছিল। শাহজাহান পুত্র সুজা তখন সুবে বাংলার শাসনকর্তা। সেজন্য বাংলাদেশ এবং সন্নিহিত এলাকাও মোগলদের এই ভ্রতৃঘাতী যুদ্ধের আঁচ পেয়েছিল। ত্রিপুরাতেও হয়তো লেগেছিল সেই ঝড়ের ছোঁয়া।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০২: ভরতের মতো একমুখী লক্ষ্যে এগিয়ে চলা কী সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১২: দারুণ এক গগনবিহারী খেলনা বানিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ

ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ বলেছেন, ঔরঙ্গজেব ও তাঁর সেনাপতি মিরজুমলার কাছে পরাস্ত হয়ে সুজা সেদিন ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চল হয়ে প্রথমে চট্টগ্রাম ও পরে আরাকান গিয়েছিলেন। আবার কেউ বলেছেন, সুজা ঢাকা থেকে জলপথে আরাকান পাড়ি দিয়েছিলেন সেদিন। মোগল পরিবারের ভ্রাতৃবিরোধ ও যুদ্ধের কথাও ‘রাজর্ষি’তে রয়েছে। —চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content