শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


ত্রিপুরার রাজার অমর মাণিক্যের ঘটনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন গল্প 'মুকুট'।

একটি স্বপ্নলব্ধ গল্পের সূত্রে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে কেমন নিবিড় ভাবে জড়িয়ে পড়লেন সে যেমন এক চমকপ্রদ কাহিনি, তেমনই রবীন্দ্রসাহিত্যে ত্রিপুরার অন্তর্ভুক্তি কম কৌতুহলোদ্দীপক নয়। মানবিক মূল্যবোধের উপন্যাস ‘রাজর্ষি’কে ত্রিপুরার ঐতিহাসিক উপাদানে পুষ্ট করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি সে জন্য মহারাজা বীরচন্দ্রের কাছে গোবিন্দ মাণিক্যের রাজত্বকালীন ইতিহাস চেয়ে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে শেষপর্যন্ত কতটুকু ইতিহাস রক্ষিত হয়েছে? ‘রাজর্ষি’ অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ‘বিসর্জন’ নাটক।
আবার ত্রিপুরার রাজার অমর মাণিক্যের ঘটনা নিয়ে তিনি লিখেছেন গল্প ‘মুকুট’, নাট্যরূপও দিয়েছেন তার। রবীন্দ্রসাহিত্যে ত্রিপুরার এই অবস্থান একদিকে যেমন ঔজ্জ্বল্য দিয়েছে ত্রিপুরাকে, তেমনই ইতিহাস অনুসন্ধানে এক নতুন দিগন্তও যেন খুলে দিয়েছে তা। আজ স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রশ্ন উঠতে পারে যে,’রাজর্ষি’র গোবিন্দ মাণিক্য কি সত্যিই এক ঋষিতুল্য রাজা ছিলেন? তিনি কি ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ এড়াতে স্বেচ্ছায় সিংহাসন ছেড়ে দিয়েছিলেন? না কি বৈমাত্রেয় ভ্রাতার সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন? ‘মুকুট’-এর অমর মাণিক্যের পুত্র কি আরাকান রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে মুকুট এনেছিলেন? না,ত্রিপুরার রাজকুমারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মগ নৃপতি গুপ্তচর মারফত গজদন্ত মুকুট পাঠিয়েছিলেন ত্রিপুরা শিবিরে?
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৫: শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষতায় বীরবিক্রম

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৫: রবীন্দ্রনাথ ভয় পেতেন মহর্ষিদেবকে

এই ভাবে ইতিহাস নিয়ে অনুসন্ধান।কখনো কল্পকাহিনীর বেড়াজালে রুদ্ধ হয়ে যায় তার স্রোত।তবু সাহিত্যে অমর হয়ে থাকে কোনও কোনও চরিত্র। ইতিহাস যেন সেখানে গৌণ হয়ে পড়ে। হয়তো বা ‘রাজর্ষি’র গোবিন্দ মাণিক্য এমনই এক চরিত্র। কিন্তু আশ্চর্য,রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি স্বপ্নলব্ধ গল্পকে ত্রিপুরার ঐতিহাসিক উপাদানে পুষ্ট করে যে ‘রাজর্ষি’ আমাদের দিয়েছেন তাই যেন ত্রিপুরার আসল ইতিহাস হয়ে আছে এবং বলা যায় এর মাধ্যমে যেন ত্রিপুরা ইতিহাসেও স্হান করে নিয়েছে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৭: পাঞ্চালীকে আশীর্বাদ করে আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন গান্ধারী

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮২: সুন্দরবনের পাখি—টিয়া

আরও দীর্ঘকাল রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে গবেষণা হবে। হয়তো পাদপ্রদীপের সামনে আসবে ‘রাজর্ষি’, তার কেন্দ্রীয় চরিত্র রাজা গোবিন্দ মাণিক্য।কোনটা ইতিহাস আর কোনটা নয়-তা নিয়ে আলোচনার জানালাটাও খোলা থাকবে।গল্প এবং নাটক ‘মুকুট’-এর ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়।ত্রিপুরার ইতিহাসে অমর মাণিক্য এক বীর নৃপতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। কিন্তু আরাকান রাজার সঙ্গে যুদ্ধের সময় একটি মুকুট ঘিরে পুত্রদের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব শেষপর্যন্ত অমর মাণিক্যের রাজত্বের সর্বনাশ ডেকে এনেছিল।কিন্তু ‘মুকুট’-এর ঐতিহাসিক উপাদান কতটা সঠিক ইতিহাসের উপর প্রতিষ্ঠিত তা নিয়েও আলোচনার অবকাশ রয়েছে।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৫: শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষতায় বীরবিক্রম

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৭: ভাগ নুনিয়া, ভাগ

রবীন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে তাঁর গল্প, উপন্যাস কিংবা নাটকে চরিত্র সহ পটভূমি বাছতে কেন ত্রিপুরার দিকে দৃষ্টি দিলেন অর্থাৎ ত্রিপুরা কেন তাঁকে আকৃষ্ট করল সেটা এক প্রশ্ন। স্বাভাবিক ভাবেই মনে হতে পারে যে,ত্রিপুরা ছাড়া অন্য কোনও এলাকার ঐতিহাসিক উপাদানও তো সে সময়ে রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করতে পারত।সম্ভবত ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের কারণেই ত্রিপুরা কবিকে আকৃষ্ট করেছিল।
আরও পড়ুন:

শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭০: অনিশ্চিত ফলের পিছনে না ছুটে নিশ্চিত ফল-প্রদায়ক কাজের প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত

মহারাজা বীরচন্দ্র থেকে তাঁর প্রপৌত্র মহারাজা বীরবিক্রম-ত্রিপুরার এই চার মাণিক্য রাজার সঙ্গেই কবির যোগাযোগ ছিল। একটি স্বপ্নলব্ধ গল্পকে ঐতিহাসিক উপাদানে পুষ্ট করার তাগিদে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যকে ১২৯৩ বঙ্গাব্দে প্রথম পত্র দিয়েছিলেন। যদিও ‘রাজর্ষি’র জন্য এই পত্র-সূত্রেই কবির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের যোগাযোগের সূত্রপাত, তবু তার আগে ‘ভগ্ন হৃদয়’ কাব্যগ্ৰন্হের জন্য মহারাজ বীরচন্দ্র কর্তৃক অভিনন্দিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content