মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য।
বীরচন্দ্র থেকে বীরবিক্রম-ত্রিপুরার চার মাণিক্য রাজার সঙ্গেই ছিল কবির সম্পর্ক। এক রাজবংশের চারজন রাজার সঙ্গে কবির এই সম্পর্কের ধারাবাহিকতা নিঃসন্দেহে এক আশ্চর্য ঘটনা। প্রথম যোগাযোগের সময় বীরচন্দ্র প্রৌঢ়, কবি তরুণ বয়স্ক। আর শেষ বেলায় বীরবিক্রম যখন যুবক রাজা কবি তখন প্রৌঢ়। বীরবিক্রমের সঙ্গে কবির বার কয়েক সাক্ষাৎ ঘটেছে। ত্রিপুরার পুরাতাত্ত্বিক সম্পদ সংরক্ষণে কবি রাজাকে পরামর্শ দিয়েছেন।
১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন শেষবারের মতো আগরতলা সফরে আসেন তখনই কবির সঙ্গে নবীন রাজা বীরবিক্রমের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটেছিল। এই সফরকালে কবি রাজাকে ত্রিপুরার প্রত্ন সম্পদের উপযুক্ত সংরক্ষণের পরামর্শ দেন। ‘রাজমালা’, ‘গীত চন্দ্রোদয়’ সম্পাদনা, ত্রিপুরার প্রাচীন মন্দির, প্রাসাদ ইত্যাদির সংরক্ষণের বিষয়াদি নিয়ে কবি ও রাজার মধ্যে আলোচনা হয়।
আরও পড়ুন:
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৪: ত্রিপুরার মাণিক্য রাজাগণ সর্বদা সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করে গিয়েছেন
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৫: রবীন্দ্রনাথ ভয় পেতেন মহর্ষিদেবকে
১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথের ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে কলকাতার টাউন হলে রবীন্দ্র শিল্প মেলা ও প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। বীরবিক্রম এই মেলার উদ্বোধন করেছিলেন। অনুষ্ঠানে ভাষণ প্রসঙ্গে রাজা তাঁর পিতা,পিতামহ ও প্রপিতামহের সঙ্গে কবির সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। রাজা আরও বলেন, নিজ দেশের শিল্পকলাকে যথার্থ ভাবে দেখার শিক্ষা আমরা কবির কাছেই পেয়েছি। ১৯৩৯ সালে বীরবিক্রম শান্তিনিকেতন সফর করেন।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৯: টাকা-পয়সা থাকলে চোর-ডাকাতকেও লোকে সম্মান দেখায়
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৭: ভাগ নুনিয়া, ভাগ
৭ জানুয়ারি আম্রকুঞ্জে রাজাকে আনুষ্ঠানিক সম্বর্ধনা জানানো হয়।বিশ্বভারতীর অধ্যাপক, ছাত্রছাত্রী সহ আশ্রমবাসীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৪১ সালের ২৫ বৈশাখ মহারাজা বীরবিক্রম রবীন্দ্রনাথকে ‘ভারত ভাস্কর’ উপাধি প্রদান করেন।এই উপলক্ষ্যে আগরতলায় উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদের খাস দরবার হলে অনুষ্ঠিত হয় ‘রবীন্দ্র জয়ন্তী’ বিশেষ দরবার। তারপর শান্তিনিকেতনে কবির হাতে ‘ ভারত-ভাস্কর’ অভিজ্ঞানপত্র তুলে দেবার বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৬: রাজনৈতিক পরিসরে অখ্যাতি ও সন্দেহর আবিলতা থেকে কি মুক্তি সম্ভব?
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮১: সুন্দরবনের পাখি—বেনে বউ
রবীন্দ্রানুরাগী হিসেবে সেদিন ত্রিপুরার রাজা বীরবিক্রমের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার বাইরেও। ১৯৪১ সালের জুন মাসে মহারাজা পুরীতে রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসবের উদ্বোধন করেন। পুরী বঙ্গ সাহিত্য পরিষদ ও পুরী সঙ্গীত সম্মিলনীর পক্ষ থেকে মহারাজাকে সম্বর্ধনা জানানো হয়।
আরও পড়ুন:
শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৮: মা সারদার ‘পরকে আপন করা’
সাহিত্য চর্চা,গীত রচনা তথা সাহিত্য-সংস্কৃতির উদার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য বীরবিক্রম উজ্জ্বল হয়ে আছেন ত্রিপুরার ইতিহাসে।রাজার সঙ্গে কবির সম্পর্কের অধ্যায় নিঃসন্দেহে সেই ইতিহাসকে আরও ঔজ্জ্বল্য দান করেছে।১৯৪৭ সালের ১৭ই মে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন বীরবিক্রম। মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে ত্রিপুরার ভারতভুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন তিনি।—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।