
রাজা বীরবিক্রম।
বীরবিক্রম তাঁর রাজত্বকালে ত্রিপুরায় শিক্ষা সম্প্রসারণেও বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা, প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা, গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় স্হাপনের উদ্যোগ, শিক্ষায় উৎসাহদানের জন্য নানা রকম স্কলারশিপ-স্টাইপেন্ড ইত্যাদির প্রবর্তনে রকম বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছিলেন রাজা। শিক্ষাকে আরও ব্যাপক ও অর্থবহ করার জন্যও সচেষ্ট ছিলেন তিনি।
এই উদ্দেশ্যে রাজা তাঁর দুই বৈমাত্রেয় ভাইকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় প্রদেশের (বর্তমান মধ্যপ্রদেশ) রাজকুমার কলেজে পাঠিয়েছিলেন। রাজ্যে বিভিন্ন স্তরের স্কুলের শিক্ষক সংখ্যাও বাড়িয়েছিলেন তিনি। বীরবিক্রম ১৯৩১ সালে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিলেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটি আদেশপত্রের কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে—”… যেহেতু এ রাজ্যের প্রজা সাধারণের সর্ব্বাঙ্গীন কল্যাণ কামনায় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলন করা এ পক্ষের অভিপ্রেত অতএব কার্য্যে পরিণত করা হউক, ইতি। সন ১৩৪১ ত্রিপুরাব্দ, তারিখ ২০শে ভাদ্র”।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৯: সুন্দরবনের পাখি: টুনটুনি

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪২: রবীন্দ্রনাথকে ‘ভারত ভাস্কর’ উপাধি দিয়েছিলেন রাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য
সম্ভবত রাজার এই অভিপ্রায় সর্বত্র বাস্তব রূপ পেতে কিছু বিলম্ব ঘটেছিল। কারণ দেখা যাচ্ছে কয়েক বছর পরে ১৯৩৮ সালে সদর বিভাগে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রবর্তন বিষয়ে এক আদেশনামা জারি হয়েছিল। তাতে হাওড়া নদীর উপত্যকা ও বিভাগীয় শহর সমূহের কিছু সীমিত এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪২: রবীন্দ্রনাথকে ‘ভারত ভাস্কর’ উপাধি দিয়েছিলেন রাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৪: আশ্রমের আনন্দময় পিকনিক
এখানে সংশ্লিষ্ট আদেশ পত্রটি উল্লেখ করা হচ্ছে—”রোবকারী দরবার শ্রী শ্রীযুত মহারাজ বীরবিক্রম কিশোর দেববর্ম্মা মাণিক্য বাহাদুর,এলাকে স্বাধীন ত্রিপুরা, রাজধানী আগরতলা, ইতি। ১৩৪৮ ত্রিপুরাব্দ, তারিখ ১৬ই আশ্বিন। যেহেতু এ রাজ্যের প্রজা সাধারণ মধ্যে দ্রুত গতিতে শিক্ষা বিস্তার কল্পে উপযুক্ত ব্যবস্থাদি প্রবর্ত্তন করা এ পক্ষের অভিপ্রেত, অতএব এতদ্বারা ঘোষণা করা যায় যে, আগামী বর্ষ হইতে আপাততঃ সদর বিভাগান্তর্গত হাওড়া নদীর উপত্যকা মধ্যে মফঃস্বলস্হ বিভাগীয় নগর সমূহে বিজ্ঞাপিত এলাকা মধ্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্ত্তন করা হউক, ইতি।”
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
রাজ্যে উচ্চ শিক্ষা প্রসারেও বীরবিক্রম বিরাট পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৩৮ সালে গঠিত হয়েছিল বিদ্যাপত্তন গভর্ণিং কমিটি। বিদ্যাপত্তনের গৃহ নির্মাণ সহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজের জন্য কমিটির কাছে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। দশজন উচ্চ পদস্থ রাজকর্মচারীকে নিয়ে গঠিত গভর্নিং কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন রাজমন্ত্রী (পরে প্রেসিডেন্ট হন প্রধানমন্ত্রী)। উল্লেখ করা যায় যে, শুধু একটি কলেজ প্রতিষ্ঠাই নয়, রাজার পরিকল্পনা ছিল ‘বিদ্যাপত্তন’ প্রকল্পের অধীনে একটি গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় স্হাপন। তাঁর ইচ্ছা ছিল এই গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকবে সাধারণ ডিগ্রি কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, কৃষি, চারুকলা ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। কিন্তু রাজার অকাল মৃত্যুর জন্য এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারেনি। তাঁর মৃত্যুর পর অবশ্য মহারাজা বীরবিক্রম কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিদ্যাপত্তন প্রকল্পের কিছুটা বাস্তবায়িত হয়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৪: দশরথপুত্র ভরত, এক ব্যতিক্রমী চরিত্র, বর্তমানের নিরিখে এক বিরলতম প্রজাতি

মুলো খেতে আপত্তি নেই, তা হলে তার পাতার কী দোষ করল? এই শাকের কত পুষ্টিগুণ জানেন?
বীরবিক্রম পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থায় উৎসাহী থাকলেও দেশীয় টোল, মক্তব ও মাদ্রাসা সমূহকে পর্যাপ্ত অনুদান দিয়েছিলেন তিনি। রাজ্যে এই সব প্রতিষ্ঠান তখন উল্লেখযোগ্য ভাবে সক্রিয় ছিল। রাজ্যে সিভিল সার্ভিসে নিয়োগের অন্যতম শর্ত ছিল মেধা।স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্যের মেধাবী তরুণরা তখন এই সার্ভিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। বীরবিক্রম যেমন তৃণমূল স্তরে শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগী ছিলেন, তেমনই শিক্ষাকে আরও কার্যকরী করার দিকেও তাঁর নজর ছিল। প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষার প্রসারেও যত্নবান ছিলেন তিনি। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার মধ্যেও রাজার এইসব উদ্যোগ আমাদের নজর কাড়ে। —চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।/strong>