রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহারাজা রাধাকিশোর।
রাধাকিশোর পুত্র মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্র কিশোর। বন্ধু রাজা রাধাকিশোর ও রাজপুত্র ব্রজেন্দ্র কিশোরের সঙ্গে পত্র যোগাযোগের সূত্রেই আমাদের কাছে ধরা দেন এক অন্য রবীন্দ্রনাথ। ত্রিপুরার প্রতি কবির যে অন্তরের টান ছিল তা যেমন বোঝা যায় এই সব চিঠিপত্রে, তেমনই রাজ্যের কল্যাণে ব্রজেন্দ্র কিশোর যেন সম্পূর্ণ ভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেন কবি তাঁকে সেই পরামর্শও দেন। মহারাজকুমারের উপর কবির অগাধ আস্হাও প্রকাশ পেয়েছে এই সব চিঠিপত্রে।
ছোটবেলা থেকেই ব্রজেন্দ্র কিশোর রবীন্দ্রনাথের স্নেহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। রাজার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্রেই বারবার কবির সঙ্গে রাজপুত্রের সাক্ষাৎ ঘটেছে। এমনকি কবি বিদেশ সফরেও সঙ্গী করেছেন তাঁকে। নানা সময়ে কবি মহারাজকুমারকে চিঠি দিয়েছেন। এইসব চিঠিপত্রে ত্রিপুরার উন্নয়নের পাশাপাশি মহারাজকুমারের উপর কবির ভরসা ধরা পড়েছে। ১৩১৬ বঙ্গাব্দের ২৭ ভাদ্র কবি তাঁকে লিখছেন—”…তোমাদের মাথার উপরে প্রকাণ্ড ঋণভার আছে এবং ঘরে বাহিরে তোমাদের শত্রুর অভাব নাই-ইহাতে মহারাজকে অনেকটা সংযত ও সতর্ক করিয়া রাখিবে সন্দেহ নাই …ত্রিপুরা রাজ্যের উন্নতি চূড়াতেই তোমার জীবনের সার্থকতা প্রতিষ্ঠা লাভ করিবে।…”
ছোটবেলা থেকেই ব্রজেন্দ্র কিশোর রবীন্দ্রনাথের স্নেহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। রাজার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্রেই বারবার কবির সঙ্গে রাজপুত্রের সাক্ষাৎ ঘটেছে। এমনকি কবি বিদেশ সফরেও সঙ্গী করেছেন তাঁকে। নানা সময়ে কবি মহারাজকুমারকে চিঠি দিয়েছেন। এইসব চিঠিপত্রে ত্রিপুরার উন্নয়নের পাশাপাশি মহারাজকুমারের উপর কবির ভরসা ধরা পড়েছে। ১৩১৬ বঙ্গাব্দের ২৭ ভাদ্র কবি তাঁকে লিখছেন—”…তোমাদের মাথার উপরে প্রকাণ্ড ঋণভার আছে এবং ঘরে বাহিরে তোমাদের শত্রুর অভাব নাই-ইহাতে মহারাজকে অনেকটা সংযত ও সতর্ক করিয়া রাখিবে সন্দেহ নাই …ত্রিপুরা রাজ্যের উন্নতি চূড়াতেই তোমার জীবনের সার্থকতা প্রতিষ্ঠা লাভ করিবে।…”
ব্রজেন্দ্র কিশোর বলেছেন বালক বয়সেই তাঁকে কবি স্নেহ বন্ধনে বেঁধে নিয়েছিলেন। কবির সাবধানী আশীর্বাণী তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছিল। কবির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ সম্পর্কে মহারাজকুমার বলেছেন-“তখন আমার বয়স ১২/১৪ বৎসর-সেই সময়েই আমার রবীন্দ্র সন্দর্শনের সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই দীর্ঘ সৌম্য মূর্ত্তি-দীর্ঘ কুঞ্চিত কেশদামে কি কমনীয় দেখাচ্ছিল।বালক মনে যে এক অনির্ব্বচনীয় আবেগের সঞ্চার করেছিল,তা আজও বেশ স্মরণে আছে।…” কবি সম্পর্কে তিনি আরও বলেছেন—”আমি আজীবন তাঁর স্নেহের ডোরে -সর্ব্ব অবস্থায়-বাঁধা থাকবার সৌভাগ্য লাভ করেছি-এটা আমার পরম লাভ।”
আরও পড়ুন:
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪০: কবি ও বীরেন্দ্র কিশোর
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০২: দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি
রবীন্দ্রনাথ তাঁদের জমিদারি শিলাইদহ কুঠি বাড়িতেও ব্রজেন্দ্র কিশোরকে নিয়ে গিয়েছিলেন একবার।শিলাইদহের সেই সফরের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে পরবর্তী সময়ে মহারাজকুমার বলেছেন,কবি পত্নীর আদর যত্নের কথা তিনি ভুলতে পারেন না। নানা ধরণের চমৎকার রান্না করে খাওয়াতেন তিনি। কখনও কবি নিজেও নতুন নতুন রান্নার পদ্ধতি বলে দিতেন। কবির সঙ্গে রাজপুত্র এসেছেন জমিদারীতে। সম্মান প্রদর্শনে একদিন সভা করে পৃথক আসনে বসানো হল তাঁকে। তারপর মস্ত বড় থালাতে করে অনকগুলো টাকা তাঁর সামনে তুলে ধরা হল। কলকাতায় ফিরে সেই টাকায় কবি বেছে বেছে অনেক বই কিনে দিলেন ব্রজেন্দ্র কিশোরকে। বই পড়ার উপযোগিতা সম্পর্কে উপদেশও দিলেন।মহারাজকুমার শিলাইদহের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বই ক্রয় প্রসঙ্গে বলেছেন—”সেই হইতেই আমার বই পড়ার অভ্যাস ও আগ্রহ যা আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে।”
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৮: সুন্দরবনের পাখি—শামুকখোল
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৫: ‘ছেলেদের জন্য আমার কোনও নিয়মকানুন থাকে না’
বোলপুরে ব্রহ্মবিদ্যালয়ে মহারাজকুমারের শিক্ষাদানের ব্যাপারে কবির আগ্রহ থাকলেও তা আর হয়ে উঠেনি। ইংরেজ আমলে দেশীয় রাজ্যের রাজপুত্র সাধারণ ছেলেদের সঙ্গে পড়তে যাবে? নানা প্রশ্ন উঠল এ নিয়ে। শেষপর্যন্ত ব্রহ্মবিদ্যালয়ে মহারাজকুমারের যোগদান বন্ধ হয়ে গেল।এতে ব্রজেন্দ্র কিশোরের হৃদয় যে ব্যথাতুর হয়ে উঠেছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মহারাজকুমারকে কুমিল্লায় সাহেবদের ক্লাবে প্রবেশ করানো হয়েছে শুনে কবি দুঃখিত হয়ে লিখলেন—”এই বিজাতীয় বর্ব্বর গুলোর অশিষ্ট ঔদ্ধত্য এবং কদর্য্য আচার অত্যন্ত পীড়াদায়ক। বিশেষতঃ তাহারা আমাদিগকে চায় না,আমাদিগকে অবজ্ঞা করে,অথচ আমরা তাহাদের পশ্চাতে ঘুরিয়া বেড়াই ইহা আমাদের পক্ষে অপমানকর।…”
আরও পড়ুন:
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৯: আসছে আমার পাগলা ঘোড়া
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৩: কালাদেওর কবলে
ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমের আদর্শ সম্পর্কে কবি ব্রজেন্দ্র কিশোরকে লিখলেন—”আমি ভারতবর্ষীয় ব্রহ্মচর্য্যের প্রাচীন আদর্শে আমার ছাত্রদিগকে নির্জ্জনে নিরুদ্বেগে পবিত্র নির্ম্মল ভাবে মানুষ করিয়া তুলিতে চাই-তাহা দিগকে সর্ব্ব প্রকার বিলাতী বিলাস ও বিলাতের অন্ধ মোহ হইতে দূরে রাখিয়া ভারতবর্ষের গ্লানিহীন পবিত্র দারিদ্র্যে দীক্ষিত করিতে চাই।…”
১৩০৮ বঙ্গাব্দের ২৪ চৈত্রে লেখা এই চিঠিতে কবি ব্রজেন্দ্র কিশোরকে আরও লেখেন—”ইংরাজ শিক্ষক তোমার এই স্বাভাবিক তেজকে ম্লান ও নির্ব্বাপিত করিবার অনেক চেষ্টা করিবে-সেই প্রতিকূল চেষ্টায় তোমার তেজ বর্দ্ধিত হইয়া এই দুরূহ পরীক্ষা হইতে তোমাকে উত্তীর্ণ করুক। ভারতবর্ষের আশীর্বাদ তোমাকে রক্ষা করুক,ঈশ্বরের অভয়হস্ত তোমাকে রক্ষা করুক,তোমার নিজের প্রতিভা তোমাকে রক্ষা করুক। বিদেশি ম্লেচ্ছতাকে বরণ করা অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয় ইহা হৃদয়ে গাঁথিয়া রাখিয়ো।…”স্বদেশ সম্পর্কে কবির চিন্তা চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে মহারাজকুমারকে দেয়া তাঁর চিঠিপত্রে।
১৩০৮ বঙ্গাব্দের ২৪ চৈত্রে লেখা এই চিঠিতে কবি ব্রজেন্দ্র কিশোরকে আরও লেখেন—”ইংরাজ শিক্ষক তোমার এই স্বাভাবিক তেজকে ম্লান ও নির্ব্বাপিত করিবার অনেক চেষ্টা করিবে-সেই প্রতিকূল চেষ্টায় তোমার তেজ বর্দ্ধিত হইয়া এই দুরূহ পরীক্ষা হইতে তোমাকে উত্তীর্ণ করুক। ভারতবর্ষের আশীর্বাদ তোমাকে রক্ষা করুক,ঈশ্বরের অভয়হস্ত তোমাকে রক্ষা করুক,তোমার নিজের প্রতিভা তোমাকে রক্ষা করুক। বিদেশি ম্লেচ্ছতাকে বরণ করা অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয় ইহা হৃদয়ে গাঁথিয়া রাখিয়ো।…”স্বদেশ সম্পর্কে কবির চিন্তা চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে মহারাজকুমারকে দেয়া তাঁর চিঠিপত্রে।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৫: ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এবং চলচ্চিত্র
এই রাজপুত্রের মানসিক গঠনকে কবি দূর থেকেও যেন চিঠির মাধ্যমে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন। শিক্ষা, ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য, প্রজাপালন, স্বদেশানুরাগ—সর্ব বিষয়ে কবি সময়ে সময়ে তাঁকে চিঠি লিখেছেন। ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমের প্রথম বিদেশি ছাত্র (জাপানি) হোরির সংস্কৃত শিক্ষা গ্রহণ সম্পর্কে কবি যেমন লিখেছেন,তেমনই কবি তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কেও অবহিত করেছেন ব্রজেন্দ্র কিশোরকে। ১৩০৯ বঙ্গাব্দের ১৩ শ্রাবণ কবি তাঁকে লিখছেন—”…আগামী মাসের বঙ্গদর্শনে ভারতবর্ষের ইতিহাস নামে আমার একটি প্রবন্ধ বাহির হইবে,মনোযোগপূর্ব্বক পাঠ করিয়া দেখিও।” কবির হৃদয়ে ব্রজেন্দ্র কিশোর যে বিরাট এক স্হান দখল করে ছিলেন তা বোঝা যায় তাঁকে দেয়া নানা চিঠিপত্রে। ১৩০৯ বঙ্গাব্দের ১লা কার্তিক কবি লিখেছেন—”… আমি বঙ্গদর্শনে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে যখন কিছু লিখি তুমি আমার স্মরণপথে জাগরুক থাক।তোমাকে আমি নিকটে রাখিতে পারি নাই কিনা। —চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।