বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের রাজত্বকালে (১৮৬২-১৮৯৬ খ্রিঃ) ত্রিপুরায় রাজকার্যে প্রচলিত বাংলা আরও উন্নত হয়েছিল। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে বীরচন্দ্রের যৌবরাজ্যে অভিষেক বিষয়ে প্রচারিত রোবকারীটির কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যুর পর এক বিতর্কিত রোবকারি মূলে রাজা হয়েছিলেন বীরচন্দ্র। কিন্তু বীরচন্দ্রের বিরোধী পক্ষ এই রোবকারীটির সত্যতা নিয়ে সেদিন চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তা নিয়ে মামলা মোকদ্দমার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সে অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।

তখনকার প্রশাসনিক বাংলা গদ্যের নমুনা দেখার জন্য রোবকারীটির কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে— “…এ পক্ষ বাতব্যাধি পীড়াতে শারীরিক কাতর হওয়া প্রযুক্ত রাজত্ব ও জমিদারী শাসন বিষয়ী কার্য্য সুচারু মতে নির্ব্বাহ হইতেছে না এবং যে প্রকার ব্যামোহ ইঁচ্ছাধীন কোন সময় প্রাণ বিয়োগ হয় তাহারও নিশ্চয় নাই এ মতেই এ পক্ষের খান্দানের চিররীতি মতে ঐ কার্য্য নির্ব্বাহ তদর্থক যুবরাজ ও বড় ঠাকুর ও কর্ত্তা নিযুক্ত করা প্রয়োজন, সে মতে হুকুম হইল যে, যুবরাজি পদে এ পক্ষের ভ্রাতা শ্রীল শ্রীমান বীরচন্দ্র ঠাকুর ও বড়ঠাকুর পদে প্রথম পুত্র শ্রীল শ্রীমান ব্রজেন্দ্র চন্দ্র ঠাকুর ও কর্ত্তা পদে দ্বিতীয় পুত্র শ্রীল শ্রীমান নবদ্বীপ চন্দ্র ঠাকুরকে নিযুক্ত করা যায় ও এ বিষয়ের এত্তেলা স্বরূপ এই রোবকারীর এক এক কিত্তা নকল জেলা চট্টগ্রাম ও জেলা ঢাকা প্রদেশের শ্রীল শ্রীযুক্ত দায়ের সায়ের কমিসনর সাহেব বাহাদুরান ও জেলা ত্রিপুরা ও জেলা শ্রীহট্টের শ্রীল শ্রীযুক্ত জজ সাহেব ও শ্রীযুক্ত কালেক্টর সাহেব ও শ্রীযুক্ত মাজেস্টেট সাহেব বাহাদুরান হুজুরে প্রেরণ হয় ইতি।”
এই রোবকারিটি থেকে বোঝা যাচ্ছে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের তুলনায় বীরচন্দ্রের আমলে রাজকার্যে ব্যবহৃত বাংলা গদ্য সরল হয়েছিল। এই প্রশাসনিক গদ্য যাতে আরও সরল ও সর্ব সাধারণের বোধগম্য হয় তার জন্য রাজা যথেষ্ঠ যত্নবান ও উদ্যোগী ছিলেন। রাজকীয় আইন- কানুন বাংলা ভাষায় লিখিত রূপে প্রচারের কাজের সূচনা হয়েছিল বীরচন্দ্রের আমলে।দরখাস্ত, জবাব ইত্যাদি বিশুদ্ধ বাংলায় লেখা সম্পর্কে রাজাদেশ জারি হয়েছিল ১৮৭৪ সালে। আদেশনামাটি হচ্ছে—”অত্র রাজগীস্হ আফিস সমূহে যে সকল আরজি ও জওয়াব ও দরখাস্তাদি দাখিল হয় তাহা নিতান্ত কদর্য্য ও কদক্ষরে বাহুল্য কথায় লিখা হওয়া হেতুক সময়ে সময়ে অনেক অসুবিধার কারণও তাহা বোধগম্যের ও পাঠের অনুপযোগী হওয়ায় আদালতের সময়ে সময়ে অনেক কষ্ট স্বীকার করিতে ও অনর্থক সময় কর্ত্তন করিতে বাধ্য হইতে হয়। অতএব হুকুম হইল যে, বর্ত্তমান সনের আগত ১৫ই জ্যেষ্ঠ হইতে যে সকল আর্জি ও জওয়াব ও দরখাস্ত ইত্যাদি অত্র রাজগীস্হ আফিস সমূহে দাখিল করিবে তাহা স্পষ্টাক্ষরে বিশুদ্ধ বাঙ্গালা ভাষাতে প্রয়োজনীয় বিবরণযুক্তে সংক্ষেপ রূপে লিখিয়া দাখিল করিতে হইবে তদভাবে উল্লিখিত কাগজাত কোন আদালতে গ্রাহ্য হইবে না।…”
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩২: কল্যাণ মাণিক্যের সনদে বাংলা গদ্য

শারদীয়ার গল্প: তখন বিকেল/৪

মহারাজা বীরচন্দ্রের আমল থেকে ত্রিপুরায় ইংরেজ আধিপত্য সুদৃঢ় হতে থাকে। প্রথম পলিটিক্যাল এজেন্ট নিযুক্তি-সহ ধাপে ধাপে ইংরেজ আধিকারিকদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বীরচন্দ্রের পর ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা হলেন পুত্র রাধাকিশোর মাণিক্য। রাধাকিশোরের রাজত্বকালে ইংরেজ কর্মচারী ও ইংরেজি ভাবাপন্ন কর্মচারীদের প্রভাবে রাজকার্যে ইংরেজির প্রভাব বাড়তে থাকে। এতে মহারাজ রাধাকিশোর ক্ষুব্ধ হয়ে মন্ত্রী অন্নদাচরণ গুপ্ত মহোদয়কে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে এক পত্রে লেখেন—”এখানকার রাজভাষা বাঙ্গালা। বাঙ্গালাতেই সরকারী লিখাপড়া হওয়া সঙ্গত।ইদানীং কোন কোন স্হলে সরকারী কার্য্যে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার হইতেছে ইহা আমি জানিতে পারিয়াছি।যাহাতে এরূপ কার্য্য না হয় তাহার প্রতিবিধান করিয়া দিবে। অবশ্য যে কার্য্যে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার অনিবার্য্য তথায় ইংরেজি ভাষা ব্যবহার অবশ্য কর্ত্তব্য হইবে। যেমন Political Deptt. এরূপস্হা ব্যতীত অনর্থক ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করিয়া প্রচলিত ভাষাকে উপেক্ষা করা সঙ্গত হইবে না।”
আরও পড়ুন:

বসুন্ধরা এবং…, ৩য় খণ্ড, পর্ব-৩৯: বিজয়া দশমী

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

পরবর্তী সময়ে অপর এক আদেশে মন্ত্রী রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায়কে রাধাকিশোর বলেন—”এখানে আবহমান রাজকার্য্যে বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং এই ভাষার উন্নতিকল্পে নানারূপ অনুষ্ঠান চলিয়া আসিতেছে, ইহা বঙ্গদেশীয় হিন্দু রাজার পক্ষে বিশেষ গৌরবজনক মনে করি। বিশেষত আমি বঙ্গভাষাকে প্রাণের তুল্য ভালবাসি এবং রাজকার্য্যে ব্যবহৃত ভাষা যাহাতে দিন দিন উন্নত হয়, তৎপক্ষে চেষ্টিত হওয়া একান্ত কর্ত্তব্য মনে করি। ইংরেজি শিক্ষিত কর্মচারীবর্গের দ্বারা রাজ্যের এই চিরপোষিত উদ্দেশ্য ও নিয়ম ব্যর্থ না হয়,সে বিষয়ে আপনি তীব্র দৃষ্টি রাখিবেন।” এখানে উল্লেখ করা যায় যে, মহারাজ রাধাকিশোর বলছেন তিনি বঙ্গভাষাকে ‘প্রাণের তুল্য’ ভালবাসেন। এ থেকেই বোঝা যায় বাংলা ভাষার প্রতি ত্রিপুরার রাজাদের কতটা মমত্ববোধ ছিল।স্বাভাবিকভাবেই রাজকার্যে তার প্রভাব পড়েছিল। কর্ণেল ঠাকুর মহিম চন্দ্র দেববর্মা একসময় মহারাজ বীরচন্দ্রের এডিকং ছিলেন। একবার কলকাতায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্ণেল মহিম ঠাকুরের গলায় ঝোলানো স্বর্ণ মোহরে বাংলা অক্ষর দেখে পুলকিত হয়ে সহর্ষে উপস্থিত সবাইকে বলেছিলেন-“ইহাতে যে বাংলা ভাষা ছাপা।তবে আমার বাংলা রাজভাষা!”
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭০: সুন্দরবনের পাখি: লাল কাঁক

যাইহোক, রাধাকিশোরের আমলে অবশ্য সরকারি বাংলা আগের তুলনায় আরও উন্নত রূপ পরিগ্রহ করেছিল। রাজ সংসারের ব্যয় সংকোচ সম্পর্কে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে জারি করা একটি স্মারকলিপির কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে— “সংসার বিভাগের হিসাবাদি কাগজাত পর্য্যালোচনায় দৃষ্ট হইতেছে যে,রাজ্যের আয়ের তুলনায় সংসার বিভাগের ব্যয় নিতান্ত অধিক হইয়া দাঁড়াইয়াছে।আয় ব্যয়ের সামঞ্জস্য রাখার এবং রাজ্যের ও রাজধানীর আবশ্যকীয় উন্নতিকার্য্যের জন্য সংসার বিভাগে যে সমস্ত অতিরিক্ত ও অনাবশ্যকীয় ব্যয় আছে,তাহা রহিত করিয়া ১৩০৭ ত্রিং সনের বাজেট প্রস্তুত করা কর্ত্তব্য।”…
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৪: অরাজকতার ফল ও একটি দুঃস্বপ্ন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

এটা ঘটনা যে,রাজাদের আন্তরিক আগ্রহ ও নিষ্ঠা সত্ত্বেও ত্রিপুরার রাজপ্রশাসনে পরবর্তীকালে ইংরেজির বেগবান প্রবাহ ঠেকানো যায়নি।অবশ্য এক্ষেত্রে ত্রিপুরা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমস্ত দেশীয় রাজ্য সমূহে তখন ইংরেজির নিরবচ্ছিন্ন আধিপত্য। ইংরেজ শাসকদের প্রতিনিধিরা ছড়িয়ে পড়েছে ভারতবর্ষের সর্বত্র। নব্য সৃষ্ট দেশীয় কেরানিবাবু সম্প্রদায়ের অত্যুৎসাহে স্বাভাবিক ভাবেই সরকারি কাগজপত্রে ইংরেজির ব্যবহার দিনকে দিন বাড়তে থাকে।কিন্তু এই অবস্থার মধ্যেও বিস্ময়কর হল ত্রিপুরার রাজাগণ রাজ প্রশাসনে ইংরেজির প্রভাব ঠেকাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। বাংলার মূল ভূখণ্ডের বাইরে বাংলা ভাষার এমন রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা এক বিরল ঘটনা।—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content