শনিবার ৯ নভেম্বর, ২০২৪


মহারাজা বীর বিক্রম।

ত্রিপুরার রাজা এবং রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যেও সাহিত্য চর্চার ধারা ছিল। সে যুগের একজন সুবিখ্যাত বৈষ্ণব কবি রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর পরবর্তী রাজা এবং রাজপরিবারের সদস্যরাও কাব্য চর্চা করেছেন। বীরচন্দ্রের পুত্র সমরেন্দ্র চন্দ্র যেমন ছিলেন সে যুগের এক জন বিখ্যাত গদ্য লেখক, তেমনই কন্যা অনঙ্গমোহিনী দেবী ছিলেন সুখ্যাত কবি। এমনকি রবীন্দ্রনাথও অনঙ্গমোহিনীর কাব্যের প্রশংসা করেছেন। মহারাজা রাধাকিশোরের পত্নী তুলসীবতী মুখে মুখে সংগীত রচনা করতে পারতেন।

বৈষ্ণবভক্ত কবি রাজা বীরচন্দ্রের ভক্তিভাব, রসবোধ, পদাবলি সাহিত্যের প্রভাব ইত্যাদি তাঁর ‘হোরি’ কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। রাধার রূপ বর্ণনায় কবি লিখেছেন—
শতকোটি চাঁদ জিনিয়া মুখমণ্ডল
ভাঙ তিমির ঘন ঘোর,
বিকশিত কিরণ শ্রুতি কুবলয় পরি
ধাবই নয়ন চকোর।
বীরচন্দ্র রাজ অন্তঃপুরে বৈষ্ণব উৎসবের প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি রানি সহ পরিবার পরিজনদের নিয়ে স্বরচিত ও স্বসুরারোপিত রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গান করতেন। পঞ্চাশটি কবিতা নিয়ে রাজার ‘শ্রীশ্রী ঝুলন গীতি’ ১৮৯২ সালে প্রকাশিত হয়। এর গীতি সমূহে সংস্কৃত ভাষার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। রাধার রূপ বর্ণনায় কবি বলছেন—
দেখরে, যৈছে শ্যাম ঐছে প্রিয় সোহাগিনীরে, দেখ দেখরে
মৃদু হাস্য সুধামায় চন্দ্রমুখং।
মধুরাধর সুন্দর পদ্মমুখীং
কি দিয়া তুলিব দোঁহে, তুলনা নাই জগতে, দেখ দেখরে।


প্রিয়তমা মহিষী ভানুমতী দেবীর মৃত্যুর পর রাজা তাঁর শোকভার লাঘবে রচনা করেন ‘প্রেম মরীচিকা’। ১৮৮৬ সালে এটি রচিত বলে মনে করা হয়। এতে মোট একুশটি কবিতা রয়েছে। প্রিয়তমা মহিষীর মৃত্যুতে কবির শোকোচ্ছ্বাস যেন ‘প্রম মরীচিকা’র ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। কবি লিখেছেন—
সে সুখের দিন
আসিবেরে কবে,
শোক তাপ সব ধুয়ে,মরণের সুখ
শীতল কোলেতে,
ঘুমাব মাথাটি থুয়ে।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২৬: শামসের ও কাব্য গাজিনামা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৮: নির্দোষ প্রাণীহত্যা কী সমর্থনযোগ্য?

বীরচন্দ্রের ‘সোহাগ’ কাব্যগ্ৰন্থে রয়েছে ২২টি কবিতা। কাব্যে পত্নীপ্রেমকে ঘিরে নানা ভাবে কবি হৃদয়ের উচ্ছ্বাস ধরা পড়েছে। যেমন—
কতবার হেরিয়াছি থাকি অন্তরালে
একাকী নির্জনে,
তোমার সহিত প্রিয়ে প্রাণের মিলনে,
সমান বয়সী মেলি,
করিতে সলিল কেলি,
তড়িত জড়িত হাসি ভাসিত বদনে,
হেরিতাম তৃষিত নয়নে।


মহারাজা বীরচন্দ্র ছিলেন এক মরমী কবি। তাঁর কাব্যে ছত্রে ছত্রে রয়েছে পদাবলির প্রভাব। সমালোচকগণ বলেছেন, তাঁর প্রায় প্রতিটি কাব্যে উচ্ছ্বাসের তুলনায় ভাবের গভীরতা লক্ষ্য করা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ত্রিপুরায় চর্চিত বাংলা সাহিত্য, বিশেষত কাব্য সাহিত্য সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা দেয় বৈষ্ণবভক্ত কবিরাজা বীরচন্দ্রের কাব্য সমূহ।

বীরচন্দ্রের পুত্র রাধাকিশোরও একজন কাব্য রসিক ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক বেশ কিছু ভক্তিমূলক সংগীত রচনা করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের রূপ বর্ণনায় রাধাকিশোর লিখেছেন—
নীল নবাম্বুজ জিনি, — কালিয়া বরণখানি,
ইন্দ্রধনু জিনি শিরে চূড়া,
রাধা নাম লেখা তায়,—বামে হেলে মৃদুবায়,
দুসুতি মুকুতাদামে বেড়া।
ললাটে চন্দন চাঁদ,—রাধামন ধরা ফাঁদ,
কোটী শশী জিনিয়া বরণ,
জিনিয়া মদন ধনু,—ভুরুর ভঙ্গিমা জনু,
ইন্দিবর জিনিয়া নয়ান।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৪: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গিরা শাক ও যদু পালং

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬:কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক

রাধাকিশোরের অপ্রকাশিত কবিতা সমূহ পরবর্তী সময়ে ‘রবি’, ‘ফাল্গুনী’, ‘বসন্তরাস’ ইত্যাদি সাহিত্য পত্রে প্রকাশিত হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন রাধাকিশোরের কাব্যচর্চায় পিতা মহারাজ বীরচন্দ্রের প্রভাব পড়েছিল। রাধাকিশোরের পুত্র পরবর্তী রাজা বীরেন্দ্র কিশোরও রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক বেশ কিছু সংগীত রচনা করেছিলেন। তবে দুর্ভাগ্য, তাঁর রচনা সমূহ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। রাধাকৃষ্ণের ঝুলন বর্ণনায় তিনি লিখেছেন—
বৃন্দাবিপিন বনে কুঞ্জে,
বিহারে হরি হয়ে বসন্ত।
কোথায় ময়ূরী ধায়,
কোকিল পঞ্চমে গায়,
ভ্রমরা গুঞ্জরে অবিশ্রান্ত।
নানা জাতে ফুঁটে ফুল,
সুগন্ধে করে আকুল
সকলে হইল মধুমত্ত।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৮: যেথা আমি যাই নাকো / তুমি প্রকাশিত থাকো

সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক পরবর্তী রাজা বীরবিক্রমও হোলি বিষয়ক সংগীত গ্ৰন্থ রচনা করেছিলেন। রাজ আমলে ত্রিপুরায় হোলি ছিল অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব। এই উৎসবে রাজ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। ১৯৪১ সালে বীরবিক্রমের হোলি বিষয়ক সংগীত গ্ৰন্থ ‘হোলি’ প্রকাশিত হয়। কিন্তু গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ফাগুয়া সংঘের নামে। এ সম্পর্কে মহারাজার ব্যক্তিগত সচিব দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র দত্ত লিখেছেন— ”হোলি গ্রন্থটি বাহির হইল ১৯৪১ সালে। লেখক ছদ্মনামে লিখিত হইয়া ফাগুয়া সংঘ কর্তৃক প্রকাশিত হইল।আগের বছর হইতেই মহারাজ বীরবিক্রম এই বইয়ের জন্য ডায়েরিতে গান লিখিয়া রাখিতেছেন।…” বীরবিক্রমের লেখা একটি হোলি গানের কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে—
…এমন সুন্দর হোলির দিনে,
রসিক নাগর শ্যাম বিনে,
খেলিব ফাগ কাহার সনে,
আমার খেলাত হল না খেলা।


রাজা সাহিত্য সংস্কৃতির অকৃপণ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।তাঁর রাজত্বকালে অনেক গুণী শিল্পী আগরতলায় রাজদরবারে এসেছেন। কিন্তু রাজা ছিলেন প্রচার বিমুখ। তাঁর সাহিত্য-সংস্কৃতির তৎপরতা প্রাসাদ আঙিনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। রাজার লেখা গানগুলোর রসাস্বাদন করে পরবর্তীকালের সঙ্গীত রসিকরা অবাক হয়ে গিয়েছেন গীতিকার হিসেবে বীরবিক্রমের প্রতিভা দেখে। তিনি ব্রজবুলিতে হোলির গান লিখেছেন—
আজু হেরি এ নব প্রেম চমক আওয়ে।
গোপ নারী সঙ্গ হোরী খেলন যাওয়ে।।
পর নারী সঙ্গ প্রেমসে করত রঙ্গ,
রসে রসিক নাগর কো সরমন আওয়ে।।
কুলমান তনধন সব লেওয়েছিন
মুরলী ফুকারে শ্যাম সেনহ লগায়ে।।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

দশভুজা, পর্ব-৩৬: মৃণালিনী— রবি ঠাকুরের স্ত্রী-র লেখকসত্তা

কাব্য ও সঙ্গীত রচনার পাশাপাশি গদ্য রচনায়ও মহারাজ বীরবিক্রম ছিলেন সিদ্ধহস্ত। হোলি উৎসবের প্রাচীনত্ব ও উৎস নিয়ে তিনি ‘হোলি’ গ্রন্থের অবতরণিকা অংশে পাণ্ডিত্য পূর্ণ আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন—”যখন দারুণ শীত অবসানে নীরস পল্লববিহীন তরু আবার সরস নবপল্লবে নবীন হইয়া উঠে, যখন কাননে বাগানে ফুল আবার জগতকে সুশোভিত এবং সুবাসে আমোদিত করিয়া তোলে, যখন আবার কোকিল পঞ্চমে গান গায়, যখন আবার পবন মন্দ গতিতে বহিতে থাকে—যে পবন শত কুসুম-হৃদয়-বিদারিত সুগন্ধ নিজ বক্ষে বহন করে এবং যেন প্রেমিকার দেহে মৃদু আঘাতে দেশান্তরে অবস্হিত প্রেমিকের বারতা প্রেমিকার কাছে আনে ও নিদারুণ বিরহবেদনা আবার বিরহীর প্রাণে আনয়ন করে তবুও হয়ত অনেকে বিরহ অন্তে প্রিয়ার সঙ্গে মিলনের আশা রাখে বসন্তে-সেই মধু ঋতুতে, ফাগুনের চন্দ্রমাস অবসানে বিকলাঙ্গ চন্দ্র যখন পূর্ণ চন্দ্রে পরিণত হয়—সেই দোল পূর্ণিমাতে হোলী।”

এই কয়েকটি লাইন সম্পর্কে মহারাজা বীরবিক্রমের গদ্য সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়। এছাড়াও রাজার সোনামুড়া এবং উদয়পুর ভ্রমণের বিবরণীতে রয়েছে তাঁর গদ্যের নিদর্শন। ‘আমার সোনামুড়া ও উদয়পুর বিভাগ পরিভ্রমণ’ নামে রাজার ডায়েরী গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। রাজা লিখছেন—”…আজ সকাল ৯টায় গোবিন্দ মাণিক্যের রাজবাড়ি দেখিতে যাই। রাজবাড়িটি একটি উচ্চ পাহাড়ে অবস্হিত, ইহার পশ্চিম দিকে গোমতী প্রবাহিত এবং অন্যদিকে খাল। ইচ্ছা করলেই গোমতীর জলে খালটি পূর্ণ করা যায়। অতএব এই রাজবাড়িতে শত্রু প্রবেশ করিতে সহজে পারেনা।…” —চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content