শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

ত্রিপুরাতে বিজেপি’র তেমন কোনও সাংগঠনিক শক্তি কিংবা তৎপরতা আগে ছিল না। তবে অনেক আগে থেকেই অবশ্য রাজ্যে, বিশেষত রাজ্যের জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় আরএসএস’র তৎপরতা ছিল। এমনকি ত্রিপুরায় জনজাতিদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে আরএসএস কর্মীরা সন্ত্রাসবাদীদের রোষের মুখেও পড়েছেন, হয়েছেন হিংসার শিকার। যাইহোক, ২০১৪ সালে দেশে বিজেপি’র নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট সরকার আসার পর ত্রিপুরার রাজনৈতিক চিত্রটাও ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করে। ত্রিপুরাতে বিজেপি’র রাজনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

ত্রিপুরাতে তখন চলছে বামফ্রন্টের শাসন। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। দেশের অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ভাবমূর্তিতে সর্বাধিক উজ্জ্বল ত্রিপুরার মানিকবাবু। একদিকে রাজ্যে সিপিএম’র সাংগঠনিক শক্তি এবং অপরদিকে মানিকবাবুর মতো মুখ্যমন্ত্রী, কার্যত ত্রিপুরায় বিরোধীদল অর্থাৎ কংগ্রেসের পক্ষে যেন তখন কোনও সুযোগই ছিল না। এ ছাড়া কংগ্রেসের মধ্যেও ছিল তখন ভাঙ্গনের খেলা। ২০১৩ সালের রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে বামফ্রন্ট পেয়েছিল ৫০টি আসন এবং বিরোধীদল কংগ্রেস জয়লাভ করেছিল ১০টি আসনে। কিন্তু বেশ কিছুদিন পর সুদীপ রায় বর্মণের নেতৃত্বে কংগ্রেসের ৭ জন বিধায়ক কংগ্রেস ত্যাগ করে তৃণমূলের খাতায় নাম লেখান।
পশ্চিমবঙ্গে তখন তৃণমূল কংগ্রেস দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে। সব মিলিয়ে ত্রিপুরায় বিরোধী রাজনীতি খুবই দুর্বল অবস্থানে তখন। কেন্দ্রে বিজেপি আসার পর রাজ্যে গতি পায় বিজেপি’র তৎপরতাও। রাজ্যে বিরোধী দলের মধ্যে তখন কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি এবং জনজাতি ভিত্তিক আঞ্চলিক দল আইপিএফটি। স্বাভাবিক ভাবেই বিরোধী শক্তির এই বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে বামেদের যাত্রাপথ ছিল নিষ্কণ্টক। তাদের সামনে কোনও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছিল না। কিন্তু রাজনীতিতে চিরস্হায়ী বলে কিছু হতে পারে না। নিঃসন্দেহে ত্রিপুরাও তার ব্যতিক্রম নয়। ২০১৬ সালে দিল্লি থেকে ত্রিপুরার প্রদশ বিজেপি’র সভাপতি হয়ে আসেন বিপ্লব দেব। বিপ্লববাবু মূলত ত্রিপুরারই বাসিন্দা। দেড় দশক যাবৎ দিল্লিবাসী ছিলেন তিনি। বিজেপি’র কার্যকর্তা হিসেবে তিনি দলের শীর্ষস্তরেরও আস্হাভাজন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১৮: জঙ্গির গুলিতে মন্ত্রীর মৃত্যু

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭০: পিতার সমালোচক রাম শুধুই মানুষ, তবু তিনি কেন পুরুষোত্তম?

বিপ্লববাবু ত্রিপুরায় এসে দলের সাংগঠনিক কাজকর্ম শুরুর পর বিজেপি’র তৎপরতা এক ভিন্ন মাত্রা পায়। রাজ্যের জনজাতি অধ্যুষিত এলাকা সহ সর্বত্র তিনি দলীয় সংগঠন বিস্তারে উদ্যোগী হন। কংগ্রেসের যেসব বিধায়ক তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন তিনি তাদেরকে বিজেপি’তে নিতে সচেষ্ট হন। শেষপর্যন্ত ২০১৭ সালের আগষ্ট মাসে তৃণমূল কংগ্রেসে যাওয়া কংগ্রেসের বিধায়করা বিজেপি’তে যোগ দেন। এতে ত্রিপুরাতে বিজেপি যে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজ্যে অনুষ্ঠিত একাধিক উপনির্বাচনেও বিজেপি’র অগ্রগতি চোখে পড়ে। উপনির্বাচনের ফলাফলে কংগ্রেসকে অনেক ছাপিয়ে যায় বিজেপি। রাজ্যবাসীর মনে তখন এই ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে যে পরবর্তী বিধানসভার নির্বাচনে সিপিএম তথা বামেদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হবে বিজেপি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৫: প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন পরীক্ষায় পাশই করবেন না

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসাসা— নুনিয়া ও সিঙ্গরা

অনেকের মধ্যে এ রকম ধারণাও হতে থাকে যে,বিজেপি’র শীর্ষ স্তরের নেতৃত্বের উপযুক্ত সহায়তা পেলে ত্রিপুরাতে বামেদের পতনও ঘটে যেতে পারে। কংগ্রেস কর্মী সমর্থকদের এক বড় অংশ তখন দলে দলে বিজেপি’তে যোগ দিতে থাকেন। প্রদেশ বিজেপি’র সভাপতি বিপ্লববাবু জনজাতি ভিত্তিক আঞ্চলিক দল আইপিএফটি’র সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। রাজ্যের পাহাড়ি এলাকায় আইপিএফটি নানা ইস্যুতে আন্দোলন শুরু করে। সমতলে বামেদের বিরুদ্ধে বর্শামুখ তাক করে বিজেপি। সব মিলিয়ে ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে প্রবল বিরোধী শক্তি হিসেবে বিজেপি উঠে আসছে তা ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকে।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৩: জোর কা ঝটকা

বিধানসভা নির্বাচন ঘোষণার পর রাজ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা তুঙ্গে উঠে।বিজেপি’র সঙ্গে আইপিএফটি’র জোট হয়।যুবকদের কর্মসংস্থান,কর্মচারীদের জন্য ৭ম পে কমিশন রূপায়ণ, জনজাতিদের জীবনমান উন্নয়ন ইত্যাদি প্রতিশ্রুতি দেয় বিজেপি জোট। রাজ্যে তুঙ্গে উঠে নির্বাচনী প্রচার। প্রধানমন্ত্রী ,স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-সহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা প্রচারে ত্রিপুরাতে আসেন। নির্বাচনী প্রচার পর্বে বিজেপি’র সভা সমিতিতে মানুষের ঢল নামে। এ রকম ধারণাও মানুষের মধ্যে প্রকট হতে থাকে যে, এবার হয়তো বাম শাসনের অবসান হতে পারে। একটানা পঁচিশ বছরের বাম শাসনের পর পরিবর্তনের একটা সম্ভাবনা এমনিতেই ছিল। কারণ প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার একটা প্রবাহ অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো আগে থেকেই ছিল ত্রিপুরায়। তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল বিজেপি’র তৎপরতা, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের যথাসম্ভব সহায়তা। সেই নির্বাচনে বামেদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। প্রবল উত্থান ঘটে বিজেপি-সহ তার জোট সঙ্গী আইপিএফটি’র। নির্বাচনে বিজেপি ৩৬টি এবং আইপিএফটি ৮টি আসন লাভ করে। সিপিএম লাভ করে মাত্র ১৬টি আসন।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১: ভাঙনের জয়গান গাও

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৩: মহীয়সী গৃহস্থনারী মা সারদা

বামেদের যে এতটা করুণ অবস্হা হবে তা বাম বিরোধীরাও অনুমান করতে পারেননি। আগরতলার বনমালীপুর কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রদেশ সভাপতি বিপ্লব দেব ৯,৫৪৯ ভোটের ব্যবধানে কংগ্রেস প্রার্থী গোপাল রায়কে পরাজিত করেন। উল্লেখ করা যায় যে, এর আগের বিধানসভা নির্বাচন অর্থাৎ ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিজেপি’র কোনও আসন লাভ ঘটেনি। তাই ২০১৮ সালে বিজেপি’র ৩৬ টি আসন লাভকে তাদের জন্য নিঃসন্দেহে এক চমকপ্রদ বিজয় বলে অভিহিত করা যায়। সিপিএম অবশ্য এর পিছনে বিজেপি’র অবাস্তব প্রতিশ্রুতি, অর্থ সহ কেন্দ্রীয় ক্ষমতার ব্যবহারকে দায়ী করেছে।

২০১৮ সালের ৯ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিপ্লব দেব শপথ গ্রহণ করেন। আগরতলায় এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ-সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারও উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ করা তায় যে, শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য বিপ্লববাবু সিপিএম-র রাজ্য সদর দপ্তরে গিয়ে মানিক সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে এসেছিলেন। শপথ গ্রহণের পর মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দীর্ঘ সময় শাসন ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও বামফ্রন্ট রাজ্যের সহায় সম্পদকে কাজে লাগিয়ে এর উন্নয়ন করেনি। তাঁর সরকার রাজ্যের যথাসাধ্য উন্নয়ন করবে।—চলবে।

* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content