শনিবার ২০ জুলাই, ২০২৪


উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ। ছবি: সংগৃহীত।

১৯৮০ সাল। কিছুদিনের মধ্যেই ত্রিপুরার ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। ধীরে ধীরে রাজ্যে স্বাভাবিক অবস্থাও ফিরে আসে। তবে হিংসার আগুন স্তিমিত হয়ে এলেও বড় কাজটা ছিল দাঙ্গা দুর্গতদের ত্রাণ পুনর্বাসন। আর তার থেকেও বড় এবং খুবই কঠিন কাজ ছিল ত্রিপুরার দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক আস্হার ভাব ফিরিয়ে আনা। জীবন ও সম্পদহানির তুলনায়ও দাঙ্গায় সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়েছিল ত্রিপুরার জাতি উপজাতি মানুষের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস বোধের সৃষ্টি। যাইহোক, দাঙ্গার আগুন স্তিমিত হওয়ার পর বামফ্রন্ট সভা সমিতির মাধ্যমে শান্তি সম্প্রীতির আহ্বান জানাতে থাকে। বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক তৎপরতাও শুরু হয়। এই সব কর্মসূচিতে জাতি উপজাতি উভয় অংশের মানুষ একই সঙ্গে অংশ নিতে থাকেন। শুরু হয় উন্নয়ন কাজও। এ ভাবে এক কালো অধ্যায় পিছনে ফেলে এগোতে থাকে ত্রিপুরা।
কিন্তু সেদিন ত্রিপুরার ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় ক্ষয়ক্ষতিটা কেমন হয়েছিল? সরকারি তথ্যেই বলা হয়েছে, জুন মাসের দাঙ্গায় ১১০০ জন জাতি-উপজাতি মানুষ খুন হয়েছেন। তিন লাখের বেশি মানুষ ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। ৩৫ হাজারের বেশি মানুষের ঘরবাড়ি পুড়েছে, লুঠ হয়েছে ৩০ হাজার মানুষের বাড়ি ঘর। এই তথ্য থেকেই ত্রিপুরার মতো ছোট্ট একটি রাজ্যে সেদিনের ভয়াবহতা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না।

প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী রাজ্যের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্পর্কে বলেছিলেন—”…প্রতিটি এলাকার হাজার হাজার জাতি-উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তি ও সম্প্রীতির স্বপক্ষে সমবেত হয়েছেন বলেই এই অভাবনীয় কাজ সম্ভব হয়েছে। দীর্ঘ এক বছর ধরে আসাম আন্দোলন, মিজো উগ্রপন্হীদের দ্বারা মাঝে মাঝে মিজোরাম সীমান্তে আক্রমণের ফলে সৃষ্ট উত্তেজনা এবং বিলোনীয়া চর এলাকা নিয়ে ৯০০ কিলোমিটার ব্যাপী বাংলাদেশ সীমান্তের অস্হিরতা সত্বেও বর্তমান অবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।…”
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১৪: ত্রিপুরায় ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯১: এক আলমারি বই : রাণুর বিয়েতে কবির উপহার

যাইহোক, প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে ছিল প্রথম গোপন ব্যালটের মাধ্যমে গাঁওসভার নির্বাচন, উপজাতিদের রক্ষাচবচ হিসেবে উপজাতি স্বশাসিত জেলা পরিষদ গঠন, রাজ্যে বার্দ্ধক্য ভাতা চালু, ভূমিহীনদের পুনর্বাসন, কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ইত্যাদি।

১৯৮৩ সালের বিধানসভার নির্বাচনেও রাজ্যে দ্বিতীয়বারের মতো বামফ্রন্ট ক্ষমতায় ফিরে আসে। তবে সেবার বামফ্রন্টের আসন সংখ্যা কমে হয় ৪০। আগেকার বিধানসভার ভোটে তা ছিল ৫৬। ১৯৮৩ সালে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা হয় ১২। উল্লেখ্য, আগেকার ভোটে কংগ্রেসের কেউ জয়ী হতে পারেননি। ১৯৮৩ সালের ভোটে উপজাতি যুব সমিতি পেয়েছিল ৬টি এবং নির্দল ২টি আসন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৫: বসু পরিবার-এ উত্তমকুমার দিনভর একটি শব্দই রিহার্সাল করেছিলেন, কোনটি?

দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে ত্রিপুরায় সন্ত্রাসবাদীদের তৎপরতা ব্যাপক ভাবে শুরু হয়। ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার কিছুদিন পরই উপজাতি যুব সমিতির একটা উগ্রবাদী অংশ দল ছেড়ে গঠন করে ত্রিপুরা ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স অর্থাৎ টিএনভি নামে একটি সংগঠন। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অরণ্যে শিবির করে টিএনভি ত্রিপুরায় সশস্ত্র জঙ্গি তৎপরতা চালাতে থাকে। বিজয় রাঙ্খলের নেতৃত্বাধীন টিএনভি’র মূল লক্ষ্য ছিল ত্রিপুরাকে বাঙালিদের শাসনমুক্ত একটি স্বাধীন রাজ্য অর্থাৎ স্বাধীন ত্রিপুরা গঠন। ত্রিপুরার সবুজ অরণ্যে গর্জে উঠল বন্দুকের নল। বহু নিরীহ বাঙালি এবং কিছু উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষও প্রাণ হারালেন টিএনভি’র হামলায়। মাঝে মাঝে নিরাপত্তা বাহিনী টিএনভি’র টার্গেট হলেও সাধারণ মানুষই যেন বেশি করে তাদের লক্ষ্য হলেন। প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালেই মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী বিজয় রাঙ্খলের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে টিএনভি’র জঙ্গি তৎপরতা অবসান সহ সংশ্লিষ্ট সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

যাইহোক, দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের প্রধান সমস্যা হয়ে উঠল জঙ্গি তৎপরতা। কখনও সড়কে যাত্রীবাহী বাসে হামলা, কখনও পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ, আবার কখনও গ্রাম পাহাড়ের নিরীহ মানুষকে হত্যা ইত্যাদি ঘটনা প্রবাহে বামফ্রন্ট সরকার ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান এবং উগ্রবাদীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য মুখ্যমন্ত্রী নৃপেনবাবু বারবার চেষ্টা করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি।জঙ্গি তৎপরতায় সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি প্রচণ্ড ভাবে ব্যাহত হতে থাকে। আর এ সব কারণে সরকারের বিরুদ্ধে রাজ্যের সাধারণ মানুষের ক্ষোভও বাড়তে থাকে। এদিকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের মধ্যেও শুরু হয়ে যায় ভাঙা গড়ার খেলা। এক সময় টিএনভি থেকে একটি গোষ্ঠী বের হয়ে গঠন করে অল ত্রিপুরা পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশন অর্থাৎ এটিপিএলও। নব গঠিত এই জঙ্গি সংগঠন কিছুদিন সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা চালাবার পর রাজ্য সরকারের সঙ্গে গোপন আলাপ আলোচনার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৬: কুসুমকুমারী দাশ—লক্ষ্মী সরস্বতীর যুগ্ম মূর্তি

১৯৮৪ সালে ত্রিপুরার উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ৬ষ্ঠ তপশিলের আওতায় জেলা পরিষদকে আনা। ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদের নির্বাচনে বামফ্রন্ট জয়লাভ করে পরিষদের ক্ষমতা দখল করে। দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকার তার কার্যকালে নানা ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। সন্ত্রাসবাদীদের তৎপরতা এবং জাতি-উপজাতি সম্প্রীতি সুরক্ষা করা ছিল এক বড় সমস্যা। সে সময়ে রাজ্যে কংগ্রেস ও উপজাতি যুব সমিতি জোটের সঙ্গে সিপিএমের রাজনৈতিক সংঘাতও তীব্র আকার ধারণ করে। জঙ্গি তৎপরতার পাশাপাশি সাধারণ আইনশৃঙ্খলা মোকাবিলায়ও ব্যস্ত থাকতে হয় সরকারকে। দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুম সীমান্ত দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে হাজার হাজার চাকমা উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ ত্রিপুরায় প্রবেশ করে। বিভিন্ন ত্রাণ শিবিরে তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়। এই চাকমা উদ্বাস্তু সমস্যার মোকাবেলা-সহ তাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টিও ছিল সরকারের একটা বড় কাজ।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫২: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— গর্জন, ভোলা ও নোনা ঝাউ

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৬: বিগ্রহে রামের প্রাণপ্রতিষ্ঠা, আদিকবির নবীন নায়ক রামের মানবিক মুখ

এ রকম নানা ডামাডোলের মধ্যেই একদিন এগিয়ে আসে পরবর্তী অর্থাৎ ১৯৮৮ সালের বিধানসভার নির্বাচন। নির্বাচনের আগে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি, রাজনৈতিক সংঘাত ইত্যাদিতে রাজ্যের পরিস্হিতি খুবই উত্তপ্ত হয়ে উঠে। দিল্লি থেকে ত্রিপুরার কংগ্রেসের অভিভাবকের দায়িত্ব দিয়ে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষ মোহন দেবকে পাঠানো হয় আগরতলায়। সন্তোষবাবুর উপস্থিতিতে রাজ্য কংগ্রেসের বিবদমান গোষ্ঠীগুলো উজ্জীবিত হয়ে উঠে, দৃশ্যত ঐক্যবদ্ধ বলেও মনে হয়। নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠীবাজী থাকলেও সবাই সন্তোষবাবুর অনুগত এবং শাসক বামফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সবাই যেন ঐক্যবদ্ধ। নির্বাচনে বামফ্রন্টকে পর্যুদস্ত করতে কংগ্রেস, উপজাতি যুব সমিতির জোট গঠিত হয়।শাসক এবং বিরোধী দুই শিবিরই জোরদার প্রচারাভিযান শুরু করে নির্বাচনের লক্ষ্যে। —চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content