প্রফুল্লকুমার দাস ও রাধিকারঞ্জন গুপ্ত।
১৯৭৭ সালের লোকসভার নির্বাচনে কংগ্রেসের শোচনীয় পরাজয় রাজ্যে রাজ্যে নতুন সমীকরণের সম্ভাবনা উস্কে দেয়। ত্রিপুরাতেও এর প্রভাব পড়ে। ত্রিপুরার বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসী বিধায়করা সিএফডি-তে যোগ দিলে রাজ্যে সুখময়বাবুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের পতন ঘটে। সিএফডি এবং সিপিএম মিলে তখন এক কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। মুখ্যমন্ত্রী হন সিএফডি’র প্রফুল্ল দাস। এ ভাবেই কোয়ালিশন সরকার গঠনের মাধ্যমে সিপিএম প্রথম ত্রিপুরার শাসন ক্ষমতার শরিক হল। রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, কোয়ালিশন সরকারে যোগ দিয়ে ক্ষমতার ভাগাভাগিকে সিপিএম এক কৌশল হিসেবেই নিয়েছিল। বিপরীত মেরুর মতাবলম্বীদের নিয়ে এই সরকার যে টিকতে পারে না এটা তাদের অজানা থাকার কথা নয়। আসলে এক সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়েই সিপিএম অগ্রসর হচ্ছিল।
কোয়ালিশন সরকার গঠনের কিছুদিনের মধ্যেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনুমান সঠিক বলে মনে হয়েছিল। সিএফডি-সিপিএম মধুচন্দ্রিমা দীর্ঘস্হায়ী হয়নি। আবার দিল্লিতে জনতা পার্টিতে সিএফডি মিশে যাওয়ায় ত্রিপুরাতেও এর প্রভাব পড়ে। ত্রিপুরার অধিকাংশ সিএফডি বিধায়ক, যাদের সবাই মূলত কংগ্রেস থেকে আসা, এ বার যোগ দিলেন জনতা পার্টিতে। ত্রিপুরার প্রথম কোয়ালিশন সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে উঠল। পদত্যাগ করলেন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল দাস। অবশ্য আগেই জনতা পার্টি এবং সিপিএম মিলে দ্বিতীয় কোয়ালিশন সরকার গঠনের তৎপরতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। জনতা পার্টির রাধিকারঞ্জন গুপ্তের নেতৃত্বে শপথ নেয় দ্বিতীয় কোয়ালিশন সরকার। স্বাভাবিক ভাবেই অল্প সময়ের মধ্যে দুটি কোয়ালিশন সরকারের জন্ম সাধারণ মানুষের বিরক্তি উদ্রেক করল।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৯: বাইনাচ-গানেরও কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গরিয়া, গোলপাতা ও হেতাল
মানুষ এটাও দেখল যে, দলাদলি যা হচ্ছে সবটাই পূর্বতন কংগ্রেস বিধায়কদের মধ্যে। সিপিএম বিধায়কদের মধ্যে তো কোনও গোষ্ঠীবাজী নেই! তাদের অবস্থান ঠিকই আছে। কিন্তু কংগ্রেস ভেঙে সিএফডি হচ্ছে, সিএফডি ভেঙে জনতা হচ্ছে। স্হায়ীত্বের প্রশ্নে ত্রিপুরার মানুষের মন তাই সিপিএম’র দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছিল। আর সিপিএম দলও এক সুদূর প্রসারী চিন্তা ভাবনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। সিপিএম সভা সমিতি সংগঠন আর নানা ইস্যুতে আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের জনভিত্তি সুদৃঢ় করার পথে অগ্রসর হয়েছিল। সেই তুলনায় জনতা পার্টির নেতাদের লক্ষ্য ছিল আশু লাভালাভ। রাজনৈতিক কর্মসূচির অভাবে জনতা পার্টি সম্পর্কে মানুষেরও মোহভঙ্গ ঘটে।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৪: অপরাজিতা রাধারাণী
কংগ্রেসের সে দিনের বিক্ষুব্ধ বিধায়করা যে শুধু ক্ষমতার জন্যই সুখময়বাবুর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার পতন ঘটিয়ে সিএফডি’র জামা গায়ে দিয়ে সিপিএম’র সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার করেছিলেন এবং ক্ষমতার জন্যই প্রথম কোয়ালিশন সরকারের পতন ঘটিয়ে আবার দ্বিতীয় কোয়ালিশন করেছেন এটা মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। দ্বিতীয় কোয়ালিশন সরকারের স্হায়ীত্ব নিয়েও মানুষের মনে সন্দেহ দেখা দেয়। সিপিএম যেন এই সুযোগটার অপেক্ষাতেই ছিল। দ্বিতীয় কোয়ালিশন সরকার থেকে সিপিএম সমর্থন তুলে নিলে সরকারের পতন ঘটে। রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়।
ত্রিপুরা বিধানসভা।
এরকম অবস্থায় নতুন করে মানুষের রায় নেওয়া ছাড়া বিকল্প কিছু ছিল না। যথারীতি রাষ্ট্রপতির শাসনাধীন অবস্থায় নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়। ভোটের মুখে আবার তুঙ্গে উঠে রাজনৈতিক তৎপরতা। সে সময় সব দিক থেকেই সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল সিপিএম। কংগ্রেসের তখন ছন্নছাড়া অবস্থা। কেন্দ্রে তারা ক্ষমতাচ্যুত। রাজ্যেও একই অবস্থা। কংগ্রেস ভেঙে আরও দুটি দল হয়েছে,সিএফডি ও জনতা। ভোট ভাগাভাগির অঙ্কে যে সিপিএম প্রভূত পরিমাণে লাভবান হবে এটা নির্বাচনী প্রচার পর্বেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৭: সারদা মা ও তাঁর রাধু
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৪: প্রজাদের আনন্দ, স্বস্তি, আশ্রয় রাম—তাঁর কাছে প্রজাদের আনুগত্যের স্থান কোথায়?
কংগ্রেস ছেড়ে আসা বিধায়কদের দলপাল্টানো নিয়ে নৃপেন চক্রবর্তী তাদেরকে ‘জামা পাল্টানো রাজনীতিক’ বলে অভিহিত করেছিলেন। প্রতিটি নির্বাচনী সভাতেই তিনি এদের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন। সারা দেশের মতো ত্রিপুরাতেও তখন এমনিতেই কংগ্রেসের জনপ্রিয়তায় ছিল ভাটার টান।এর মধ্যে আবার কংগ্রেস ভেঙে সিএফডি, জনতা পার্টি! ত্রিপুরার মানুষ তখন চাইছিলেন সরকারের স্হায়ীত্ব এবং ক্ষমতায় আসুক এমন কোনো রাজনৈতিক শক্তি যাদের মধ্যে দলাদলির আশঙ্কা কম।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৪: দুষ্টরা সুযোগ পেলেই যোগ্য ব্যক্তিকে সরিয়ে অধিকার কায়েম করে
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১২: ‘মিসা’ বন্দি সম্পাদকের চিঠি
নির্বাচনে সিপিএম তথা বামফ্রন্ট অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে।রাজ্য বিধানসভার ৬০টি আসনের মধ্য ৫৬টি আসন লাভ করে সিপিএম তথা বামফ্রন্ট। ৪টি আসন লাভ করে উপজাতি ভিত্তিক আঞ্চলিক দল উপজাতি যুব সমিতি। বামফ্রন্ট যে ত্রিপুরায় সরকার গড়তে চলেছে এটা ভোটের আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেস সহ অন্যেরা যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তেমনটা বোঝা যায়নি। জাতীয় দলগুলোকে ছাপিয়ে উপজাতি ভিত্তিক আঞ্চলিক দল যে ৪টি আসন পেয়ে যাবে বোঝা যায়নি সেটাও! যাইহোক, বিধানসভার ভোটে বামফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয় সারা দেশের মধ্যে ত্রিপুরাকে এক বিশেষ পরিচিতি এনে দেয়। কেরল ও পশ্চিমবঙ্গের পর যে রাজ্যে কম্যুনিস্টরা শাসন ক্ষমতায় এল তার নাম ত্রিপুরা।
শচীন্দ্রলাল সিংহ, সুখময় সেনগুপ্ত ও নৃপেন চক্রবর্তী।
এক উৎসবের আবহের মধ্যে ১৯৭৮ সালের ৫ জানুয়ারি নৃপেন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ত্রিপুরার প্রথম বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। ত্রিপুরাতে যারা দীর্ঘদিন ধরে বিরোধীদলের দায়িত্ব পালন করে আসছিল তারা এবার শাসক দল হিসেবে কি ভাবে কাজ করে, কতটা কাজ করে তার দিকে কৌতূহলের সঙ্গে মানুষ নজর রাখতে থাকেন। —চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।