বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিকে) সুলতান চাঁপা গাছ। (ডান দিকে) সুলতান চাঁপা ফুল। ছবি: সংগৃহীত।

 

সুলতান চাঁপা (Calophyllum inophyllum)

সুন্দরবনে সমুদ্র উপকূলে মাঝে মাঝে বিরাট আকারের এক সুদৃশ্য গাছ দেখা যায়। তবে গাছটিকে সুন্দরবন ছাড়াও অন্যত্র দেখেছি। এই গাছটি স্বাভাবিকভাবে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে জন্মায়। যেসব অঞ্চলে জোয়ারের জল পৌঁছয় সেখানে সর্বোচ্চ জলস্তরের উপরে এই গাছকে জন্মাতে দেখা যায়। আর এপ্রিল থেকে জুন বা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সাদা রঙের ফুলে গাছ ভরে যায়। আর ফুলের কি দারুন সৌরভ। এই কারণেই অনেক সময় বাহারি গাছ হিসেবে রাস্তার দুপাশে এই গাছ রোপন করা হয়। বাংলাতে এই গাছের নাম সুলতান চাপা বা পুন্নাগ। নির্ভেজাল ম্যানগ্রোভ নয়, এটি হল একপ্রকার ম্যানগ্রোভ সহযোগী উদ্ভিদ।

সুলতান চাপা গাছ ২৬ থেকে ৯৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে তবে এই গাছের শাখা-প্রশাখার সংখ্যা হয় কম আর এর বৃদ্ধিও খুব মন্থর। গাছের গুড়ি কিন্তু হয় খুব মোটা। কালো ও পুরু বাকলের ওপরে ফাটল দেখা যায়।

পাতাগুলো উপবৃত্তাকার এবং চকচকে সবুজ রঙের। উপরের দিকে পাতার সংখ্যা হয় অপেক্ষাকৃত বেশি। সুলতান চাপা গাছে প্রায় সারা বছর ধরে ফুল ফোটে সাদা রঙের ফুলের মাঝে হলুদ রঙের একগুচ্ছ পুংকেশর ফুলের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ফুলগুলো থোকা হয়ে ফোটে। এক একটা পুষ্প মঞ্জুরিতে চার থেকে ১৫ টি ফুল ফোটে। ফুলের সুগন্ধ বাতাসে ভেসে অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় সারা বছর ফুল ফোটে বলে এই গাছে সারা বছর মধু লোভী মৌমাছি ও নানা কীটপতঙ্গের আনাগোনা থাকে। কাঁচা অবস্থায় ফলগুলোর রং হয় সবুজ আর আকার হয় গোল। গুলোর ব্যাস হয় দুই থেকে চার সেন্টিমিটার আর প্রতিটি ফলের ভেতরে থাকে একটি বড় বীজ। পাকা ফল গাছ থেকে খসে পড়ে জলস্রোতের মাধ্যমে দূরবর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে আবার বাদুড়ের মাধ্যমেও এই ফলের বীজ স্থানান্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৭: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে/২

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— দুধি লতা ও পঞ্চরতি লতা

অপরিণত সুলতানচাঁপা ফলের শাঁস খাদ্যযোগ্য হলেও পরিণত ফলে বিষাক্ত উপাদান থাকে। ফলে পরিণত ফল মানুষের ভক্ষযোগ্য নয়। তবে এর বীজ থেকে তেল নিষ্কাশন করা যায়। পরিশুদ্ধ করার পর এই তেল ভক্ষণ যোগ্য হয় বলে জানা গেছে। গাছের গুড়ি খুব বড় মোটা ও শক্তপোক্ত হওয়ায় নৌকো তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়। এছাড়া আসবাব তৈরি করতেও সুলতান চাঁপা গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়। সুলতান চাপা গাছে সর্বত্র হালকা হলুদ রঙের আঠা বা তরুক্ষীর নিঃসৃত হয়। পাকা ফল পোড়ালে যে ধোয়া হয় তা মশা তাড়ানোর কাজে উপযোগী।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৩: রাজনীতিতে উন্নতির জন্য নিন্দা বা প্রশংসা ব্যক্তিগত পরিসরে করাই শ্রেয়, সভায় নয়

 

লৌকিক চিকিৎসা

প্রাচীন সুন্দরবনের মানুষ এই গাছটিকে কোন লৌকিক চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করত কিনা তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। যদিও অন্যান্য দেশে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই গাছটির বিভিন্ন অংশ নানা চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এমনই কিছু ব্যবহার প্রাচীন সুন্দরবন অঞ্চলেও প্রচলিত থাকার সম্ভাবনা বেশি। যেমন মূলের নির্যাস ফোঁড়া ঘা বা চোখের অসুখে ব্যবহার করা হয়। বাতের বা অন্ডকোষের যন্ত্রণায় বা যক্ষা রোগে সুলতান চাপা গাছের আঠা যন্ত্রণাস্থানে লাগিয়ে দিলে যন্ত্রণা উপশম হয়। আবার ক্ষতস্থানে আঠার সঙ্গে বাকল চূর্ণ মিশিয়ে প্রয়োগ করলে ক্ষত সেরে যায়।

গনোরিয়া রোগের চিকিৎসাতেও আঠার সাথে বাকল চূর্ণ মিশিয়ে প্রয়োগ করার প্রচলন রয়েছে। মৌমাছি বোলতা ইত্যাদি পতঙ্গ ফুল ফোটালে যন্ত্রণারস্থানে এই গাছের আঠা লাগালে যন্ত্রণা কমে। এছাড়াও পাতাকে গরম করে কোন ক্ষতস্থান বা ত্বকের খোস পাচড়ার উপর রেখে বেঁধে দিলে উপকার হয়। এছাড়া পাতার নির্যাস পানীয় হিসেবে উদরাময়, অর্শ ইত্যাদি রোগে ব্যবহার করা হয়। বাতের যন্ত্রণায় সুলতান চাপা বীজের তেল মালিশ করলে ব্যথা কমে। তবে সুন্দরবন অঞ্চলে গাছটি খুবই বিরল হওয়ায় এইসব লৌকিক চিকিৎসা পদ্ধতি আজকাল দেখাই যায় না।

(বাঁদিকে) চাঁদি গাছ। (ডান দিকে) চাঁদি গাছের ফুল-সহ শাখা। ছবি: সংগৃহীত।

 

চাঁদি (Dalbergia spinosa)

সুন্দরবনের পশ্চিম অঞ্চলে বিশেষ করে সাগর, ঘোড়ামারা, নয়াচর, জম্বু, হেনরি, লোথিয়ান ইত্যাদি দ্বীপে এবং কাকদ্বীপ, নামখানা, পাথরপ্রতিমা ইত্যাদি অঞ্চলে জোয়ার-ভাঁটা খেলে এমন এলাকা থেকে দূরবর্তী স্থানেও কাঁটাযুক্ত একপ্রকার ঝোপ জাতীয় গাছ প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। শাখার গায়ে কাঁটা থাকায় এই গাছের নাম চুলিয়া কাঁটা বা অনন্তকাঁটা। তবে অনেকেই এই গাছটিকে চাঁদি নামে চেনেন। খাড়া প্রকৃতির বহুবর্ষজীবী এই গুল্মটি সাধারণত ৬ থেকে ১০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট হয়। তবে কোনও কোনও গাছ ১৮ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। আমার গ্রামের বাড়ির সামনে যে খালটিতে নিয়মিত জোয়ার-ভাঁটা খেলত সেই খালের পাড়ে যেখানে সেখানে এই চাঁদি বা চুলিয়া কাঁটা গাছের অনেক ঝোপ ছোটবেলা থেকেই দেখেছি।

আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৭: কথা কিছু কিছু

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: প্রতিমাদেবী— এক দুঃখবতীর কথা

চাঁদি গাছ হল চিরহরিৎ গুল্ম, তবে কখনও কখনও এতটাই লম্বা হয় যে তখন বৃক্ষ বলা চলে। প্রচুর শাখা-প্রশাখাযুক্ত এই গাছে যে প্রচুর শক্ত ও লম্বা কাঁটা থাকে তা আগেই বলেছি। শাখার প্রত্যেকটা পর্ব থেকে একটি, দুটি বা তিনটি কাঁটা সৃষ্টি হয়। চাঁদি গাছের পাতা যৌগিক প্রকৃতির। ৭ থেকে ১১ টি পত্রক মিলে একটি পাতা গঠিত হয়। পত্রকগুলো ডিম্বাকার আর বেশ শক্তপোক্ত। চাঁদি গাছের ফুলগুলো পাতার কক্ষ থেকে জন্মায়। সাদা রঙের ছোট ছোট ফুল ঠাসাঠাসি করে থেকে পুষ্পমঞ্জরী গঠন করে। এর ফল গুলো শুঁটি আকারের হয়। বাদামি রঙের চ্যাপ্টা শুঁটির মধ্যে একটি বীজ থাকে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

চাঁদি হলো ম্যানগ্রোভ সহযোগী উদ্ভিদ। এর লবণ সহ্য করার ক্ষমতা খুবই কম। যেসব জায়গায় জোয়ারের জল পৌঁছোয় না সেখানে চাঁদি গাছ প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। বন জুঁই ও হাবল গাছের সাথে চাঁদি গাছকে একসাথে জন্মাতে দেখা যায়।

(বাঁদিকে) চাঁদি গাছের কাঁটা ও ফলসহ শাখা। (ডান দিকে) সুলতান চাঁপা ফল। ছবি: সংগৃহীত।

 

লৌকিক চিকিৎসা

সুন্দরবন অঞ্চলের কোথাও কোথাও চাঁদি গাছের মূল বেটে তৈরি করা ক্বাথ জ্বর, ব্যথা, মুত্রঘটিত সমস্যা ইত্যাদিতে ব্যবহার করার প্রচলন রয়েছে। কাণ্ডের বাকল থেকে তৈরি করা নির্যাস শরীরের যে স্থানে যন্ত্রণা হয় সেখানে প্রয়োগ করলে যন্ত্রণা নিরাময় হয়। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে যন্ত্রণার স্থান থেকে যে স্নায়ু মস্তিষ্কে যন্ত্রণার অনুভূতি পরিবহন করে সেই স্নায়ু সাময়িক উদ্দীপনা পরিবহন বন্ধ রাখে ফলে যন্ত্রণার অনুভূতি হয় না। তবে বর্তমানে চাঁদি গাছের ঔষধ হিসেবে লৌকিক ব্যবহার মানুষ ভুলতে বসেছে।—চলবে।

* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content