কালি লতা বা নোয়া লতা হল এক ধরনের ম্যানগ্রোভ সহযোগী উদ্ভিদ। গাছটি বহুবর্ষজীবী ও চিরহরিৎ। যেহেতু লতানে স্বভাব রয়েছে তাই কালি লতাকে কাষ্ঠল লতানে উদ্ভিদ বলা যায়। অবলম্বন পেলে এই গাছ ৬০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এই গাছের বাকল হয় সামান্য অমসৃণ এবং গাঢ় বাদামি রঙের। যৌগিক পাতার গঠনে বৈচিত্র্য দেখা যায়। চকচকে গাঢ় সবুজ রঙের প্রতি পাতায় ৭ থেকে ১৩ টি পত্রক রয়েছে, আর আগার দিকের পত্রকগুলো গোড়ার দিকের তুলনায় বড়।
আরও পড়ুন:
আগেই বলেছি, হালকা গোলাপি রঙের ফুলগুলো থোকা হয়ে ফোটে। কালি লতা গাছের আসল সৌন্দর্য এই পুষ্পমঞ্জরীতে। মধুলোভী মৌমাছিরা এই ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায়। এদের ফলের গঠনও বেশ ব্যতিক্রমী। চ্যাপ্টা শুঁটির মত ফলগুলোর আগা ও গোড়া দু’প্রান্ত অনেক চাপা, আর ফলের মধ্যে সাধারণত একটি বীজ থাকে। নদীর তীরে কালি লতা খুব একটা দেখা যায় না। স্থলভাগের দিকেই এদের প্রাচুর্য দেখা যায়। সুন্দরী, গেঁওয়া, ভোলা, চাঁদি, সিঙ্গরা ইত্যাদি গাছের সাথে কালি লতাকে জন্মাতে দেখা যায়। যেখানে মিষ্টি জল সহজলভ্য, জোয়ারের জলে প্লাবিত হয় না এবং বেশি পরিমাণে সূর্যালোক পাওয়া যায় সেখানে কালি লতা ভালো জন্মায়।
আরও পড়ুন:
কালি লতার কান্ড নমনীয় কিন্তু খুব শক্তপোক্ত হওয়ায় দড়ি বা কাছির বিকল্প হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে সুন্দরবনের মানুষ এই গাছটিকে ব্যবহার করে এসেছে। এই গাছের বাকল ও মূলের বিষক্রিয়ায় মাছ ভেসে ওঠে ও মারা যায়। তাই অনেক সময় পুকুরের জলে কালি লতার বাকল বা মূল ফেলে দিয়ে সহজে মাছ ধরা যায়। কালি লতায় থাকা রাসায়নিক রোটেনোন এই বিষক্রিয়ার জন্য দায়ী। তবে এই বিষে আক্রান্ত মাছ মানুষ খেলে কোনও সমস্যা হয় না। কীটপতঙ্গদের ক্ষেত্রে রোটেনোন ক্ষতিকর। তাই কীটনাশক হিসেবে এই গাছটির মূল বা বাকল চূর্ণ ব্যবহার করা যায়। প্রকৃতির পক্ষেও এই রাসায়নিক ক্ষতিকর নয়। জলে বা ডাঙ্গায় এর বিষক্রিয়া ছয় দিনের বেশি থাকে না। সূর্যালোকের প্রভাবে রোটেনোনের বিষক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায়। এদের বাকল থেকে নিম্নমানের তন্তুও পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন:
আরও পড়ুন:
পান লতার লবণ সহ্য করার ক্ষমতা মাঝারি ধরনের। তাই এরা মিষ্টি জলের কাছাকাছি যেমন জন্মাতে পারে তেমনই হালকা লবণাক্ত এলাকাতেও জন্মাতে পারে। সুন্দরবনের দ্বীপগুলিতে স্থলভাগের দিকে এদের বেশি দেখা যায়। নদীর চড়ায়, ঝোপে-ঝাড়ে এদের বেশি দেখা যায়। তবে উপকূলের কর্দমাক্ত এলাকায় নদী ও খাঁড়ির তীরে যেসব জায়গায় জোয়ারের জল পৌঁছায় সেখান থেকে ভাটার সীমা পর্যন্তও এদের দেখা যায়। কালি লতা, চাঁদি, ভোলা, গেঁওয়া, সিঙ্গরা ইত্যাদি গাছের সাথে পান লতাকে সহাবস্থান করতে দেখা যায়। কালি লতার মতো পান লতার কাণ্ড দৃঢ় হয় বলে দড়ি হিসেবে প্রাচীনকালে সুন্দরবনের মানুষ এই গাছ ব্যবহার করত। এই গাছের মূল ও বাকল বিষাক্ত হওয়ায় মাছ ধরার কাজেও এই গাছ একসময় ব্যবহৃত হত।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।।