সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


(বাঁদিকে) গোশিঙ্গা ফুল। (ডান দিকে) গোশিঙা ফল। ছবি: সংগৃহীত।

 

আমুর (Aglaia cucullata)

আমুর এই নামটা কবে প্রথম শুনি ঠিক মনে পড়ে না, কিন্তু প্রথম শোনার পর ভেবেছিলাম ভূগোলে পড়া আমুর নদীর কথা। চিন ও রাশিয়ার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত উত্তর-পূর্ব এশিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ নদী হল আমুর। আমুর গাছের নাম যখন শুনি ভেবেছিলাম এই নদীর অববাহিকায় অবস্থিত কোনও গাছ হবে। কিন্তু পরে জানলাম আমুর হল সুন্দরবন অঞ্চলের একটি অন্যতম ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ। যদিও প্রকৃত ম্যানগ্রোভের সব বৈশিষ্ট্য এই গাছে দেখা যায় না। তবে বহুদিন পর্যন্ত এই গাছটির সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হয়নি। কারণ সুন্দরবনের পশ্চিম দিকে এই গাছটি সম্ভবত বিলুপ্তপ্রায়। আমুর গাছের আরও একটা স্থানীয় নাম রয়েছে— লাটমি।

একদিন আমার এক ছাত্র অদ্ভুত দর্শন একটা ফল আমার হাতে দিয়ে বলল, “এটা কোন গাছের ফল চেনেন স্যার?” এই ফল আমি সত্যি আগে কখনও দেখিনি। তাল শাঁস ছাড়ালে যেমন দেখায় ঠিক তেমনই দেখতে হলুদ রঙের ফল। যেন দুটো কোয়া রয়েছে। আর ফলের ত্বক চামড়ার মতো। গুগলের সাহায্য নিলাম। পেয়েও গেলাম। পরে বইপত্র ঘেঁটে প্রায় নিশ্চিত হলাম যে, এটি হল আমুর গাছের ফল। ছাত্রটিকে বললাম গাছটির একটি শাখা নিয়ে আসতে। সে একটি শাখা পরে এনেও ছিল এবং তখনই ১০০ শতাংশ নিশ্চিত হলাম যে এটি আমুর গাছ।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৪: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— উকড়ি বেগুন, মধুফল ও নিশিন্দা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৮: আনন্দের নির্বাসন থেকে উত্তরণের উপায়?

আমুর গাছ বেশ বড় আকারের বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। প্রায়শই এরা ৫০ থেকে ৭০ ফুট লম্বা হয়। গাছের গুঁড়িও হয় বেশ মোটাসোটা ও লম্বা। গুঁড়ির গায়ে বাকলের উপর থেকে চাকা চাকা হয়ে শুকনো বাকল খসে যায়। বাকল মসৃণ এবং ধূসর বা বাদামি রঙের হয়। তবে বাকলের ভেতরের দিকের রঙ লালচে বাদামি। এদের শ্বাসমূল দেখা যায়। আবার শ্বাসমূলের গায়ে অনেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ছিদ্র থাকে যা লেন্টিসেল নামে পরিচিত।
আমুর গাছে ছোট ছোট হলুদ রঙয়ের ফুল হয়। ফুলগুলো পাতা বা শাখার কক্ষ থেকে থোকা হয়ে ঝুলে থাকে। ফুলগুলো একলিঙ্গ প্রকৃতির হয় অর্থাৎ কোনও ফুল পুরুষ ফুল, আবার কোনও ফুল স্ত্রী ফুল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫২: দেশহিতৈষী মা সারদা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৮: জ্ঞানদানন্দিনী দেবী—উনিশ শতকের বলিষ্ঠ লেখক এবং সমাজসংস্কারক

তবে সবচেয়ে সুন্দর হল এদের ফল। পেকে গেলে ফলের রঙ হয় হলদেটে সবুজ বা লালচে হলুদ। ফুল ছোট হলেও ফলগুলোর আকার বেশ বড়। প্রতিটা ফলের ব্যাস ৮ থেকে ১২ সেন্টিমিটার হয়। দেখে মনে হবে যেন প্রতি ফলে দুটো কোয়া রয়েছে। ফল ডিম্বাকার এবং খুব পেকে গেলে মাঝে মাঝে দুটো কোয়ার মাঝখানের শিরা থেকে কিছুটা ফেটে যায়। ফলের মধ্যে সাধারণত দুটি বীজ থাকে। জলে ভেসে থাকার সময় এই বীজের অঙ্কুরোদ্গম হয়।

আমুর গাছ এর লবণ সহন ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম। জোয়ারের জল যতদূর পর্যন্ত পৌঁছায় সেই সীমায় আমুর গাছ দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে এই জলসীমার মধ্যবর্তী অঞ্চলেও দেখা যায়। দ্বীপের চরে পলিমাটি সমৃদ্ধ অংশে এই গাছ বেশি দেখা যায়। যেখানে বড় আমুর গাছ জন্মায় তার আশেপাশে প্রচুর চারা জন্মাতে দেখা যায়। সুন্দরী ও গেঁওয়া গাছের সাথে আমুর গাছ একসাথে জন্মাতে দেখা যায়।

(বাঁদিকে) পাতাসহ আমুর গাছের গুঁড়ি। (ডান দিকে) গোশিঙা গাছ। ছবি: সংগৃহীত।

আমুর গাছের কাঠ শক্ত পোক্ত হওয়ায় নৌকা তৈরির কাজে লাগে। তাছাড়া গৃহস্থালির আসবাব, লাঙল ও জোয়াল ইত্যাদি কৃষি সরঞ্জাম এবং বাড়ি তৈরির কাজে এর কাঠ ব্যবহৃত হয়। জ্বালানি হিসেবেও আমুর গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়।

 

লৌকিক চিকিৎসা

আমাশয়, আন্ত্রিক, ত্বকের রোগ, হৃদরোগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে বিদেশে কিছু কিছু জনজাতির মধ্যে আমুর গাছের পাতা ও ফল লৌকিক ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে সুন্দরবন অঞ্চলে আমুর গাছ কোনও লৌকিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হত কিংবা এখনও হয় কিনা তা জানা যায় না।

আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: টলস্টয় ও সোফিয়া—প্রেম ও বিবাহ/১

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি

 

গোশিঙা (Dolichandrone spathacea)

গোরুর শিংয়ের মতো দেখতে লম্বা ও সামান্য বাঁকা ফল সুন্দরবনের গ্রামাঞ্চলে বাচ্চাদের কাছে এক সময় ছিল খেলার অন্যতম উপকরণ। ছোটবেলায় আমরাও এইসব ফল নিয়ে খেলেছি। মাথার দুপাশে দুটো ফল ধরে রেখে গোরু সাজা হত। এভাবেই দু’জন গোরু সাজত, আর তাদের নিয়ে একজন মিছিমিছি লাঙ্গল করতো। এ ছিল এক মজার খেলা। তাই সুন্দরবনের গ্রামাঞ্চলে রাস্তার পাশে কোথাও কোথাও গাছটিকে দেখা যেত। গ্রামের লোক গাছটিকে বলত গোশিঙ্গা বা গোরশিংঙ্গা। এই গাছটির কাঠ থেকে বেশি তৈরি করা হত জোয়াল। যেহেতু সুন্দরবনে কৃষিকাজ ছিল প্রধান উপজীবিকা এবং চাষবাসের জন্য লাঙ্গল ও জোয়াল ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ তাই গোশিঙ্গা গাছের গুরুত্ব বরাবর ছিল। কিন্তু বর্তমানে চাষবাস হয় ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার যন্ত্রের সাহায্যে। তাই সুন্দরবনের গ্রামাঞ্চলে লাঙল ও জোয়ালের ব্যবহার বিলুপ্তপ্রায়। স্বাভাবিকভাবে গোশিঙ্গা গাছও তাই বিলুপ্তপ্রায়।

আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬৯: এক লড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লগা

গোশিঙ্গা গাছ হল ছোট আকারের বৃক্ষ। ৩০ থেকে ৪০ ফুট উঁচু হয়। সারা বছর গাছে কমবেশি পাতা থাকে। বাকলের রঙ গাঢ় বাদামি। গাছের গুঁড়ি থেকে চৌকো চৌকো ধূসর রঙের বাকলের টুকরো উঠে আসতে দেখা যায়। এদের পাতার রং তামাটে সবুজ। তবে কচি পাতা এবং পাতার বোঁটার রং লাল। এদের ফুলগুলিও দেখতে ভারি সুন্দর। এক একটা ফুল হয় প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার লম্বা। ফুলের আকার ফানেলের মতো বা মাইকের চোঙার মতো। প্রতিটি ফুলে ধবধবে সাদা রঙের পাঁচটি পাপড়ি থাকে। তবে প্রতিটি পাপড়ির প্রান্ত খাঁজকাটা বা ঢেউ খেলানো। এটাই ফুলকে আরো রূপবতী করে তোলে। ২-১০ টা ফুল একসাথে থোকা হয়ে ফোটে। আর ফুলের গন্ধ ভারি মনোরম।

আমুর গাছের ফলসহ শাখা। ছবি: সংগৃহীত।

প্রতিটি বৃন্ত থেকে দুটি ফল উৎপন্ন হয়। ফলগুলি বেশির ভাগই হয় চ্যাপ্টা। কখনও সামান্য নলাকারও হয়। এক একটি ফল প্রায় এক হাত বা তারও বেশি লম্বা হয়, কিন্তু প্রান্তের দিক বাঁকা। গোরুর শিং এর মতো আকৃতি হয় বলেই এই গাছের নাম গোশিঙ্গা বা গোরশিঙ্গা। ফল পাকলে শুঁটির মতো লম্বালম্বি ফেটে যায়। প্রতিটি ফলে অনেকগুলি সাদা রঙের ত্রিকোণাকার বীজ থাকে। নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে এই গাছে ফুল ও ফল আসে।

সুন্দরবনের বসতি এলাকায় এই গাছ পাওয়া গেলেও নদীর উভয় তীরে যেখানে জোয়ারের জল পৌঁছায় সেখানে এই গাছ দেখা যায়। আর দেখা যায় সুন্দরবনের গ্রামাঞ্চলে রাস্তার ধারে এবং পুকুর ও ডোবার পাড়ে। এর কাঠ বেশ নরম ও হালকা হওয়ায় জোয়াল তৈরির কাজে বহুল ব্যবহৃত হয়।

 

লৌকিক চিকিৎসা

সুদূর অতীতে সুন্দরবনের মানুষ মুখের ভেতর ছত্রাক সংক্রমণ নিরাময়ে গোশিঙা পাতা বা বাকলের রস প্রয়োগ করত। তাছাড়া ব্রঙ্কাইটিস ও পরিপাকতন্ত্রের সমস্যায় অনেকে বাকল চূর্ণ ব্যবহার করত। বর্তমানে এইসব লৌকিক চিকিৎসা পদ্ধতি সুন্দরবন থেকে প্রায় লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। —চলবে।

* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content