রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিকে) কাঁচা করঞ্জা ফল। ছবি: সংগৃহীত। (মাঝখানে) পুষ্পশোভিত করঞ্জা শাখা। ছবি: লেখক। (ডান দিকে) খলসি গাছ। ছবি: সংগৃহীত।

 

খলসি (Aegiceras corniculatum)

সুন্দরবনের বসতি এলাকায় এই গাছটি আমার নজরে কখনও না এলেও এর নাম কিন্তু ছোট থেকেই শুনেছি। বড়দের মুখে শুনতাম সুন্দরবনের বিখ্যাত মধু হল বাইন বা খলসি গাছের ফুলের মধু। সুন্দরবনে মৌমাছিদের অন্যতম প্রিয় মধুর উৎস হল খলসি গাছের ফুল। সাদা রঙয়ের ১০ থেকে ৩০ টি ফুল একসঙ্গে থোকা হয়ে ফুটে থাকে। প্রতিটি ফুলে থাকে প্রচুর মকরন্দ। আর ফুল সুগন্ধিও বটে। প্রতিটি ফুল থেকে পাঁচটি পরাগধানী ফুলের অনেকটা বাইরে বেরিয়ে থাকে। এর ফলে ফুলের সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়। খলসি গাছের শাখায় শাখায় যখন থোকা থোকা ফুল আসে আর তার ওপর মধুপ অলির আনাগোনা শুরু হয় তখন গুঞ্জনে মুখরিত হয় খলসি বন।

খলসি গাছকে মোটামুটি বড় আকারের গুল্ম বা ছোট আকারের বৃক্ষ বলা চলে। ৭-৮ ফুট থেকে সর্বোচ্চ ২২-২৩ ফুট উঁচু হয়। চিরহরিৎ এই গাছ মাটির ওপর প্রায়শই ঝোপ তৈরি করে। তবে গাছের ওপরের দিকে প্রচুর ডালপালা জন্মায় না। খলসি গাছ হল সুন্দরবন অঞ্চলের অন্যতম প্রাথমিক প্রজাতি। আর এরা পুরোপুরি ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ। এই গাছের বাকলের রং হয় তামাটে বা হলদে। বাকল বেশ মসৃণ। তবে বাকলের ভিতরের দিকের রং হলুদ রঙের হালকা ডোরাযুক্ত সবুজ। কাঠের প্রকৃতি মাঝারি শক্ত এবং এই কাঠের রং লালচে বাদামি।

ডিম্বাকার পাতার শীর্ষদেশ একটু খাঁজ কাটা এবং ভেতরের দিকে চাপা। পাতার উপরের দিকের রং গাঢ় সবুজ হলেও নিচের দিকে রঙ হালকা সবুজ। এদের পাতায় লবণগ্রন্থি থাকায় সেই গ্রন্থির মাধ্যমে এরা অতিরিক্ত লবণ কেলাস আকারে ত্যাগ করে। সেই লবণ পাতার ওপরে সঞ্চিত হয়। খলসি গাছের ফল দেখতে ভারি সুন্দর। ২-৩ সেন্টিমিটার লম্বা ফলগুলো দেখতে গরুর শিং এর মতো বা লঙ্কার মতো, কিছুটা বাঁকা ও আগার দিক সূচালো। ফলের রং সবুজ হলেও গোড়ার দিকে বাদামি বা গোলাপি রঙের ছিট থাকে। প্রতি ফলে একটা করে বীজ থাকে। গাছ থেকে ফল খসে পড়ার পর ফলের মধ্যে বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫২: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— গর্জন, ভোলা ও নোনা ঝাউ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯১: এক আলমারি বই : রাণুর বিয়েতে কবির উপহার

খলসি গাছের লবণসহন ক্ষমতা খুবই বেশি। এরা যেদিক থেকে জোয়ার আসে সেদিকে বেশি জন্মায়। ফলে সমুদ্রের দিকে এই গাছ বেশি দেখা যায়। সমুদ্রের বিপরীত দিকের দ্বীপ অংশে খলসি গাছ দেখা যায় না বললেই চলে। অনেক সময় দ্বীপের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে একক প্রজাতি হিসেবে এরা অরণ্য গঠন করে। আবার অনেক সময় পেয়ারা বাইন, গেঁওয়া, পশুর, গরান, হরগোজা, কেওড়া, গরিয়া ইত্যাদি গাছের সঙ্গে একসাথে নদী ও খাঁড়ির উভয়দিকে দেখা যায়। খলসি গাছের ডালপালা জ্বালানি হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়। কচি পাতা অনেকে সবজি হিসেবেও খায়।
 

লৌকিক চিকিৎসা

বর্তমানে ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে এই গাছটির কোনও ব্যবহার প্রচলিত না থাকলেও অতীতে সুন্দরবনবাসী খলসি গাছের পাতা ও বাকল হাঁপানি বাত ও মধুমেহ রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করত।

(বাঁদিকে) খলসি ফল। ছবি: সংগৃহীত। (ডান দিকে) করঞ্জা গাছ। ছবি: লেখক।

 

করঞ্জা (Pongamia pinnata)

করঞ্জা গাছ নামটা শৈশব থেকে আমার অপরিচিত ছিল না, তবে কোনটা করঞ্জা গাছ তা আমি ভালোভাবে জানতাম না, কারণ আমাদের বাড়িতে বা আশেপাশে করঞ্জা গাছ ছিল না। একসময় আমার মনে একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছিল। আমি ভাবতাম, করমচা ও করঞ্জা একই গাছ, কেবল উচ্চারণে তফাত। করমচা গাছ অনেকের বাগানে দেখেছি। করমচা গাছে টক স্বাদের লাল রঙের ফল হয়। এই ভুল ধারণাটা বহুকাল মনের মধ্যে বদ্ধমূল ছিল।

আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭০: পাভেল কোথায়?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা

১৯৮৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষামূলক ভ্রমণে গিয়েছিলাম মধ্যপ্রদেশের পাঁচমারি পাহাড়ে। সেখানে পাহাড়ের জঙ্গলে বেগুনি রঙয়ের সুন্দর ফুল ফুটে থাকা অনেক বড় বড় বৃক্ষ দেখেছিলাম। সেইসব গাছের থেকে প্রায় গোলাকার বহু শুকনো ফল খসে পড়েছিল নিচে মাটির উপর। ফলের ভেতরে ছিল বৃক্কাকার বীজ। এমনই কিছু ফল আমি সংগ্রহ করে বাড়িতে নিয়ে আসি। তারপর সেই ফল থেকে বীজ বার করে তা আমাদের বাস্তুর দক্ষিণ সীমানায় দুটি জায়গায় পুঁতে দিই। অনেকগুলো বীজ লাগালেও শেষ পর্যন্ত দুটি চারা গাছ জন্মায়। তখন আমার মনে খুব আনন্দ। পাঁচমারি পাহাড়ের গাছ কিনা জন্মাল সুন্দরবন অঞ্চলের নোনা মাটিতে! চারা গাছের পাতা দেখে বাবা একদিন বলল, “এ তো করঞ্জা গাছ!

এ গাছ আমাদের এই এলাকায় অনেক পাওয়া যায়।” আমি তো মানতে নারাজ। পাঁচমারি পাহাড়ের গাছকে বলে কিনা এই এলাকার করঞ্জা গাছ! সত্যি বলতে কি আমি বিশ্বাস করিনি। দুটি গাছের মধ্যে একটি গাছ খুব দ্রুত বাড়তে লাগল। বেশ কয়েক বছর পর বড় গাছটায় ফুল এল। সেই বেগুনি রঙয়ের ছোট ছোট ফুল থোকা আকারে গাছ থেকে নিচের দিকে ঝুলে আছে। ফুল দেখে বাবা আবার বলল, “এ ১০০ শতাংশ করঞ্জা গাছ।” এরপর আর বাবার কথাকে অমান্য করা যায় না, কারণ আমার চেয়ে এ ব্যাপারে বাবার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। পরে অন্যত্র আমাদের এলাকাতেও এই গাছ নজরে এল। একই রকম ফুল, একই রকম ফল। আমার আর সংশয় রইল না। মধ্যপ্রদেশের পাহাড় থেকে বোকার মতো এমন গাছের বীজ আনলাম যা কিনা আমাদের এলাকার স্বাভাবিক গাছ! নিজের বোকামির জন্য হাসি পাচ্ছিল। তবে গাছটা তো চিনলাম। বোকামিও মাঝে মাঝে কার্যকরী হয়!
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

বুঝলাম, করঞ্জা গাছ অন্যান্য জলবায়ু ও মৃত্তিকায় জন্মালেও এর লবণসহন ক্ষমতা রয়েছে। আর তাই সুন্দরবন অঞ্চলেও গাছটি বহাল তবিয়তে জন্মায় ও বেড়ে ওঠে। আসলে এ গাছটি হল সুন্দরবনের একটি অন্যতম ম্যানগ্রোভ সহযোগী গাছ। এটি মাঝারি উচ্চতার বৃক্ষ। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ফুট উচ্চতা হয়। গাছের গুঁড়িও বেশ মোটাসোটা হয়। আর ডালপালা ছড়িয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে গাছটির বিস্তার। এর ধূসর রঙের বাকল বেশ পুরু হয় আর ভেতর দিকের রঙ হয় হালকা হলুদ। এদের প্রধান মূল মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। আবার শাখা মুলগুলিও বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়। ফলে নরম মাটিতে জন্মালেও জোয়ারের স্রোত ও সাইক্লোনের ধাক্কা ভালোভাবে সামাল দিতে পারে। ছোট ছোট মটর ফুলের মতো বেগুনি রঙয়ের ফুল দিয়ে গঠিত পুষ্পমঞ্জরী প্রতি শাখা থেকে যখন নিচের দিকে ঝুলে থাকে তখন করঞ্জা গাছের শোভা হয় অপরূপ। করঞ্জা ফল হয় শুঁটির আকারে।

এক টাকার কয়েনের আকারের শুঁটিগুলোর রঙ হয় কাঁচা অবস্থায় সবুজ আর শুকিয়ে গেলে ধূসর। প্রায় গোলাকার শুঁটিগুলোর আগা হয় সামান্য সূচালো, আর প্রতি শুঁটিতে একটি করে বৃক্কাকার বীজ থাকে। গোড়া থেকে করঞ্জা গাছ কেটে নিলে কাটা অংশ থেকে প্রচুর শাখা বেরিয়ে পুনরায় বৃক্ষে পরিণত হয়। আবার মাটির ওপরের দিকে থাকা শাখা মূল থেকে চারা গাছ জন্মাতেও দেখা যায়। ফলে করঞ্জা গাছকে বংশবিস্তারের জন্য কেবল বীজের উপর নির্ভর করতে হয় না। করঞ্জা গাছ মাঝারি ধরনের লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে এবং বেশ কিছুদিন নোনা জলে নিমজ্জিত থাকলেও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। আর বহু ধরনের মৃত্তিকা ও জলবায়ুতে যে এর বাঁচার ক্ষমতা রয়েছে সে তো আগেই বলেছি। সুন্দরবন অঞ্চলে এই গাছ নদী, খাঁড়ি ও খালের দু’পাশে এককভাবে কিংবা সুন্দরী, গরান, ভোলা, অনন্তকাঁটা ইত্যাদি গাছের সাথে একসাথে জন্মাতে দেখা যায়।

(বাঁদিকে) খলসি গাছের ফুল। ছবি: সংগৃহীত। (ডান দিকে) করঞ্জা পুষ্পমঞ্জরী। ছবি: সংগৃহীত।

করঞ্জা গাছ নানা কাজে ব্যবহার হয়। কাঠ মাঝারি ধরনের দৃঢ় হওয়ায় আসবাব তৈরির কাজে ও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। করঞ্জা বীজের থেকে একপ্রকার তেল পাওয়া যায় যা আলো জ্বালাতে অতীতে ব্যবহৃত হত। সুন্দরবনের মানুষ আলো জ্বালানোর জন্য সুদূর অতীতে করঞ্জা বীজের তেল ব্যবহার করত। তাছাড়া এই তেল লুব্রিক্যান্ট হিসেবে যন্ত্রাংশে ব্যবহার করা যায়। মশাসহ নানা বিষাক্ত পোকামাকড় তাড়াতে সুদূর অতীত থেকে করঞ্জা বীজের তেল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এদের মূলের বিস্তার মাটির গভীরে এবং বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় ভূমিক্ষয় রোধে করঞ্জা গাছ ভীষণ কার্যকরী। এই গাছের পাতা থেকে উত্তম মানের জৈব সার তৈরি করা যায়। তাছাড়া করঞ্জা ফুলের মকরন্দ মৌমাছিদের অতি প্রিয়। সুন্দরবনে মধুর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস হল এই করঞ্জা গাছ। গোরু ও ছাগলের খুব প্রিয় খাদ্য করঞ্জা গাছের পাতা।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৬: কুসুমকুমারী দাশ—লক্ষ্মী সরস্বতীর যুগ্ম মূর্তি

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪১: দুধ না খেলে?

 

লৌকিক চিকিৎসা

সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ অতীতে করঞ্জা গাছের বীজ থেকে প্রাপ্ত তেল ত্বকের রোগ ও বাতের চিকিৎসায় ব্যবহার করত। বদহজম ও লিভারের রোগেও এই তেল ব্যবহৃত হত। ক্ষত, হারপিস রোগ এমনকি কিছু ক্ষেত্রে কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসাতেও করঞ্জা বীজের তেল ব্যবহার করা হত। তাছাড়া বহুকাল ধরে এই সব অঞ্চলে হুপিং কাশি, ব্রংকাইটিস ও জ্বরের চিকিৎসায় করঞ্জা বীজ গুঁড়ো করে ব্যবহার করা হত। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রসারে করঞ্জা গাছের এইসব লৌকিক চিকিৎসা এখন অতীত। —চলবে।

* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content