মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


(বাঁদিকে) গর্জন গাছের জঙ্গল। ফল-সহ গর্জন গাছ। ছবি: সংগৃহীত।

 

বাইন

আমাদের এলাকায়, মানে সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে বাইন গাছ লোকমুখে বানি গাছ নামে বেশি পরিচিত। কোথাও কোথাও বিনা নামেও পরিচিত। বাইন গাছেরা হল, সুন্দরবনের স্থলভাগের উপকূল রক্ষীবাহিনী। সুন্দরবনের নদী বা খাঁড়িতে নৌবিহারকালে দু’পাশে প্রথম যেসব গাছ সার বেঁধে আপনাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকে তারা হল বাইন গাছ। জোয়ারের সময় এরা নোনা জলের সাথে যেন কোলাকুলি করে। আজন্ম এই গাছগুলিকে আমি নদী, খাল ও খাঁড়ির দু’পাশে দেখে আসছি।

সুন্দরবন হাজার সমস্যায় জর্জরিত হলেও এদের কোনও সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হয় না। অর্ধ-শতক আগে যেমন পুষ্প-পত্রশোভিত বাইন গাছের সারি দেখেছি, আজও তেমনই দেখছি। এরা অতিরিক্ত, মাঝারি বা কম লবণাক্ত সব রকম পরিবেশেই চমৎকার মানিয়ে নিতে পারে। তাই যে সব খালে আগে জোয়ার-ভাটা খেলত কিন্তু এখন বদ্ধ নালাতে পর্যবসিত হয়ে গেছে সেখানে আজও বাইন গাছ রয়েছে এবং নতুন গাছ জন্মাচ্ছে। পলি জমে কোনও চর তৈরি হলে বা নদী ও খাঁড়ির দু’পাশে ধানি ঘাসের পর দ্বিতীয় প্রজাতি হিসেবে এরাই হাজির হয়। অর্থাৎ বাইন হল সুন্দরবনের জন্মলগ্নের প্রজাতি। এরা বৃক্ষ হওয়ায় সুন্দরবনের অগ্রজ বৃক্ষ প্রজাতি (Pioneer treee species) হিসেবে বাইনকে বিজ্ঞানীরা স্বীকৃতি দিয়েছেন।

কোথাও কোথাও ধানি ঘাসের সঙ্গে বা আগেও বাইন গাছ জন্মে যায়। সারা বছর বাইন গাছ সবুজ পাতায় ভরা থাকে। মার্চ থেকে জুন মাসের মধ্যে গাছ ভরে যায় বাসন্তী রঙের ফুলে। আম গাছে যেমন মুকুল আসে অনেকটা তেমনই মুকুল হয়। তখন শত-সহস্র মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে ওঠে বাইন-পাড়া। সুন্দরবনের মধুর অন্যতম প্রধান উৎস হল বাইন গাছ। বাইন ফুল থেকে প্রাপ্ত মধু তীব্র মিষ্টি নয়, আর সামান্য ঝাঁকালে ফেনা তৈরি হয়।

সুন্দরবন এলাকায় তিন ধরণের বাইন গাছ দেখা যায়—কালো বাইন, জাত বাইন এবং পেয়ারা বাইন।
 

কালো বাইন (Avicennia alba)

এটি মাঝারি আকারের বৃক্ষ। পূর্ণ বয়স্ক গাছ প্রায় ২৪/২৫ ফুট লম্বা হয়। কাণ্ডের রং কালচে। তাই নাম কালো বাইন। প্রচুর শ্বাসমূল জন্মায়। শ্বাসমূলগুলো সরু, লম্বা ও মাটির উপর গোঁজের মতো বেরিয়ে থাকে। অত্যন্ত পাতাবহুল গাছ। অন্য বাইন প্রজাতির থেকে একে আলাদা করা যায় প্রধাণত পাতা দেখে। পাতা উপবৃত্তাকার ও নিচের দিক ফ্যাকাসে। পাতার শীর্ষ সূচালো। হলদে বা কমলা রঙের ছোট ছোট ফুল গুচ্ছাকারে জন্মায়। নতুন জেগে ওঠা চরে এরা দ্বিতীয় বা প্রথম প্রজাতি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর বাকল থেকে প্রচুর ট্যানিন পাওয়া যায়। সুন্দরবনের মানুষ কালো বাইনের ডালপালা জ্বালানি হিসেবে বা বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করে।

আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৬: সুন্দরবনের লৌকিক চিকিৎসায় ম্যানগ্রোভ—হরগোজা ও কেয়া

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৮: চল্লিশ পার হলেই নিরামিষ?

 

লৌকিক চিকিৎসা

হাঁস-মুরগির চুনের মতো পায়খানা হলে কাঠ পোড়ানো ছাই জলে গুলে খাওয়ানো হয়। এই কাঠের ছাই ও শুকনো কলাপাতার ছাই একত্রে মিশিয়ে সোডার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায়।

(বাঁদিকে) পেয়ারা বাইন গাছ। (ডানদিকে) ফুলের কুঁড়ি-সহ পেয়ারা বাইনের শাখা। ছবি: লেখক।

 

জাত বাইন (Avicennia marina)

এর সব বৈশিষ্ট্যই কালো বাইনের মতো, কেবল পাতার শীর্ষ কিছুটা ভোঁতা। পাতার উপরের দিকের রং হলদেটে-সবুজ এবং চকচকে মসৃণ। কিন্তু পাতার নিচের দিক ফ্যাকাশে এবং অমসৃণ। পাতার মাধ্যমে এরা অতিরিক্ত লবণ ত্যাগ করে। এই গাছ ৮/১০ ফুট থেকে ৪৫/৪৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। ছোট গাছেও ফুল চলে আসে। ছোট ছোট হলদে রঙের ফুল থোকা থোকা হয়ে ফোটে। এদের বাকলের রঙ ধূসর হওয়ায় জাত বাইনকে অনেকে সাদা বাইন বা ধূসর বাইনও বলে। বাকল মসৃণ, পাতলা এবং সরু সরু ফাটলযুক্ত। ছোট ছোট চাকলার আকারে শুকনো বাকলের টুকরো উঠে আসে। খাল বা খাঁড়ি বা নদীর দু’পাড়ে ঢালু জায়গায় এরা সারিবদ্ধভাবে জন্মায়। ফলে নতুন জমা পলি আটকে রাখতে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। নতুন চরে এরা কালো বাইনের সাথে প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজাতি হিসেবে জন্মায়। তাই এরাও সুন্দরবনের সূচনাকারী উদ্ভিদের (Pioneer species) মধ্যে অন্যতম। জাত বাইনের বাকল থেকেও ট্যানিন পাওয়া যায়। সুন্দরবনের মানুষ কালো বাইনের মতো জাত বাইনএর ডালপালাও জ্বালানি ও বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করে। কাঠ শক্তপোক্ত না হওয়ায় আসবাব বা বাড়ির কাঠামো তৈরির কাজে বাইন ব্যবহৃত হয় না।

আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২১: গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী—এক শক্তির গল্প

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬১: মহাভারতের রাক্ষসরা কী আজও বর্তমান? প্রসঙ্গ— বকরাক্ষসবধ

 

লৌকিক চিকিৎসা

বাকলের ক্বাথ হাত ও পায়ে হাজার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। কাঁচা ফলের ক্বাথ ফোঁড়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। অম্বল হলে রোগীকে বাকল পোড়া ছাই খাওয়ানো হয়।

(বাঁদিকে) জাত বাইন। (ডানদিকে) জাত বাইনের ফুল-সহ শাখা। ছবি: সংগৃহীত।

 

পেয়ারা বাইন (Avicennia officinalis)

পেয়ারা বাইনের প্রায় সব বৈশিষ্ট্যই জাত বাইনের মতো। তবে পাতার আগা অনেকটা গোলাকার। পাতার রঙ হলদেটে সবুজ। পেয়ারা পাতার সঙ্গে এদের পাতার অনেকটা সাদৃশ্য থাকায় সুন্দরবনের মানুষ এদের পেয়ারা বাইন বলে। পাতার উপরে ধুলোর আস্তরণের মতো লবণ জমে থাকতে দেখা যায়। নদী, খাল ও খাঁড়ির দুপাশে পেয়ারা বাইন গাছ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। পূর্ণবয়স্ক গাছ ৪০ ফুট থেকে ৯০ ফুট উঁচু হলেও গোড়া থেকে এত ডালপালা বেরোয় যে গাছের গুঁড়ি প্রায় ঢাকা পড়ে যায়, দূর থেকে বিরাট আকারের ঝোপ মনে হয়। পেয়ারা বাইনের গুঁড়ির রঙ হয় ফ্যাকাশে সবুজ বা ধূসর এবং মসৃণ। বাকলে হালকা ফাটল দেখা গেলেও কখনও চাকলা হয়ে উঠে আসে না। ফুলের রং হয় কমলা বা হলুদ। আর এদের ফুলের আকার ঘণ্টার মতো এবং সব প্রজাতির বাইনের মধ্যে বড়। সবুজ বা বাদামি রঙের এবং হৃৎপিন্ড আকারের ফল হয়। পেয়ারা বাইনের বাকল থেকে প্রচুর ট্যানিন পাওয়া যায়। এদের ডালপালা সুন্দরবনবাসীরা মূলত জ্বালানীর কাজে ব্যবহার করে থাকে।

আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৬: যন্ত্রণাদগ্ধ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাঁচিতে পেয়েছিলেন সান্ত্বনার প্রলেপ

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬৪: জঙ্গল বিপদে আছে…

 

লৌকিক চিকিৎসা

বীজের মণ্ড ঘা বা আঘাত লেগে ফুলে যাওয়া স্থানে লাগিয়ে রোগীর চিকিৎসা করা হয়। এর মূল যৌন উত্তেজনা বর্ধক এবং বাকলের রস মূত্রবর্ধক, ত্বকের রোগ, বাত, পক্ষাঘাত, হাঁপানি, সর্পদংশনে ব্যবহৃত হয়। বদহজম দূর করতে এর বাকলের রস চিনি ও জিরের সাথে মিশিয়ে খাওয়ার প্রচলন আছে। এর কান্ড থেকে ক্ষরিত রজন জাতীয় তরল জন্ম নিয়ন্ত্রণের কাজেও ব্যবহৃত হয়।

(বাঁদিকে) পুষ্পমঞ্জরীসহ কালো বাইনের শাখা। (ডানদিকে) কালো বাইন। ছবি: সংগৃহীত।

 

গর্জন (Bruguiera cylindrica)

গর্জন গাছ হল মাঝারি আকৃতির বৃক্ষ। নদী বা খালের দু’পারে কিংবা সমুদ্রের দিকে উপকূল বরাবর গর্জন গাছের সারি দেখতে অসাধারণ লাগে। বাইন গাছের পেছনে দ্বিতীয় স্তরে এরা জন্মায়। এর পাতার আকার অনেকটা কালো বাইনের পাতার মতো হলেও গাছের উচ্চতা বেশ কম, গড়ে ৫০-৬০ ফুট। পাতার উপর দিকের রঙ গাঢ় সবুজ ও নিচের দিকের রং হালকা সবুজ। পাতার উপর দিকে মোম বেশি থাকায় চকচকে। এদের গুঁড়ির গোড়ার দিকে চারদিক থেকে ছোটো ছোটো তক্তার মতো কিছু অধিমূল তৈরি হলেও প্রচুর ছোটো-বড়ো সাধারণ মূল বের হয়। এগুলোকে জানুমূল (Knee root) বলে। গাছের গুঁড়িকে বেষ্টন করে জানুমূলগুলো দৃষ্টিনন্দনভাবে বিন্যস্ত থাকে।

ঝড়ে বা স্রোতের আঘাতে যাতে গাছ উপড়ে না যায়, তাই এমন ব্যবস্থা। গর্জন গাছের শ্বাসমূলগুলো হয় নলাকার এবং ৩০-৪০ সেমি লম্বা। বাকল ফাটলযুক্ত এবং ধূসর রঙের। ফুলের পাপড়ি সংখ্যায় আটটি এবং রং সাদা। ফুলের বৃতির রঙ ফ্যাকাশে সবুজ। বৃতিতে আটটি বৃত্যংশ থাকে যেগুলো গোড়ার দিকে যুক্ত ও আগার দিকে মুক্ত। জরায়ুজ অঙ্কুরোদ্গম হয়, অর্থাৎ ফল গাছে থাকতেই বীজের অঙ্কুরোদ্গম হয়। ২০-২৫ সেমি লম্বা বাঁকা সবুজ রঙের অঙ্কুর (বীজপত্রাবকাণ্ড) গাছে থাকা ফল থেকে বেরিয়ে এসে গাছেই ঝুলতে থাকে। দেখে মনে হবে গাছ থেকে অনের শসা ঝুলে আছে! গর্জন গাছের জঙ্গলের দৃশ্য এই সময় খুবই মনোরম। গর্জন কাঠ খুব শক্তপোক্ত হওয়ায় আসবার ও নৌকো তৈরি করার কাজে ব্যবহার করা হয়। জ্বালানী হিসেবে এই কাঠের চাহিদাও বেশি। এর বাকলের অদ্ভুত এক গন্ধ আছে। শোনা যায়, বাকলের গন্ধে নাকি মাছেরা পালায়।
 

লৌকিক চিকিৎসা

গর্জন গাছের ফল বেটে নখকুনিতে লাগালে সেরে যায়। বাকল সেদ্ধ করা জল দিয়ে গোরুর ক্ষুরের ঘা সারানো যায়। রক্তপাত বন্ধ করতে এবং ঘা ও বাত সারাতে এর মূল ও পাতার রস ব্যবহার করা হয়। —চলবে।

* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content