শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


(বাঁদিকে) সুন্দরবনে বাঘের আস্তানা আর উৎকৃষ্ট ঝাড়ুর উৎস হেতাল গাছ। (ডান দিকে) সুন্দরবনের আর এক অতি পরিচিত ম্যানগ্রোভ গরান। ছবি: সংগৃহীত।

ছোট থেকেই শুনতাম আমি ও আমার পরিবার সুন্দরবনে বাস করি। আর এটাও শুনতাম যে, সুন্দরবন নাম হওয়ার পিছনে বিভিন্ন কারণের মধ্যে একটি সম্ভাব্য কারণ হল সুন্দরী গাছ। আমাদের গ্রামের বাড়িতে দুটো পুকুর ছিল। দুটো পুকুরেই ছিল কয়েকটা গাছের মুড়ো। কতদিনের পুরনো মুড়ো কেউ জানে না। কিন্তু একেবারে অক্ষত। পুকুর খোঁড়ার সময় পাওয়া গিয়েছিল প্রায় দশ ফুট গভীরে। বাবা বলতেন, এগুলো সুন্দরী গাছের গোড়া। সুন্দরী গাছ কখনও পচে না। তাই সুন্দরী গাছ আমাদের এলাকায় কখনও না দেখলেও একসময় যে আমাদের এলাকায় সুন্দরী গাছ ছিল তা বিশ্বাস করতাম। কিন্তু কেন এখন সুন্দরী গাছ নেই তা ছোটবেলায় জানতাম না।

পরে জানলাম, সুন্দরী গাছ বেশি লবনাক্ততা একেবারেই সহ্য করতে পারে না। এই গাছের সঙ্গী হল হেতাল আর গোলপাতা। ফলে সুন্দরীর সঙ্গে পশ্চিম সুন্দরবন থেকে হারিয়ে গেল হেতাল ও গোলপাতাও। হেতাল ও গোলপাতার জঙ্গল হল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের প্রিয় আস্তানা। সুতরাং পশ্চিম সুন্দরবন থেকে কেন শার্দূল মহারাজ পুবের দিকে চলে গেলেন তার কারণও বোঝা গেল।

আমাদের গ্রামের বাড়িতে ছিল মাটির দেওয়াল এবং আংশিক খড় ও টালির ছাউনি। সেই বাড়ির একদিকে ছিল রান্নাঘর আর একটা গুদাম ঘর। ওই দুটো ঘরের দেওয়াল ছিল ছিটেবেড়ার। মাঝে মাঝে দেওয়াল থেকে মাটি খসে গেলে ভিতরে থাকা কাঠামো দেখা যেত। বড়দের কাছ থেকে শুনেছি, এগুলো নাকি গরান গাছের ডাল দিয়ে তৈরি। গ্রামের অন্যান্য বাড়িতেও দেখেছি গরান গাছের ডাল দিয়ে ছিটে বেড়া দিতে। সরু হলেও বেশ শক্তপোক্ত। আর গরান কাঠেও কখনও উইপোকা লাগতে দেখিনি। আর একটা কাঠের ব্যবহার খুব হত মাটির বাড়িগুলোতে।
আমাদের বাড়িতেও বারান্দার খুঁটি ও খড়ের চালের কাঠামো তৈরি হয়েছিল সেই কাঠ দিয়ে। কাঠ না বলে বলা ভালো শক্তপোক্ত লম্বা ডান্ডা। সবাই বলতো এ হল হেতাল গাছের ডাল। ছোট থেকে দেখেছি, অনেক হেতাল ডাল আমাদের বাড়ির মাচায় তোলা ছিল। সম্ভবত, বাবা কিনে এনেছিল। কাঠের দোকানে হেতাল ও গরান কাঠ বিক্রি হতেও দেখেছি।

কাঠামোর কোনও কাঠ বা খুঁটি নষ্ট হয়ে গেলে মাচা থেকে হেতাল ডাল নামিয়ে এনে মেরামত করা হত। তবে এই হেতাল গাছ বা গরান গাছ আমাদের এলাকায় কখনও দেখিনি। বাবার মুখে শুনেছি, বিষধর সাপ মারার জন্য হেতাল ডান্ডা নাকি খুব ভালো কাজ দেয়। মনসামঙ্গল কাব্যে চাঁদ সদাগরের হাতে থাকত হেতাল বাড়ি। আমাদের বাড়িতেও একটা সোজা হেতাল বাড়ি দরজার কোণে দাঁড় করানো থাকত। বিষধর সাপ দেখতে পেলে বাবা সেই হেতাল বাড়ি দিয়ে অনেকবার সাপ মেরেছে।

বাবা বলত, হেতাল বাড়ির এক ঘা পড়লেই সাপ কুপোকাত। সেই হেতাল গাছের পাতা থেকে তৈরি হত কুস্তে বা ঝাড়ু। আমাদের গ্রাম্য ভাষায় বলা হত ছেন্যা। দরিদ্র মহিলারা সেই ছেন্যা আঁটি বেঁধে মাথায় করে মাঝে মাঝেই বাড়ি বাড়ি ফেরি করত। ওরা বলত ঝাঁপি গাছের পাতা থেকে তৈরি করা হয় এই ছেন্যা। ছোটবেলায় জানতাম না হেতাল গাছ আর ঝাঁপি গাছ একই। ওই মহিলারা নাকি নদী পেরিয়ে জঙ্গল থেকে ঝাঁপি গাছের কচি পাতা কেটে এনে শুকিয়ে তা দিয়ে ছেন্যা তৈরি করত। খেজুর পাতার তৈরি ছেন্যার থেকে ঝাঁপি গাছের পাতায় তৈরি ছেন্যা ছিল অনেক পোক্ত ও কার্যকরী। এখন এখানে হেতাল গাছ নেই আর তাই হেতাল পাতার ছেন্যাও নেই।

(বাঁদিকে) জোয়ার-ভাটা খেলা নদী ও খালের দু'পাশে অতি পরিচিত ম্যানগ্রোভ পেয়ারা বাইন বা বানি। (ডান দিকে) সুন্দরবনে উচ্চ লবনসহনশীল ম্যানগ্রোভ গেঁওয়া। ছবি: সংগৃহীত।

সুন্দরী, গোলপাতা ও হেতাল গাছ আমাদের পশ্চিম সুন্দরবন এলাকায় এখন দেখতে না পেলেও ছোট থেকে যেসব গাছ আমার বাড়ির সামনে খালের ধারে কিংবা গ্রামের উত্তর সীমানায় নদীর তীরে দেখেছি সেই সব গাছ কিন্তু গ্রামের অন্যত্র কোথাও দেখিনি। ফলে তখন থেকেই এটা বুঝেছিলাম যে, ওই সব গাছ সেখানেই জন্মায় যেখানে প্রতিদিন জোয়ার ভাটার সময় নোনা জল পৌঁছয়। সবচেয়ে বেশি যে তিন ধরণের গাছ প্রচুর পরিমাণে আশৈশব আমাদের বাড়ির সামনেই দেখেছি সেগুলো হল—গেঁওয়া, পেয়ারা বাইন আর হরগোজা। স্থানীয় ভাষায় এই গাছগুলোকে লোকে বলে গ্যামা, বানি আর হরকচ।

তাছাড়া এগুলোর সঙ্গে জঙ্গল এলাকায় ও নদীর ধারে দেখা যায় গরান, কাঁকড়া, খামু ইত্যাদি গাছও। বলা বাহুল্য এইসব গাছ বেশি লবনাক্ত অঞ্চলে জন্মায়। সুন্দরবন যে টেকটোনিক পাতের উপর অবস্থিত তা ক্রমশ পুবদিকে হেলে যাওয়ায় সুন্দরবনের পশ্চিমাংশ ক্রমশ উঠে যাচ্ছে। এতে এই অংশে গঙ্গা ও তার শাখা নদীগুলি দ্বারা বাহিত মিষ্টি জলের প্রবাহ কমছে। পশ্চিমাংশের লবনাক্ততা বৃদ্ধির কারণ এটাই।

নদী বা খালের ধার ছাড়াও আজকাল সুন্দরবনের বসতি এলাকার অনেক জায়গাতেই গেঁওয়া গাছ দেখা যায়। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে সুদূর অতীতে এই অঞ্চলগুলো নিশ্চিতভাবেই নদী বা খাঁড়ি এলাকা ছিল। এখানে নিয়মিত জোয়ার ভাটা খেলতো। প্রাকৃতিক বা মনুষ্য সৃষ্ট কারণে এই জায়গাগুলি এখন বুজে গিয়েছে, কিন্তু রয়ে গেছে দীর্ঘজীবী গেঁওয়া গাছ। আর এই গেঁওয়া গাছের কোনও অর্থকরী গুরুত্ব না থাকায় এবং এর আঠা বিষাক্ত হওয়ায় গাছগুলো যেখানে ছিল প্রাকৃতিকভাবে এর মৃত্যু না হলে অধিকাংশ গাছই সেখানে আজও টিকে আছে। পক্ষান্তরে গরান, গোলপাতা, কাঁকড়া ও খামু অর্থকরী গাছ হওয়ায় জনবসতি এলাকা থেকে চিরবিদায় নিয়েছে। কাকদ্বীপ থেকে নামখানা যাওয়ার ১১৭ নম্বর জাতীয় সড়কের পূর্ব দিকে এখনও বেশ কিছু গেঁওয়া গাছ দেখা যায় রাস্তা থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে ধান জমির আল বরাবর। এগুলো প্রমাণ করছে এখান দিয়েই প্রবাহিত হত লুপ্ত নদী আদিগঙ্গার প্রায় লুপ্ত শাখা ঘিয়াবতি বা ঘিবতি।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের বাঘের ভবিতব্য

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’

সুন্দরবনকে যে বলা হয় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা ম্যানগ্রোভ অরণ্য তা জানলাম স্কুলে গিয়ে। বাংলাতে ম্যানগ্রোভ অরণ্যকে বলা হয় বাদাবন। বাদা মানে হল জলাকীর্ণ কোনও ভূমিভাগ। সেখানে গড়ে ওঠা বন হল বাদাবন। এদিক দিয়ে বিচার করলে সুন্দরবনকে বাদাবন বলার যথার্থ কারণ রয়েছে। বাদাবন হল ইংরেজিতে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এই ‘Mangrove’ শব্দটা এল কোথা থেকে? বিশেষজ্ঞদের ধারণা, পর্তুগিজ শব্দ ‘Mangue’ থেকে কিংবা স্প্যানিশ শব্দ ‘Mangle’ থেকে ম্যানগ্রোভ কথাটির উৎপত্তি। পর্তুগিজ শব্দটি ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের প্রাচীন তাইনো উপজাতির ব্যবহৃত শব্দ। এর সাথে ইংরেজি শব্দ ‘Grove’ জুড়ে ম্যানগ্রোভ শব্দটি সৃষ্টি হয়েছে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ইংরেজিতে ‘Grove’ শব্দের অর্থ হল উপবন।

১৬৬৫ সালে ক্যারিবীয় দ্বীপ বারমুডা থেকে প্রাপ্ত এক প্রাচীন লেখায় দেখা যাচ্ছে একটি শব্দ ‘Mangrowes’। সেই লেখাতেই রয়েছে, অন্যান্য গাছেদের মধ্যে এক অদ্ভুত ধরনের গাছ সেখানে জন্মায়। স্থানীয় মানুষেরা একে বলে “Mangrowes” বা ‘বিস্ময় গাছ’। এমনও হতে পারে, ইউরোপীয়দের কাছে অপরিচিত এই শব্দ কালক্রমে রূপান্তরিত হয়েছে ম্যানগ্রোভে। আবার কারও কারও মতে, মালয় অঞ্চলে প্রাচীনকালে ব্যবহৃত একটি শব্দ “manggi-manggi” থেকে ম্যানগ্রোভ কথাটি এসেছে।

(বাঁদিকে) সুন্দরবনের এক অতি পরিচিত ম্যানগ্রোভ হরগোজা। (ডানদিকে) হেনরি আইল্যান্ডের মাঝে তৈরি হওয়া অ্যালগাল ব্লুম। ছবি: সংগৃহীত।

সে যাই হোক, সারা পৃথিবীর ক্রান্তীয় সমুদ্র তটভূমি অঞ্চলের এক চতুর্থাংশ দখল করে রয়েছে এই বিশেষ ধরনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য। পৃথিবীর প্রায় ৩০টি দেশে ১৪,৭৯০০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকায় রয়েছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। তবে আকার আর বৈচিত্র্যে সুন্দরবন হল সমস্ত ম্যানগ্রোভ অরণ্যের মধ্যে অনন্য। ১৮১০ সালে বর্তমান ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে প্রায় ২০,০০০ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র উপকূল জুড়ে ছিল গহন সুন্দরবন। আর এখন তা এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটারে। অর্থাৎ অর্ধেক অরণ্য গত ২০০ বছরে সাফ হয়ে গিয়েছে। ভারতীয় অংশে রয়েছে ৩৪৪৩ বর্গ কিলোমিটার অরণ্য, আর বাংলাদেশ অংশে রয়েছে ৬৫১৭ বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবনের জঙ্গল নিকেশ করে গড়ে ওঠা বসতির বাসিন্দা আমিও একজন। আমার পূর্বপুরুষেরা সুন্দরবনের অরণ্য হাসিল করে বসতি গড়েছিল, এটা ভাবলে আজও নিজেকে অপরাধী মনে হয়।

সুন্দরবনে জঙ্গল হাসিল করে সবচেয়ে বেশি জনবসতি গড়ে উঠেছে পশ্চিমাংশে অর্থাৎ ভারতীয় সুন্দরবন অংশে। আবার ভারতীয় অংশের পূর্ব দিকে যতটা অরণ্য রয়েছে, পশ্চিম অংশে তার সিকি ভাগও নেই। যেহেতু আশৈশব রয়েছি সুন্দরবনের পশ্চিম প্রান্তে তাই সুন্দরবনের প্রকৃত অরণ্য দেখার সুযোগ হয়েছে খুবই কম। নামখানা ব্লকে একসময় অনেকটাই ম্যানগ্রোভ অরণ্য ছিল। জম্বুদ্বীপ, হেনরি আইল্যান্ড, ফ্রেডেরিক আইল্যান্ড, বকখালি, পাতিবুনিয়া, মৌসুনি ইত্যাদি দ্বীপগুলোতে যথেষ্ট ম্যানগ্রোভ অরণ্য ছিল। এখন জম্বুদ্বীপ ছাড়া বাকি দ্বীপগুলির ম্যানগ্রোভ অরণ্য বিলুপ্তির প্রহর গুনছে। পাতিবুনিয়া। মৌসুনি, বকখালি ইত্যাদি দ্বীপে এখন ঘন জনবসতি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪০: মা সারদার নিজবাটি

গত শতকের ৬০ ও ৭০-এর দশকে বকখালির উত্তর অংশে বিপুল পরিমাণ ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করে মনুষ্য বসতি গড়ে ওঠে। সত্তরের দশকে ভয়ংকর সাইক্লোনে ফ্রেজারগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুর অঞ্চল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলে বকখালিকে নতুন পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়। তখন থেকেই বকখালির ম্যানগ্রোভ-নিধন পর্ব জোরদার হয়। সাগরদ্বীপেও একসময় ছিল গভীর ম্যানগ্রোভ অরণ্য সেই অরণ্যে ছিল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ও অধুনা লুপ্ত জাভা গন্ডার।

পরবর্তী সময়ে বকখালি, পাতিবুনিয়া, মৌসুনি ও সাগরদ্বীপে ব্যাপক জঙ্গল হাসিল করে জনবসতি গড়ে ওঠে। মৌসুনি দ্বীপের কেবল দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম অংশে অতি সামান্য ম্যানগ্রোভ অরণ্য টিকে আছে। আবার অতিরিক্ত লবনাক্ততার জন্য পাতিবুনিয়া দ্বীপের ম্যানগ্রোভ অরণ্যের গাছ খুব বেঁটে ও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। বেড়ে গিয়েছে জলজ আগাছা। এগুলো নোনা জলের আসা-যাওয়ার পথে বাধা তৈরি করছে। এখানে ভরা জোয়ারের সময় উঁচু অঞ্চলে যে লবনাক্ত জল প্রবেশ করে তা অনেকটাই এই আগাছার জঙ্গলে আটকে গিয়ে নামতে পারে না। আর তার ফলে মাটির লবনাক্ততা বেড়েই চলেছে।

বেলাভূমিতে ভেসে এসে জড়ো হওয়া ম্যানগ্রোভের বীজ গবাদি পশুর প্রিয় খাদ্য। ছবি: সংগৃহীত।

হেনরি ও ফ্রেডেরিক আইল্যান্ডেরও একই অবস্থা। দ্বীপ-মধ্যস্থ সরু খাঁড়ি ও নালাগুলো ক্রমশ মজে যাচ্ছে। ফলে এই দুটি দ্বীপেও জোয়ারে প্রবেশ করা জল ভাটার সময় আটকে যাচ্ছে। এর ফলে এই দুই দ্বীপেও জঙ্গলের ম্যানগ্রোভ রুগ্ন হয়ে যাচ্ছে ও মারা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও টাকের মতো বৃক্ষশূন্য এলাকা তৈরি হয়েছে জঙ্গলের মধ্যে। জমা জলে তৈরি হচ্ছে শৈবাল ব্লুম (Algal bloom)। আবার ভাটার সময় জল যদি ভালোভাবে না নামতে পারে তবে উঁচু অঞ্চলে জন্মানো ম্যানগ্রোভের বীজ স্রোতের সাথে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে না। ফলে ম্যানগ্রোভের বিস্তারেও বাধা তৈরি হচ্ছে। আবার জনবসতি বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে গবাদি পশুর চারণক্ষেত্রও বেড়েছে। বহু গবাদি পশু ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের মধ্যে ঘোরাঘুরি করে। তারা বহু ম্যানগ্রোভের বীজ ও চারাগাছ খেয়ে নেয়। তাদের পায়ের চাপেও নষ্ট হয় বহু বীজ ও সদ্য অঙ্কুরিত চারা। জনবসতিপূর্ণ দ্বীপের বেলাভূমিতে ম্যানগ্রোভের যেসব বীজ জোয়ারের সাথে ভেসে এসে জমা হয় সেগুলো খাওয়ার জন্য প্রায়শই গোরু ও ছাগলকে ঘুরতে দেখা যায়। এর ফলে বেলাভূমিতে নতুন ম্যানগ্রোভ জন্মাতে পারে না। এই কারণে জনবসতিহীন দ্বীপ লোথিয়ান, চুনপিড়ি ইত্যাদিতে ম্যানগ্রোভ আগের চেয়ে বেড়েছে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৮: মোহিতকুমারী এক মহিলা আত্মজীবনীকার

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫: কৃষ্ণ মাণিক্য সিংহাসনে বসেই উদয়পুর থেকে রাজধানী সরিয়ে আনেন আগরতলায়

সুন্দরবন অঞ্চলে সাবাড় কথাটার সঙ্গে পুরনো দিনের মানুষরা খুব পরিচিত। জম্বুদ্বীপের ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করে গত শতকে গড়ে উঠেছিল সাবাড়। মৎস্যজীবীরা সমুদ্রে মাছ ধরে সেই মাছ শুকানোর জন্য ব্যবহার করত এই দ্বীপ। ফলে গত শতকে ৮০ ও ৯০-এর দশকে এখানে ম্যানগ্রোভ অরণ্য ধ্বংস করে কয়েক হাজার মৎস্যজীবীর অস্থায়ী আস্তানা গড়ে ওঠে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২০০৭ সাল থেকে জম্বু দ্বীপে সাবাড় বন্ধ হয়েছে। বনবিভাগ সমস্ত অস্থায়ী বাসিন্দাকে জম্বুদীপ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এখন জম্বুদ্বীপ সম্পূর্ণভাবে সংরক্ষিত এলাকা এবং ধীরে ধীরে জম্বুদ্বীপ তার হারানো ম্যানগ্রোভ ফিরে পাচ্ছে। যদিও ভাঙনের গ্রাসে এখন এই দ্বীপ বিপর্যস্ত। নামখানা ব্লকের পূর্ব দিকে গোবদিয়া ও সপ্তমুখী নদীর সংযোগের কাছে রয়েছে চুনপিড়ি অরণ্য। এখানে একসময় অনেক হরিণ ও বন্য শূকর পাওয়া যেত।

আমার শৈশবে প্রায়শই শুনতাম চুনপিড়ি জঙ্গল থেকে হরিণ শিকার করে এনে তার মাংস চড়া দামে বিক্রি হয়। এই জঙ্গল থেকে বুনো শুকর ও বুনো মোরগও শিকার করে আনা হত। আমাদের এই অঞ্চলে যারা কুস্তে বা ছেন্যার জন্য ঝাঁপি গাছের পাতা সংগ্রহ করত তারা প্রধানত এই জঙ্গলেই যেত। বর্তমানে এই জঙ্গলে হরিণ বা শূকর আর কিছুই নেই। বন সংরক্ষণ আইনের কড়াকড়িতে চুনপিড়ি জঙ্গলের মধ্যে মানুষের যাতায়াতও অনেক কমেছে। ফলে এই জঙ্গলের হাল কিছুটা হলেও ফিরেছে। উপগ্রহ চিত্রে তা ধরা পড়েছে। কিন্তু যে প্রাণীগুলো চিরতরে হারিয়ে গেল তারা আর কখনওই ফিরে আসবে না।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content