শনিবার ৬ জুলাই, ২০২৪


মাথার পেছন দিকে মুখোশ পরে মধু সংগ্রহরত মৌলেরা। ছবি: সংগৃহীত।

বিশ শতকের গোড়ায় সারা ভারতে বাঘের সংখ্যা ছিল আনুমানিক চল্লিশ হাজার। ১৯৭২ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন চালু হওয়ার সময় গণনা করে দেখা গিয়েছিল সারাদেশে বাঘের সংখ্যা কমে হয়েছে মাত্র ১৮২৭। বলাবাহুল্য তখন বাঘের পায়ের ছাপ দেখে বাঘ গণনা করা হত। এই প্রকার গণনায় ত্রুটির সম্ভাবনা থাকে যথেষ্ট বেশি। দেখা গিয়েছে প্রকৃত বাঘের সংখ্যার থেকে এই ভাবে গণনায় বাঘের সংখ্যা কিছুটা বেশি হয়। সুতরাং ১৯৭২ সালে বাঘের প্রকৃত সংখ্যা যে এর চেয়েও কম ছিল তা প্রায় নিশ্চিত।

সারাদেশে যেখানে বাঘের সংখ্যা বিপুল পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে সুন্দরবনেও তার ব্যতিক্রম হতে পারে না।। ১৯৭৩ সালে ব্যাঘ্র প্রকল্প চালু হওয়ার দশ বছর পর ১৯৮৪ সালে সারা ভারতে বাঘের সংখ্যা বেড়ে হয় প্রায় তিন হাজার পাঁচশো। তবে বর্তমানে জঙ্গলে বাঘেদের চলাচলের পথে ক্যামেরা পেতে ছবি তুলে সেই ছবি বিশ্লেষণ করে বাঘের সংখ্যা গণনা করা হচ্ছে। আর এই পদ্ধতিতে বাঘের প্রায় সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব। ২০২০-২১ সালে সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভে এই পদ্ধতিতে বাঘের সংখ্যা নির্ণয় করা হয়েছে। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প এলাকায় ৭৪টি এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা বনবিভাগ এলাকায় ২২টি অর্থাৎ মোট ৯৬টি বাঘ চিহ্নিত হয়েছে।
ভারতে বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ এলাকায় ৯৬টি বাঘের মধ্যে পুরুষ বাঘের সংখ্যা ৩০টি, স্ত্রী বাঘের সংখ্যা ৫২টি এবং ১৪টি বাঘের কোনও লিঙ্গ নির্ধারিত হয়নি। ব্যাঘ্র প্রকল্প এলাকায় থাকা ৭৪টি বাঘের মধ্যে সজনেখালিতে রয়েছে ১২টি, বসিরহাট রেঞ্জে ১৭টি, জাতীয় উদ্যান পূর্বে ২১টি ও জাতীয় উদ্যান পশ্চিমে ২৪টি। অপরদিকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা বনবিভাগে থাকা ২২টি বাঘের মধ্যে মাতলা রেঞ্জে রয়েছে ৪টি, রায়দিঘি রেঞ্জে ১১টি ও রামগঙ্গা রেঞ্জে ৭টি বাঘ।

ওদিকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের সুন্দরবনে ক্যামেরায় ধরা ছবি অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা ১১৪। অর্থাৎ ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে ক্যামেরায় ধরা ছবি অনুযায়ী রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ২১০। এর মধ্যে অবশ্য বাচ্চা বাঘদের ধরা হয়নি। তবে যেহেতু জঙ্গলের সব জায়গায় যথেষ্ট পরিমাণে ক্যামেরা স্থাপন করা সম্ভব হয়নি তাই এই সংখ্যায় কিছু ত্রুটি থাকা অসম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে মোট বাঘের সংখ্যা কিছু বেশি হতেই পারে। ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সুন্দরবনে জঙ্গলের আয়তন অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা হওয়া উচিত ২০০ এবং ভারতের সুন্দরবনে ১২০ থেকে ১৩০। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে উভয় দেশেই আকাঙ্ক্ষিত সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত বাঘের সংখ্যা অনেকটাই কম রয়েছে। অবশ্য দেখা গিয়েছে কোনও কোনও ব্লকে বাঘের সংখ্যা জঙ্গলের আয়তনের তুলনায় বেশি, আবার কোনও কোনও ব্লকে অনেকটা কম। অর্থাৎ অরণ্যের সর্বত্র বাঘের ঘনত্ব সমান নেই।

হেতাল গাছের বনে বাঘিনী। ছবি: সংগৃহীত।

বাঘের খাদ্যের লভ্যতার উপর ঘনত্বের হারের এই তারতম্য বলেই বিশেষজ্ঞদের অনুমান। ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় বন্যপ্রাণী সংস্থা রাজ্যের বন বিভাগকে জানায় যে বাঘ বসবাসের প্রতিকূল ব্লকগুলিতে যেখানে প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় তিন থেকে পাঁচটি বাঘ থাকার কথা সেখানে তার চেয়ে বেশি সংখ্যায় বাঘ রয়েছে। ফলে বাঘেদের মধ্যে অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বয়স্ক ও দুর্বল বাঘেরা সহজে শিকার ধরার লক্ষ্যে নদী পেরিয়ে স্থানীয় লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। লোকালয়ে হানা দেওয়া বাঘ খাঁচা পেতে বা ঘুম পাড়ানি গুলি ছুঁড়ে ধরার পর সেগুলিকে জঙ্গলে ছেড়ে আসা হয়। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বন্যপ্রাণী সংস্থা রাজ্য বনবিভাগ কে পরামর্শ দিয়েছে যে যেসব ব্লকে বাঘের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম সেখানে যেন ধরা পড়া বাঘেদের ছেড়ে আসা হয়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪০: স্বভাবে অনন্য সুন্দরবনের বাঘ

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৩: ত্রিপুরার সমৃদ্ধিতে রাজা বিজয় মাণিক্যের ভূমিকা অপরিসীম

বাঘ ও মানুষের সংঘাতের মূল কারণ নিহিত রয়েছে সুন্দরবনের মানুষের আর্থিক অবস্থার উপর। প্রাকৃতিক কারণেই সুন্দরবনের জমি অনুর্বর। মানুষের মাথাপিছু গড় আয় সারা রাজ্য বা দেশের তুলনায় অনেক কম। বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রতিবেদন অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের একজন অধিবাসীর দৈনিক গড় আয় যেখানে ৩৪২ টাকা, একজন ভারতবাসীর ২৭০ টাকা, সেখানে একজন সুন্দরবনবাসীর দৈনিক গড় আয় মাত্র ৭৫ টাকা। আবার সুন্দরবনে তপশিলি জাতি ও উপজাতি মানুষের সংখ্যা সারা রাজ্যের তুলনায় শতাংশের বিচারে অনেক বেশি। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী রাজ্যে তপশিলী জাতি ও উপজাতিভুক্ত মানুষের সংখ্যা যেখানে মোট জনসংখ্যার ২৯.৩১ শতাংশ সেখানে সুন্দরবনে ৪১.৩২ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই সুন্দরবনের অসংখ্য মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে জেলে, মউলে ও কাঠুরের মতো বিপজ্জনক জীবিকা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। জলে কুমির আর ডাঙ্গায় বাঘ—এই দুই শত্রুর সাথে লড়াই করে তাদের বাঁচতে হচ্ছে। বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কাঠুরে, মৌলে ও জেলেরা আশির দশকে ফাইবার গ্লাসের শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করা শুরু করে।

সুন্দরবনের জঙ্গলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গোলপাতা সংগ্রহ। ছবি: সংগৃহীত।

এই শিরস্ত্রাণ মাথা ও ঘাড়কে বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম। কিন্তু এই শিরস্ত্রাণ পরলে প্রচণ্ড গরম লাগত এবং ব্যবহারকারীর অস্বস্তি হত। তাই বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচার এই উপায় জনপ্রিয় হল না। পরবর্তীতে গ্রহণ করা হল আর এক ব্যবস্থা। জেলে, মৌলে ও কাঠুরেদের মাটির মূর্তি তৈরি করে জঙ্গলে ও নৌকোয় রাখা হল। তারপর ওই মূর্তির গলায় জড়িয়ে দেওয়া হল বিদ্যুতের তার। ১২ ভোল্টের ব্যাটারি থেকে প্রবাহিত করা হল বিদ্যুৎ। যেহেতু মাটির মূর্তি দিয়ে বাঘকে বোকা বানানো সম্ভব নয় তাই জেলে মৌলে ও কাঠুরেদের ব্যবহৃত জামাকাপড় পরানো হল মাটির মূর্তিতে। এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল, যদি বাঘ মাটির মূর্তি আক্রমণ করে তবে বিদ্যুতের শক খাবে।

তবে এই সামান্য শকে বাঘের কোন ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। বাঘ কেবল ভয় পাবে আর শক খাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে মানুষকে আক্রমণ করতে ভয় পাবে। ১৯৮৩ সালের জুন মাসে এই পরীক্ষাটি প্রথম সফল হল। একটি বাঘ নৌকোয় রাখা বিদ্যুতের তার জড়ানো একটি মূর্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তড়িতাহত হল। নেতিধোপানি ও সুধন্যখালিতে অনুরূপ পরীক্ষা করে সাফল্য এল। তবে পরবর্তীকালে এই প্রকার ব্যবস্থা করা বাস্তবিক সমস্যাজনক। তাছাড়া এভাবে বাঘেদের সবসময় বোকা বানানো সম্ভব নয়। ফলে এই ব্যবস্থাও জনপ্রিয় হয়নি।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫০: অর্ধশতাব্দী ছুঁলো ‘অমানুষ’

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৯: অনেক যতনে ‘বড়দিদি’-র পর্ব রাখিনু সেথা

পরবর্তী সময়ে মানুষের মুখোশ ব্যবহার করা শুরু হয়। জেলে, মৌলে ও কাঠুরেরা জঙ্গলে বা খাঁড়িতে প্রবেশ করার সময় মাথার পেছনে মানুষের মুখোশ পরে নেয়। ফলে বাঘ বিভ্রান্ত হয়। বাঘ আক্রমণ করে পিছন দিক থেকে। তাই মুখোশ পরলে বাঘ বুঝতে পারে না কোন দিকে মানুষের পিছন। এই ব্যবস্থাটি বেশ কার্যকরী এবং ব্যয়বহুল নয়। ফলে মুখোশের ব্যবহার জেলে, মৌলে ও কাঠুরেদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়। সমীক্ষায় দেখা যায় ১৯৮৩-৮৪ সালের আগে সাত বছরে যেখানে গড়ে ৪৫ জন বাঘের আক্রমণে মারা যেত সেখানে পরের ছয় বছরে সংখ্যাটা কমে হয় ৩১।

জঙ্গলে ও খাঁড়িতে প্রবেশকারী মানুষের উপর বাঘের আক্রমণ বিষয়ে ৭০ ও ৮০-র দশকে এক সমীক্ষায় দেখা যায় বাঘের আক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয় সকাল সাতটা থেকে ন’টার মধ্যে, বিকেল তিনটে থেকে পাঁচটার মধ্যে এবং রাত এগারোটা নাগাদ। আশি শতাংশ ক্ষেত্রে বাঘ নৌকোয় থাকা মানুষকে আক্রমণ করে। আবার সবচেয়ে বেশি আক্রমণ হয় মে মাসে এবং সবচেয়ে কম আক্রমণ হয় ডিসেম্বর মাসে। যেহেতু এপ্রিল-মে মাসে জঙ্গলে সবথেকে বেশি মধু সংগৃহীত হয় তাই মৌলেরা এই সময়ে জঙ্গলে বেশি যায় ও বাঘের শিকারে পরিণত হয়। তবে মোটের উপর সুন্দরবনের জঙ্গলে সবচেয়ে বেশি মানুষ মানুষ প্রবেশ করে ডিসেম্বর মাসে।
সুন্দরবনের জঙ্গলজীবীরা মূলত চারটি কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গলে যায়।
প্রথমত: জেলেরা যায় জঙ্গলের মধ্যে সংকীর্ণ খাঁড়িগুলিতে মাছ ও কাঁকড়া ধরার জন্য।
দ্বিতীয়ত: এপ্রিল-মে মাসে মধু সংগ্রহের জন্য।
তৃতীয়ত: বন বিভাগের অনুমতিপত্র নিয়ে চিহ্নিত এলাকায় কাঠ কাটার জন্য।
চতুর্থত: হেতাল ও গোলপাতা সংগ্রহের জন্য। সাধারণত হেতালের জঙ্গলে বাঘিনীরা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে থাকে। ফলে মানুষের অনধিকার প্রবেশে বাঘিনী বিরক্ত হয় ও আক্রমণ করে। বাঘিনীর সঙ্গে থাকা ব্যাঘ্র শাবকরা এই দৃশ্য দেখে পরবর্তী সময়ে মানুষখেকো হয়ে উঠতে পারে।

লোকালয়ে হানা দিয়ে ধরা পড়া বাঘকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে সুন্দরবনে। ছবি: সংগৃহীত।

জঙ্গলে খাদ্যের অভাব থাকলেই বাঘ পেটের টানে মানুষকে আক্রমণ করে। মানুষ কখনওই বাঘের স্বাভাবিক খাদ্য নয়, কিন্তু সবচেয়ে সহজ শিকার। ঘন জঙ্গলের মধ্যে কিংবা গোঁজের মত বেরিয়ে থাকা শ্বাসমূলের ওপর দিয়ে দৌড়ে শিকার ধরা বাঘের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ। আর খাদ্যাভাব থাকলে তো কথাই নেই। তখন যদি বাঘ খাঁড়িতে মানুষের সন্ধান পায় তাহলে সুযোগ বুঝে সে মানুষকে তুলে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে কোর এলাকায় শূকর বা হরিণ বেশি পরিমাণে ছেড়ে দিলে বাঘের মানুষকে আক্রমণের সংখ্যা কমানো যেতে পারে। ১৯৮১ সালে সজনেখালি অভয়ারণ্যে শূকর ছেড়ে দিয়ে বাঘের মানুষ আক্রমণের সংখ্যা অনেকটা কমানো সম্ভব হয়েছিল।

এ বার আসা যাক লোকালয়ে বাঘের আক্রমণ প্রসঙ্গে। বাঘ তার স্বাভাবিক বাসস্থান জঙ্গল ছেড়ে নদী সাঁতরে সম্পূর্ণভাবে জীবনের প্রবল ঝুঁকি নিয়ে কেন আসবে লোকালয়ে? এর পেছনে রয়েছে একমাত্র কারণ শিকারের অভাব। পেটে টান পড়লে বাঁচার তাগিদে বাঘকে ঝুঁকি নিতেই হয়। আর বাঘের বয়স বাড়লে তার স্বাভাবিক শিকার ধরার ক্ষমতা হ্রাস পায়। লোকালয়ে গোরু-ছাগল ইত্যাদি শিকার করা খুব সহজ। তাই বাধ্য হয়ে তারা লোকালয়ে আসে। লোকালয়ে বাঘের আক্রমণ কমাতে হলে যেমন জঙ্গলে তার স্বাভাবিক শিকার হরিণ ও শূকরের সংখ্যা বাড়াতে হবে, ঠিক তেমনি জঙ্গল সংলগ্ন লোকালয়গুলি জাল দিয়ে ঘিরে দেওয়া প্রয়োজন। বনভূমি হ্রাসের সাথে বাঘ ও মানুষের সংঘাত যথেষ্ট সংগতিপূর্ণ।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৬: কল্যাণী—অন্দরমহলের সরস্বতী

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৪: রাজনীতিতে, যুগান্তরেও স্বার্থচিন্তার আবহমান প্রভাব

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় সুন্দরবন অংশে ২০২১ সালে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বিস্তার ২১১৪ বর্গ কিলোমিটার। কিন্তু সমীক্ষায় উঠে এসেছে আরও একটি তথ্য যা হতাশাব্যঞ্জক। সেটি হল ২০০৫ সালের তুলনায় ২০১১ সালে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের আয়তন বৃদ্ধি পেলেও ২০১৩ সাল থেকে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের আয়তন দ্রুত কমছে। ২০১৯ সালে সামান্য একটু বৃদ্ধি পেলেও পরবর্তী বছরগুলোতে ক্রমশ কমছে। এর মধ্যে বুলবুল, আমফান, ইয়াস ইত্যাদির মতো বিধ্বংসী সাইক্লোনের প্রভাব যদিও সুন্দরবনের ওপর পড়েছিল তবুও ম্যানগ্রোভ অরণ্যের হ্রাস পরিবেশবিদদের যথেষ্ট বিচলিত করে তুলেছে।

সুন্দরবনের মৎস্যজীবীরা বাঘের শিকার হয় সবচেয়ে বেশি। ছবি: সংগৃহীত।

সমীক্ষায় প্রকাশ, ২০০৫ সালের তুলনায় ২০২০ সালে বনভূমি কমেছে ২.৯৩ শতাংশ, কিন্তু মানুষের বসতি বেড়েছে ২৬.৬৩ শতাংশ। আবার অরণ্যহীন ও মনুষ্যবসতিহীন এলাকা বেড়েছে ৩৪.৭১ শতাংশ। (সূত্রঃ Trees, Forest and People Magazine, দ্বাদশ সংখ্যা, ২০২৩) অন্যদিকে সুন্দরবনে কোনও গুরুত্বপূর্ণ শিল্প গড়ে ওঠেনি। কাজের সুযোগ ক্রমাগত কমছে। বেকারি বাড়ছে। জল নিকাশি ব্যবস্থাও ক্রমশ ভেঙে পড়ছে। নোনা জলের প্লাবন বাড়ছে। প্রত্যন্ত দ্বীপগুলোতে এখনও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ইত্যাদির মত জরুরি পরিষেবাগুলি ঠিকমতো পৌঁছয়নি। স্বাভাবিকভাবেই ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ওপর এইসব অঞ্চলের মানুষের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। চাপ পড়ছে অরণ্যের উপর।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৮: অভিভাবিকা মা সারদা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫১: বিয়েশাদির ঠাকুরবাড়ি

অন্যদিকে বাঘের খাদ্যাভাব, মিষ্টি জলের অভাব ও বনাঞ্চল হ্রাস বাঘকে বাধ্য করছে মানুষের এলাকায় প্রবেশ করতে। বস্তুতঃ মানুষ ও বাঘ উভয়ের বেঁচে থাকার সংগ্রাম বাধ্য করছে একে অপরের সীমানায় প্রবেশ করতে। ফলতঃ বাঘের সাথে মানুষের সংঘাতও বাড়ছে। আমফান ও ইয়াসের পর এই সংঘাতের পরিমাণ বেড়েছে। গোসাবা, কুলতলি, বাসন্তী ও পাথরপ্রতিমা ব্লকে এই সংঘাত বেড়েছে অনেক বেশি। আর যে সব মানুষ বাঘের শিকারে পরিণত হয়েছে তাদের অধিকাংশই মৎস্যজীবী।

মনে রাখতে হবে, মানুষ বাঘের স্বাভাবিক শিকার নয়। আর বাঘ সাধ করে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের এলাকায় আসে না। তাই সুন্দরবনের মানুষ ও বাঘের জীবনধারণের সমস্যা যতক্ষণ না মেটানো যাবে ততক্ষণ বাঘে-মানুষে এই সংঘাত মেটানো যাবে না।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content