(বাঁদিকে) রোদ পোহাচ্ছে পানকৌড়ি। (ডান দিকে) ছোট পানকৌড়ি। ছবি: সংগৃহীত।
ছোটবেলায় স্কুলে পড়েছিলাম সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা ‘দূরের পাল্লা’। ছড়াটি এখনও মনে গেঁথে আছে। ছিপখান তিন দাঁড় তিনজন মাল্লা—শৈশবে ছড়াটি পড়তে পড়তেই মনে হয় সব বাঙালির মনের পটে গ্রাম বাংলার দৃশ্য ভেসে উঠত। আজও যখন ছড়াটি গুনগুন করি, মনের মধ্যে শৈশবে ফেলে আসা গ্রামের দৃশ্য গুলোকে স্পষ্ট দেখতে পাই। ছড়াটির একটি স্তবক ছিল—
চুপ চুপ ওই ডুব দেয় পানকৌটি
দেয় ডুব টুপ টুপ ঘোমটার বউটি।
পানকৌটির জলে ডুব দেওয়ার সঙ্গে গ্রামের বউদের পুকুরে ডুব দেওয়ার দৃশ্যের এক অদ্ভুত মিল পেয়েছিলেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ। আর গ্রামীণ সুন্দরবন অঞ্চলে যারা এখনও বসবাস করেন তাঁদের কাছে এই দুই দৃশ্য এখনও অপরিচিত নয়।
দেয় ডুব টুপ টুপ ঘোমটার বউটি।
পানকৌটির জলে ডুব দেওয়ার সঙ্গে গ্রামের বউদের পুকুরে ডুব দেওয়ার দৃশ্যের এক অদ্ভুত মিল পেয়েছিলেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ। আর গ্রামীণ সুন্দরবন অঞ্চলে যারা এখনও বসবাস করেন তাঁদের কাছে এই দুই দৃশ্য এখনও অপরিচিত নয়।
সুন্দরবন অঞ্চলের অধিবাসীদের পানকৌটি বা পানকৌড়ির সঙ্গে পরিচয় আদি ও অকৃত্রিম। আর তাই পানকৌড়িকে নিয়ে সুন্দরবন অঞ্চলে রয়েছে নানা গল্প-গাথা। তেমনই এক গল্প হল—কোনও এক গ্রামে এক বউ ছিল বেজায় কালো এবং দেখতেও সুশ্রী নয়। তার গলাও ছিল বেশ লম্বা। এই কারণে তার স্বামী ও শাশুড়ি কেউ ভালোবাসত না। এ নিয়ে বউটির মনে ছিল ভারি দুঃখ।
বউটি মাছ খেতে খুব ভালোবাসত। কিন্তু তার শাশুড়ি তাকে মাছ খেতে দিত না। একদিন বাড়িতে মাছের সুস্বাদু পদ রান্না হয়েছিল। বউটির ভীষণ ইচ্ছে করছিল মাছ খেতে। কিন্তু শাশুড়ি তাকে মাছ দিল না। তখন মনের দুঃখে বউটি জলে ডুবে আত্মহত্যা করল। মরার পর বউটি জলদেবীর আশীর্বাদে পানকৌড়ি পাখিতে রূপান্তরিত হল এবং মনের সুখে যাতে মাছ খেতে পারে তেমন বর পেল। যেহেতু বউটি ছিল কালো এবং তার গলা ছিল লম্বা তাই পানকৌড়ি পাখির রঙ হল কালো এবং গলা হল লম্বা। আর মনের সুখে সে জলে ডুবে মাছ খেতে পারে।
বউটি মাছ খেতে খুব ভালোবাসত। কিন্তু তার শাশুড়ি তাকে মাছ খেতে দিত না। একদিন বাড়িতে মাছের সুস্বাদু পদ রান্না হয়েছিল। বউটির ভীষণ ইচ্ছে করছিল মাছ খেতে। কিন্তু শাশুড়ি তাকে মাছ দিল না। তখন মনের দুঃখে বউটি জলে ডুবে আত্মহত্যা করল। মরার পর বউটি জলদেবীর আশীর্বাদে পানকৌড়ি পাখিতে রূপান্তরিত হল এবং মনের সুখে যাতে মাছ খেতে পারে তেমন বর পেল। যেহেতু বউটি ছিল কালো এবং তার গলা ছিল লম্বা তাই পানকৌড়ি পাখির রঙ হল কালো এবং গলা হল লম্বা। আর মনের সুখে সে জলে ডুবে মাছ খেতে পারে।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— মান্দা ও বড় মান্দা
বাংলা বুকের ভিতরে
পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৩৫ টি প্রজাতির পানকৌড়ি থাকলেও ভারতে তিনটি প্রজাতির পানকৌড়ি দেখা যায়। একটি হল বড় পানকৌড়ি বা Large Cormorant (Phalacrocorax carbo), একটি হল ভারতীয় শ্যাগ (Shag) (Phalacrocorax fuscicollis) এবং অপরটি হল ছোট পানকৌড়ি বা Little cormorant (Phalacrocorax niger)। সুন্দরবন অঞ্চলে এই ছোট পানকৌড়ি দেখা যায়। ছোট পানকৌড়ির আকার দাঁড়কাকের মতো বা সামান্য বড়। গায়ের রং কুচকুচে কালো। লেজের গড়ন লম্বাটে ও শক্ত। এদের গলায় সাদা রংয়ের সামান্য ছোপ থাকে আর মাথার পেছনদিকে সামান্য ঝুঁটি উঁকি মারে। এদের চোখের রং হয় সবুজ। ওজন হয় ৩৬০ থেকে ৫২০ গ্রাম, আর বাঁচে ৮ থেকে ৯ বছর। এদের পা হয় ছোট, আর পায়ের আঙুল হয় হাঁসের পায়ের আঙুলের মতো সাঁতার কাটার উপযোগী। এদের ঘাড় ও ঠোঁট হয় বেশ শক্ত। আবার উপরের ঠোঁট হয় সামান্য বাঁকা।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার
সুন্দরবনের গ্রামাঞ্চলে পুকুর খাল বিল ঝিল ও জলাভূমিতে এদের হামেশাই দেখতে পাওয়া যায়, জলাশয়ের পাশে কোন বড় গাছে ডালে বা কোনও শুকনো গাছ থাকলে তার ওপরে অনেকগুলি পানকৌড়িকে বসে থাকতে দেখা যায় কখনও কখনও একটি পানকৌড়ি কেউ দেখা যায়। যে সব গাছের শাখা জলের ওপর নুয়ে পড়েছে তার ওপর বসতে এরা সবচেয়ে পছন্দ করে আবার জলাশয় থেকে কোন খুঁটি যদি জলের ওপরে উঠে থাকে তার ওপরে বসতেও পছন্দ করে।
ভোজন পর্ব শেষ হলে এরা ওই গাছের ডালে বা খুঁটির ওপর বসে দুদিকে ডানা মেলে রোদ পোহায়। মাছ ধরার ব্যাপারে এদের দক্ষতা প্রশ্নাতিত। ডাঙ্গায় মাছ পড়ে থাকলেও এরা সে মাছ ছোঁয় না। জলে ডুবেই এরা মাছ ধরে। জলের নিচে ২ মিটার পর্যন্ত এরা স্পষ্ট দেখতে পায়। আর একবার ডুব দিয়ে প্রায় এক মিনিট জলের নিচে থাকতে পারে। কখনও কখনও এদের দল বেঁধে একসঙ্গে মৎস্য শিকার করতে দেখা যায়। তখন ওরা সবাই মিলে মাছের ঝাঁককে ঘিরে ফেলে। তারপর টপাটপ ডুব দিতে থাকে।
ভোজন পর্ব শেষ হলে এরা ওই গাছের ডালে বা খুঁটির ওপর বসে দুদিকে ডানা মেলে রোদ পোহায়। মাছ ধরার ব্যাপারে এদের দক্ষতা প্রশ্নাতিত। ডাঙ্গায় মাছ পড়ে থাকলেও এরা সে মাছ ছোঁয় না। জলে ডুবেই এরা মাছ ধরে। জলের নিচে ২ মিটার পর্যন্ত এরা স্পষ্ট দেখতে পায়। আর একবার ডুব দিয়ে প্রায় এক মিনিট জলের নিচে থাকতে পারে। কখনও কখনও এদের দল বেঁধে একসঙ্গে মৎস্য শিকার করতে দেখা যায়। তখন ওরা সবাই মিলে মাছের ঝাঁককে ঘিরে ফেলে। তারপর টপাটপ ডুব দিতে থাকে।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
মুভি রিভিউ: স্ত্রী-২ ছবিতে স্কন্দকাটা দৈত্য আক্রমণ করছে আধুনিক নারীদের
মাছ ধরে খাওয়ার কৌশলটাও ভারি অদ্ভুত। একটা মাছকে আড়াআড়ি দুই ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরে জলের ওপরে উঠে আসে। তারপর মাছটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দেয়। মাছটা যখন নিচের দিকে মাথা করে পড়তে থাকে তখন ক্রিকেটের ক্যাচ ধরার মতো হাঁ করে মাছটিকে মুখের মধ্যে টপ করে গিলে নেয়। এদের খিদেও প্রচুর। অনেকক্ষণ ধরেই এরা ভোজন পর্ব চালায়। অনেক সময় বেশ বড় আকারের মাছও ওদের উদরে চালান হয়। পানকৌড়িরা সাধারণত জলাশয়ের ধারে শুকনো পাতা, শেকড় ও কাঠি দিয়ে কোনও গাছের ওপর অল্প গভীরতাযুক্ত একটা অগোছালো বাসা বানায়। দেখে অনেক সময় কাকের বাসা বলে ভ্রম হয়। যেসব গাছে বকেদের বাস এরা সেখানেই থাকতে ভালোবাসে।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
এদের প্রজনন কাল এপ্রিল থেকে জুলাই মাসের মধ্যে অর্থাৎ বর্ষাকাল। পরপর কয়েক বছর একই জায়গায় এরা বাসা বাঁধে। একটা বাসা বাঁধতে এরা চার থেকে ছয় দিন সময় নেয়। একটা স্ত্রী পানকৌড়ি এক এক বারে দুই থেকে ছটি সাদা রঙের ডিম পাড়ে। স্ত্রী ও পুরুষ পানকৌড়ি উভয়েই পালা করে ডিমে তা দেয়। ১৫ থেকে ২১ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোয়।
এই সময় মা ও বাবা পানকৌড়ি জলাশয় থেকে মাছ ধরে এনে বাচ্চার মুখে উগরে দেয়। বাচ্চাদের ডানা গজানোর পর ওরা ধীরে ধীরে উড়তে শেখে। আর তারপর মা ও বাবা পানকৌড়ি মিলে বাচ্চাদের জলে ডুব দিয়ে মাছ ধরতে প্রশিক্ষণ দেয়। স্ত্রী ও পুরুষ পানকৌড়ি দেখতে প্রায় একই রকম, আর সচরাচর এদের কোনও ডাক শোনা যায় না। তবে বাসা বাঁধার সময় ওদের অনেকটা কাশির শব্দের মত মৃদু শব্দ করতে শোনা যায়। অনেক সময় ওদের ঠোঁট দিয়ে খট খট শব্দ করতেও শোনা যায়। দরজায় টোকা দেওয়ার মতো এমন খট খট শব্দ আমি শুনেছি কয়েকবার।
এই সময় মা ও বাবা পানকৌড়ি জলাশয় থেকে মাছ ধরে এনে বাচ্চার মুখে উগরে দেয়। বাচ্চাদের ডানা গজানোর পর ওরা ধীরে ধীরে উড়তে শেখে। আর তারপর মা ও বাবা পানকৌড়ি মিলে বাচ্চাদের জলে ডুব দিয়ে মাছ ধরতে প্রশিক্ষণ দেয়। স্ত্রী ও পুরুষ পানকৌড়ি দেখতে প্রায় একই রকম, আর সচরাচর এদের কোনও ডাক শোনা যায় না। তবে বাসা বাঁধার সময় ওদের অনেকটা কাশির শব্দের মত মৃদু শব্দ করতে শোনা যায়। অনেক সময় ওদের ঠোঁট দিয়ে খট খট শব্দ করতেও শোনা যায়। দরজায় টোকা দেওয়ার মতো এমন খট খট শব্দ আমি শুনেছি কয়েকবার।
(বাঁদিকে) পানকৌড়ির মাছ শিকার। (ডান দিকে) বাঁশঝাড়ে বকের সঙ্গে পানকৌড়িদের সহাবস্থান। ছবি: সংগৃহীত।
পানকৌড়ি কিন্তু বর্তমানে খুবই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। আগে যে পরিমাণ পানকৌড়ি সুন্দরবন অঞ্চলে বিভিন্ন জলাশয়ে দেখা যেত এখন আর তেমনটি দেখা যায় না। এর অন্যতম কারণ জলাভূমি ভরাট করার ফলে জলাভূমির সংখ্যা হ্রাস। তাছাড়া জলাভূমিকে ঘিরে থাকা বড় বড় গাছের সংখ্যাও কমেছে। এরা সাধারণত তেঁতুল, জাম, আম, ইত্যাদি গাছে বাসা বাঁধতে পছন্দ করে। জলাশয়ের পাড়ে এইসব গাছের সংখ্যা কমেছে। আবার কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে মাছের মধ্যে সেই কীটনাশক জীববিবর্ধনের মাধ্যম সঞ্চিত হচ্ছে এবং মাছের থেকে শীর্ষ খাদক পানকৌড়ির মধ্যে তা সঞ্চিত হচ্ছে।
ফলে ওরা প্রজনন ক্ষমতা হারাচ্ছে এবং রোগাক্রান্ত হচ্ছে। সেই সঙ্গে আজকাল পানকৌড়িদের থেকে মাছকে রক্ষা করার জন্য পুকুরের ওপরে নাইলনের জাল ঘিরে দেওয়া হচ্ছে। সরু সুতো দিয়ে বোনা সেই জাল দূর থেকে এরা বুঝতে পারছে না। ফলে জলে ঝাঁপ দিতে গিয়ে জালে আটকে অকালমৃত্যু ঘটছে। বিভিন্ন ফিসারিতে আজকাল প্রচুর সংখ্যক পানকৌড়ি কে এভাবে মৃত্যুবরণ করতে দেখা যাচ্ছে। আর তাই পানকৌড়িদের ভবিষ্যৎ মোটেই সুরক্ষিত নয়। এভাবেই যদি চলতে থাকে জীবজগতের এই অসাধারণ সদস্যটিকে ভবিষ্যতে সুন্দরবনে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।—চলবে।
ফলে ওরা প্রজনন ক্ষমতা হারাচ্ছে এবং রোগাক্রান্ত হচ্ছে। সেই সঙ্গে আজকাল পানকৌড়িদের থেকে মাছকে রক্ষা করার জন্য পুকুরের ওপরে নাইলনের জাল ঘিরে দেওয়া হচ্ছে। সরু সুতো দিয়ে বোনা সেই জাল দূর থেকে এরা বুঝতে পারছে না। ফলে জলে ঝাঁপ দিতে গিয়ে জালে আটকে অকালমৃত্যু ঘটছে। বিভিন্ন ফিসারিতে আজকাল প্রচুর সংখ্যক পানকৌড়ি কে এভাবে মৃত্যুবরণ করতে দেখা যাচ্ছে। আর তাই পানকৌড়িদের ভবিষ্যৎ মোটেই সুরক্ষিত নয়। এভাবেই যদি চলতে থাকে জীবজগতের এই অসাধারণ সদস্যটিকে ভবিষ্যতে সুন্দরবনে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।