মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিকে) রামবাণ ফল। (মাঝখানে) রামবান গাছ। (ডান দিকে) রামবান গাছ ফল-সহ। ছবি: সংগৃহীত।

 

রামবাণ (Wissadula periplocifolia)

ছোট থেকেই আমাদের গ্রামের বাড়ির বাস্তুজমির এদিকে ওদিকে তিন-চার ফুট লম্বা এক প্রকার গুল্ম জাতীয় গাছ প্রায়শই জন্মাতে দেখতাম। বাড়ির বড়দের কাছ থেকে জেনেছি এর নাম রামবাণ। কিন্তু কেন এর নাম রামবাণ তা জানতাম না। ছোটবেলায় তা জানার চেষ্টা করেছি বলেও মনে পড়ে না। তবে গাছটি ছিল আমার খুব পছন্দের গাছ। এর ফল ছিল আমার খুব প্রিয়। অদ্ভুত আকার রামবাণ ফলের। দেখলে মনে হবে শিঙাড়া। সিঙ্গাড়ায় তিনটে শিং থাকে, আর রামবাণের ফলে পাঁচটা শিং। ছোটবেলায় এই ফলগুলো নিয়ে সিঙ্গাড়া বানিয়ে খেলতাম। ফলগুলো কাঁচা অবস্থায় সবুজ। সামান্য চাপ দিলে ভেতরে সাদা রংয়ের বীজ দেখতে পেতাম। পেকে গেলে ফলগুলো পাঁচটা খণ্ডে ফেটে যেত। তখন ভেতর থেকে কালো বীজগুলো ছড়িয়ে পড়ত আশেপাশে।

প্রায় আটত্রিশ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে পড়ার সুবাদে একবার এই গাছের কাণ্ডের কিছুটা অংশ আমার শ্রদ্ধেয় স্যার প্রফেসর গৌরগোপাল মাইতি মহাশয়কে দেখালাম। উনি দেখে বেশ বিস্মিত হলেন। বললেন, কোথায় পেলে এ গাছ? বললাম, আমাদের বাড়িতে আশেপাশে প্রচুর জন্মায়, ঝোপ হয়ে থাকে। স্যার জানতে চাইলেন, আমার বাড়ি কোথায়। বললাম, সুন্দরবন অঞ্চলের মধ্যে কাকদ্বীপে। সব শুনে স্যার বললেন, ওই অঞ্চলে এই গাছ পাওয়া যায়। এ হল একপ্রকার ম্যানগ্রোভ সহযোগী গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। গাছটি ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলে কোথাও কোথাও পাওয়া যায়। আর এটি সম্ভবত শ্রীলঙ্কা থেকে ভারতবর্ষে এসেছে। এই গাছটি আদৌ ভারত বা এশিয়ার স্বাভাবিক উদ্ভিদ নয়। এর আদি বাসভূমি ক্রান্তীয় আমেরিকা।

ব্রাজিল মেক্সিকো ও আমেরিকার টেক্সাস প্রদেশ এই অঞ্চলের মধ্যে এর আদি বাসভূমি। আর এই গাছটিও ঢেঁড়স, জবা ইত্যাদি গাছের সাথে একই পরিবারভুক্ত। অনেকে এই গাছকে বাণভস্ম নামেও ডাকে। স্যারের কাছ থেকেই জেনেছিলাম যে এই গাছের বাকল থেকে পাটের মতো না হলেও মোটামুটি উৎকৃষ্টমানের তন্তু পাওয়া যায়। স্যারের কাছ থেকে এসব শোনার পর রামবাণ বা বাণভস্ম নামের একটা অর্থ খোঁজার চেষ্টা করলাম। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে রামায়ণের রামচন্দ্রের সম্পর্ক সবার জানা। আর সুন্দরবন অঞ্চলে এর আগমন শ্রীলঙ্কা থেকে। সুতরাং গাছটির নাম রামের নামে হওয়ার পেছনে যুক্তি থাকছে। রামবাণ গাছের পাতার আকার বাণ বা তীরের ফলার মতো। সুতরাং এই গাছের বাংলা নাম রামবাণ হওয়ার পেছনে আমার এই যুক্তি মনে হয় একেবারে অমূলক নয়। তবে ভস্ম কথাটা কোনও বিশেষ অর্থ বহন করছে কিনা জানা নেই। গাছটির ছাই অর্থাৎ ভস্ম কি কোনও লৌকিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হত?
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৩: বেলুড়মঠে শ্রীমায়ের অভিনন্দন

রামবাণ গাছ প্রায় ৪-৫ ফুট লম্বা হয়। প্রতিটি গাছে শাখাপ্রশাখা তৈরি হয়ে মাঝারি আকারের ঝোপে পরিণত হয়। কান্ড ও পাতায় সূক্ষ্ম রোম থাকে। পাতার আকার তিন কোণা, আর আগার দিক খুব সূচালো, তীরের ফলার মতো। পাতার কক্ষ থেকে সাদা বা হালকা হলুদ রঙের ফুল ফোটে। ফুলের আকার অনেকটা পেয়ালার মতো। ফুল ও ফলের বৃন্ত বেশ লম্বা হয়। কাঁচা অবস্থায় ফলের রঙ সবুজ আর দেখতে পাঁচটা শিংওয়ালা সিঙাড়ার মতো। পেকে গেলে ফলের রঙ হয় কালো। বীজের গায়েও থাকে সূক্ষ্ম রোম।

সুন্দরবনের যে সব অঞ্চলে জোয়ারের জল পৌঁছোয় সেখানে রামবাণ দেখা যায় না। সাধারণত উঁচু জমি ও রাস্তার পাশে এই গাছ বেশি দেখা যায়। রামবাণ গাছ আমাদের গ্রামের বাড়ির বাস্তুজমিতে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। সুন্দরবনের বসতি এলাকার অন্যত্রও দেখেছি। তাহলে কি প্রাচীন সুন্দরবনের মানুষ এই গাছ থেকে তন্তু নিষ্কাশন করে তা থেকে সুতো বা দড়ি বানাত? প্রাচীনকালে সুন্দরবনের মানুষের কাছে কি তন্তুর উৎস ছিল এই গাছ? সুন্দরবনের লবণাক্ত এলাকায় পাট চাষ ভালোভাবে সম্ভব নয়। পাট চাষের জন্য প্রয়োজন পলি মাটি ও মিষ্টি জল। সুন্দরবনে মিষ্টি জলের অভাব। তাছাড়া পাট চাষের জন্য একটু উঁচু জমি চাই। সুন্দরবনের বেশিরভাগ জমিই নিচু। তাই আমার মনে হয় প্রাচীনকাল থেকে সুন্দরবনে তন্তুর জন্য এই বিদেশাগত প্রজাতি রামবাণ চাষ করা হত।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

বিদেশাগত হলেও রামবাণ সুন্দরবনের মাটিতে সুন্দরভাবে অভিযোজিত হয়েছে। আমি ছোটবেলা থেকে দেখেছি, আমাদের বাড়িতে তো বটেই, গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই থাকত ঢ্যারা। ঢ্যারা ঘুরিয়ে তন্তু পাকানো হত। এভাবেই তন্তু থেকে তৈরি হত দড়ি। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায় অতীতে সুন্দরবনের বসতি এলাকায় মানুষ রামবাণ থেকেই তন্তু সংগ্রহ করত এবং ঢ্যারা ঘুরিয়ে সেই তন্তু থেকে দড়ি বানাত। রামবাণ গাছ উঁচু জমি, আল, বাঁধ সর্বত্র এখনও বহাল তবিয়তেই টিকে আছে, কিন্তু এদের থেকে তন্তু নিষ্কাশনের প্রয়োজনীয়তা আজ ফুরিয়েছে। আর তাই ওরা অবহেলিতভাবে বেঁচে আছে সুন্দরবনের বহু অজানা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ

 

লৌকিক চিকিৎসা

সুন্দরবন অঞ্চলে রামবাণ বর্তমানে কোনও লৌকিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় কিনা জানা যায় না। তবে ২০২৩ সালে ACS Publication (USA) থেকে প্রকাশিত কয়েকজন বাংলাদেশি গবেষকের এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ রয়েছে যে প্রাচীনকালে রামবাণ সর্পদংশন ও মৌমাছির দংশনের চিকিৎসায় স্থানীয় মানুষ ব্যবহার করত। সুন্দরবন যে সর্পসঙ্কুল এলাকা এবং সর্পদংশনে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় তা আজ সবার জানা। আবার সুন্দরবনবাসীর অন্যতম জীবিকা হল জঙ্গল থেকে মধু সংগ্রহ। সেক্ষেত্রে মৌমাছির কম-বেশি দংশন অবধারিত। আর তাই অতীতে সুন্দরবন অঞ্চলে ওষধি হিসেবে রামবাণ পাতার মন্ডের ব্যবহার প্রচলিত থাকাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া যন্ত্রণানাশক হিসেবে ও লিভারের সুরক্ষায় রামবাণ পাতার নির্যাসের ভূমিকা প্রমাণিত হয়েছে।

আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

 

পানি তাঙ্কি (Mimulus orbicularis)

পানি তাঙ্কি নামটা কিন্তু বাংলা নাম নয় বা সুন্দরবনবাসীর দেওয়া নাম নয়। আসলে সুন্দরবনবাসীদের কাছে এই উদ্ভিদটির কোনও স্থানীয় নাম রয়েছে কিনা আমার জানা নেই। আর তাই প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশায় প্রচলিত নামটিকেই এই লেখাতে ব্যবহার করলাম। পানি তাঙ্কি হল বর্ষজীবী ও জলজ ম্যানগ্রোভ সহযোগী উদ্ভিদ। অগভীর ডোবা ও জলাভূমিতে বা বেশিরভাগ সময় নোনা জল জমে থাকে এমন নিচু জমিতে পানি তাঙ্কি জন্মায়। তবে ভারতীয় সুন্দরবনে এই উদ্ভিদ খুব কম দেখা যায়। আইইউসিএন (IUCN) তালিকায় এই উদ্ভিদটি বিপন্ন তালিকাভুক্ত।

(বাঁদিকে) পানি তাঙ্কি জলে ভাসমান অবস্থায়। (মাঝখানে) পানি তাঙ্কি ফুলসহ জলাশয়ে ভাসমান। (ডান দিকে) পানি তাঙ্কি ফুল। ছবি: সংগৃহীত।

জলের উপর এই উদ্ভিদ ভেসে থাকে, যদিও এদের মূল থাকে জলের ধারে ডাঙায় বা অতি অগভীর জলে। ছোটো ছোটো লতানে উদ্ভিদগুলো প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। পাতাগুলো প্রায় গোলাকার, চামচের মতো দেখতে। পাতা বেশ মোটা ও রসালো। প্রতি পর্ব থেকে দুটো করে পাতা পরষ্পর বিপরীতমুখে জন্মায়। পাতার কক্ষ থেকে শাখা ও ফুল জন্মায়। একটা বা দুটো ফুল প্রতি পাতার কক্ষ থেকে জন্মায়। ফুলের রঙ হালকা গোলাপি। আসলে চারটে পাপড়ির মধ্যে বাইরের দিকে তিনটি পাপড়ি নিচের দিকে পরষ্পর যুক্ত এবং রঙ হালকা গোলাপি, কিন্তু ভেতরের দিকে অপেক্ষাকৃত বড়ো একটি পাপড়ির রঙ সাদা আর সেই পাপড়ির মাঝে আছে হলুদ ছোপ। ফুলের সৌন্দর্য এখানেই। এই ফুলকে বানরের মুখ ভ্যাঙানোর মতো দেখায় বলে ইংরেজিতে এই উদ্ভিদকে ‘মাঙ্কি ফ্লাওয়ার প্লান্ট’ (Monkey Flower Plant) বলে। আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ফুল ফোটে। ছোটো ছোটো উপবৃত্তাকার ফলের মধ্যে লালচে বাদামি রঙের বীজ থাকে।
 

লৌকিক চিকিৎসা

যেহেতু এই লতানে উদ্ভিদটি ভারতীয় সুন্দরবনে খুব কম পাওয়া যায় এবং স্থানীয় মানুষের কাছে খুব একটা পরিচিত নয় তাই এর লৌকিক ব্যবহার সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে হোমিওপ্যাথিতে ‘মিমুলাস’ (Mimulus) নামে ঔষধ আছে যা এই পানি তাঙ্কি থেকে প্রস্তুত করা হয়। মন থেকে ভয় দূর করতে ও মানসিক চাপ লাঘব করতে এই ঔষধ ব্যবহৃত হয়।—চলবে।

* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content