বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিকে) হুড়ো ফার্নের ঘন ঝোপ। (মাঝখানে) হুড়ো ফার্নের পাতার নীচে বাদামি রেণুস্থলী। (ডান দিকে) হুড়ো ফার্ন গাছ। ছবি: সংগৃহীত।

 

সুখদর্শন (Crinum defixum)

ছোটবেলা বেশ কয়েক জায়গায় দেখতাম রজনীগন্ধা গাছের পাতার মতো। কিন্তু বেশ বড় আকারের গাছের ঝোপ থেকে রজনীগন্ধার মতই লম্বা স্টিক উঠে আসত আর তার মাথায় সাদা রঙের ফুল ফুটত। ফুলগুলোর অসাধারণ সুগন্ধ। তবে ফুলের কাছাকাছি গেলে গন্ধটা এত তীব্র হয় যে সহ্য করা মুশকিল। আমাদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে খালের পাড়ে ছাড়াও স্কুলে যাওয়ার পথে বেশ কয়েক জায়গায় এই গাছটার ঝাড় দেখতাম। গরু ছাগল এদের খায় না।

একদিন কোদাল দিয়ে খালের পাড়ে গাছটার ঝাড় থেকে দু’একটা গাছ শিকড়সহ তুলতে গিয়ে দেখি মাটির নিচে ঠিক যেন সাদা রঙের পেঁয়াজ। এত সুন্দর ফুল হয় যে গাছে সেই গাছ কেন আমাদের বাগানে নেই? সুতরাং দুটো গাছ কন্দসহ তুলে এনে পুঁতে দিলাম বাগানের এক প্রান্তে। বাবা দেখে বলেছিল, গাছটার নাম সুখদর্শন। নামটা শুনেই গাছটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। ফুল ফুটলে সত্যিই দর্শনলাভে সুখানুভূতি হয়।

এক বছরের মধ্যেই গাছ দুটো বেশ বড় ঝাড়ে পরিণত হল আর সুন্দর ফুল ফোটাও শুরু হয়ে গেল। আমার ঠাকুমা বলেছিল এই গাছ লাগালে ফুলের গন্ধে বাড়িতে সাপ আসে। সত্যি বলতে কি, আমি বিশ্বাস করিনি আর বাস্তবে তা হয়ওনি। তবে ঝাড় দুটো এত দ্রুত বাড়তে শুরু করেছিল যে বেশ কিছু গাছ উপড়ে ফেলে ঝাড়ের আকার ছোট করতে হয়েছিল। ২৯ বছর আগে যখন শিক্ষক হিসেবে স্কুলে যোগদান করলাম তখন স্কুল ভবনের সামনে মাঠের ধারে সেই সুখদর্শনের একটা বড় ঝাড় দেখতে পেলাম। অনাদরে বেড়ে উঠেছে। ফুলও ফুটছে। ভাবতাম এত সুন্দর এই গাছ কেন অনাদরে নানা জায়গায় বেড়ে উঠতে দেখতে পাই। পরে জানলাম, সুখদর্শন হলো একটি ম্যানগ্রোভ সহযোগী উদ্ভিদ। সুতরাং সুন্দরবন অঞ্চলে এই উদ্ভিদের যত্রতত্র উপস্থিতি নিশ্চিতভাবেই সম্ভব।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৭: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে/২

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— দুধি লতা ও পঞ্চরতি লতা

আগেই বলেছি সুখদর্শনের ঝাড় দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং বেশ বড় আকারের হয়। এক একটা গাছ চার পাঁচ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। একবীজপত্রী উদ্ভিদ হলে যেমন হয় তেমনই এর পাতা। যেন রজনীগন্ধা পাতার বৃহৎ সংস্করণ। পাতার ওপরে পুরু মোমের আস্তরণ থাকায় খুব চকচকে। পাতার সবুজ ফলক দুই থেকে তিন সেন্টিমিটার চওড়া হলেও গোড়ার দিকটা ফ্যাকাশে ও প্রসারিত হয়। যেমন পেঁয়াজ কলি মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে আসে ঠিক তেমনই এই ফুলের একটা লম্বা দন্ড মাটি ভেদ করে উপরে উঠে আসে। এর দৈর্ঘ্য হয় ৪৫ থেকে ৭৫ সেন্টিমিটার। এই দন্ডের মাথায় ৬ থেকে ১৫টি সাদা রঙের ফুল ফোটে। আগেই বলেছি ফুল অসাধারণ সুগন্ধি। ফল হয় ক্যাপসুল জাতীয়। প্রতি ফলে দুটি করে বীজ থাকে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: সরলাদেবী—নির্ভীক এক সরস্বতী

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৪: স্বার্থান্বেষীকেও চিনতে শেখায় এই গ্রন্থ

সুন্দরবন অঞ্চলে বর্তমানে যেসব জায়গায় জনবসতি রয়েছে সেখানে খাল বা খাড়ির পাশে যেমন জন্মায় তেমনই নদীর চড়ায় পলি মাটির উপরে এই গাছ এখনও যথেষ্ট পরিমাণে জন্মায়। এরা মাঝারি ধরনের লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। তবে জোয়ারের জলে যেসব জায়গা প্রায়শই প্লাবিত হয় সেখানেও সুখদর্শন গাছের দর্শন মেলে। যেসব এলাকায় লবণাক্ততা কমে গিয়েছে, জোয়ারের জল অতদূর পর্যন্ত আসে না সেখানে সুখদর্শন ভালো জন্মায়। সুন্দরবন অঞ্চলে বিভিন্ন ঘাসের সাথে সুখদর্শনকে জন্মাতে দেখা যায়। যদিও সুন্দরবনের বহু বাসিন্দা এই গাছটিকে বাহারি উদ্ভিদ হিসেবে এখন বাড়ির বাগানে ঠাঁই দিয়েছে তবে বুনো প্রজাতি হিসেবে আজও সে প্রকৃতির শোভাবর্ধন করে। আর যেহেতু তৃণভোজী প্রাণীদের কাছে গাছটি বিষাক্ত তাই এর বিপন্নতার সম্ভাবনাও অপেক্ষাকৃত কম।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২৩: রাজসভায় মিথিলার সঙ্গীতজ্ঞ

 

লৌকিক চিকিৎসা

সুখদর্শন গাছটি নানা ধরনের লৌকিক চিকিৎসায় সুন্দরবনের মানুষ বহুকাল ধরে ব্যবহার করে এসেছে। কানের ভেতরে যন্ত্রণা হলে বা অর্শ হলে সুখদর্শন পাতার রস ভালো কাজ দেয়। বাত রোগেও পাতার রস কার্যকরী। অতীতে অনেক সময় কোনও টিউমারকে দ্রুত পাকানোর জন্য সুখ দর্শনের কন্দ বেটে টিউমারে লাগানো হত। বমি ভাব দূর করতেও কন্দের গন্ধ শুঁকানো হয়। সুখদর্শনের কন্দ কফ নিষ্কাশনে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে বা মূত্রঘটিত সমস্যায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহু কাল ধরে। ত্বকের রোগেও পাতার রস ব্যবহার করার প্রচলন রয়েছে। তাই সুখদর্শন গাছ শুধু দর্শনে যে সুখ দেয় তা নয়, বিভিন্ন রোগে শরীরকেও সুখ দেয়।

আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৭: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে/২

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

 

হুড়ো ফার্ন (Acrostichumm aureum)

ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদ সাধারণত পাহাড়ে বেশি জন্মায়। সমতলেও হয় তবে সংখ্যায় কম। কিন্তু তা বলে নোনা জলের অঞ্চল সুন্দরবনে? হ্যাঁ, সুন্দরবনেও কিছু ফার্ন জন্মায়। এইসব ফার্নের মধ্যে অন্যতম হল হুড়ো ফার্ন। অনেকে একে টাইগার ফার্নও বলে। কোনও কোনও উদ্ভিদবিদ এই ফার্নকে খাঁটি ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বললেও, কারও কারও মতে হুড়ো ফার্ন হল ম্যানগ্রোভ সহযোগী উদ্ভিদ। তবে যেহেতু এরা তীব্র লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে এবং ম্যানগ্রোভ অরণ্যের উন্মুক্ত স্থানে বা ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে জলা এলাকায় একক প্রজাতি হিসেবে ঠাসাঠাসি করে স্থায়ী হতে পারে। তাই এদের প্রকৃত ম্যানগ্রোভ বলাই যায়। অবশ্য নদী ও খাড়ির তীরে গেঁওয়া, গরান ও গোলপাতা গাছের সঙ্গে একসঙ্গে জন্মাতে ও দেখা যায়।

হড়ো ফার্ন হল প্রায় ছয় থেকে দশ ফুট লম্বা খাড়া ধরনের ফার্ন। এর কান্ড রাইজোম বা গ্রন্থিকাণ্ড প্রকৃতির। রাইজোম খাড়াভাবে থাকে এবং তার গায়ে জড়িয়ে থাকে অসংখ্য কালচে রঙের আঁশ। পাতাগুলো হয় বিশাল লম্বা। এক একটা পাতা চার পাঁচ ফুট লম্বা হয় আর প্রতি পাতায় ৮ থেকে ২০ জোড়া পত্রক থাকে। আগার দিকের পাঁচ থেকে আট জোড়া পত্রকের নিচের তলে থাকে অসংখ্য ইট রঙা বা মরচে রঙা রেনুস্থলী। আর সেই রেণুস্থলীর মধ্যে তৈরি হয় অসংখ্য হলুদ রঙের রেনু। রেনু অঙ্কুরিত হয়ে নতুন হুদো ফার্ন জন্ম নেয়। অবশ্য রাইজোম বা গ্রন্থিকাণ্ড থেকেও এদের বংশবিস্তার ঘটে।

হুডো ফার্ন এর কচি শাখা রান্না করে অনেক জায়গার মানুষ খায়। আবার পাতা পশু খাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। অনেক সময় বড় বড় পাতা ঘর ছাওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়। পরিণত পাতা থেকে প্রাপ্ত তন্তু দিয়ে দড়ি তৈরি হয়। এই ফার্নের পাতার আড়ালে সুন্দরবনের কুমির বাসা তৈরি করে ডিম পাড়ে।

(বাঁদিকে) সুখদর্শন ফুল ও কুঁড়ি। ছবি: লেখক। (মাঝখানে) সুখদর্শন ফুল। ছবি: সংগৃহীত। (ডান দিকে) সুখদর্শন গাছ। ছবি: লেখক।

 

লৌকিক চিকিৎসা

সুন্দরবন অঞ্চলে লৌকিক চিকিৎসায় হুড়ো ফার্নের তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও ব্যবহারের কথা আমার জানা নেই। হয়তো সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে। তবে শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশে এই ফার্নের রাইজোম বা গ্রন্থিকন্দ শুকিয়ে গুঁড়ো করে তা ঘা, ক্ষত, ফোঁড়া নিরাময়ের জন্য লাগানো হয়। এই গুঁড়ো রক্তপাত বন্ধ করতেও ব্যবহৃত হয়। পাতার রস ব্যবহার করা হয় অর্শ, পাকস্থলির ক্ষত, আমাশয় ও পুরুষের ইঙ্গুইনাল হার্নিয়া রোগের চিকিৎসায়। হয়তো সুদূর অতীতে সুন্দরবনের মানুষও এইসব রোগের নিরাময়ে হুড়ো ফার্নের কন্দ ও পাতা ব্যবহার করত।—চলবে।

* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content